
ছাত্র সংগঠনগুলোর বিভাজন ও মেরুকরণ ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক স্বার্থে একদিকে যেমন দূরত্ব তৈরি হয়েছে, অন্যদিকে কোথাও কোথাও গড়ে উঠছে সুসম্পর্ক। এমন প্রেক্ষাপটে ছাত্রদল ও বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলোর সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ মোড় নিয়েছে। ‘সন্ত্রাসবিরোধী শিক্ষার্থীবৃন্দ’ ব্যানারে সংগঠন দুটির নেতাকর্মীদের একসঙ্গে রাজপথে দেখা গেছে। বক্তৃতা-বিবৃতিতেও একে অন্যের পাশে দাঁড়ানোর বিষয়টিও আগের চেয়ে স্পষ্ট।
শেখ হাসিনা পতনের পরবর্তী সময়ে সংগঠনগুলোর গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফ্রন্ট, ফেডারেশন, বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রীসহ বিভিন্ন বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে ছাত্রদল আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো জোটে আবদ্ধ না হলেও তাদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া, কর্মকাণ্ড এবং কর্মসূচি পালনে অভিন্নতা বা সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়েছে। কোনো কোনো ইস্যুতে ছাত্রদলের সঙ্গে বামপন্থী সংগঠনগুলোকে এক কাতারে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন কর্মসূচিও পালন করতে দেখা গেছে।
বিভিন্ন ইস্যুতে ছাত্রদল ও বাম সংগঠনগুলোর কাছাকাছি আসা ইতিবাচক হিসেবে চিহ্নিত করছেন অনেকে। তারা বলছেন, রাজনৈতিক বা সাংগঠনিক স্বার্থে যেকোনো সংগঠন যে কারো সঙ্গে ভালো বা খারাপ সম্পর্ক রাখতে পারেন, এটাই গণতন্ত্রের বার্তা এবং রাজনৈতিক বৈচিত্রের মিলন। অন্যদিকে, কেউ কেউ বাম-ছাত্রদল সম্পর্ককে নেতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তাদের বক্তব্য, রাজনৈতিকভাবে ছাত্রদল কর্তৃক বাম সংগঠনগুলোর সঙ্গে ভাল সম্পর্ক রাখাটা বিপজ্জনক না হলেও তাদের মধ্যকার সাংস্কৃতিক অংশীদারিত্ব আশঙ্কাজনক।
যদিও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, 'সন্ত্রাসবিরোধী' ব্যানারে ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রফ্রন্ট ও ছাত্র ফেডারেশনের কেন্দ্র ও ঢাবির শাখার শীর্ষ নেতাদের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য হারে দেখা গেলেও সেখানে ছাত্রদলের প্রথম সারির কোনো নেতার দেখা মেলেনি। বরং তুলনামূলক কম পরিচিত দ্বিতীয়-তৃতীয় সারির নেতারা অংশগ্রহণ করছেন।
বিভিন্ন ইস্যুতে ছাত্রদল ও বাম সংগঠনগুলোর কাছাকাছি আসা ইতিবাচক হিসেবে চিহ্নিত করছেন অনেকে। তারা বলছেন, রাজনৈতিক বা সাংগঠনিক স্বার্থে যেকোনো সংগঠন যে কারো সঙ্গে ভালো বা খারাপ সম্পর্ক রাখতে পারেন, এটাই গণতন্ত্রের বার্তা এবং রাজনৈতিক বৈচিত্রের মিলন। অন্যদিকে, কেউ কেউ বাম-ছাত্রদল সম্পর্ককে নেতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তাদের বক্তব্য, রাজনৈতিকভাবে ছাত্রদল কর্তৃক বাম সংগঠনগুলোর সঙ্গে ভাল সম্পর্ক রাখাটা বিপজ্জনক না হলেও তাদের মধ্যকার সাংস্কৃতিক অংশীদারিত্ব আশঙ্কাজনক।
এক্ষেত্রে কারণ হিসেবে তারা বাম সংগঠনগুলোর ভাব-আদর্শ ডানপন্থী আদর্শের বিপরীতমুখী অবস্থানের বিষয়টিকে উল্লেখ করছেন তারা। আবার কেউ কেউ বলছেন, আওয়ামী লীগের সময় কিছু বামপন্থী দল জাতীয় রাজনীতির পাশাপাশি ক্যাম্পাসগুলোতেও ফ্যাসিবাদের বীজ বপনে ও কর্তৃত্ববাদী ভূমিকায় সহায়তা করেছে। তাদের সঙ্গে ছাত্রদলের সখ্যতা ভালো ফল বয়ে আনবে না|
তবে ছাত্রদল বলছে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে ন্যায্যতার ভিত্তিতে বাম সংগঠনগুলোর পাশে দাঁড়ানো সংগঠন হিসেবে তাদের দায়িত্ব। তবে তাদের সঙ্গে জোট গঠনের বিষয়টি আগামীদিনের সময় ও পরিস্থিতির ওপর নির্ভরশীল। অন্যদিকে বাম সংগঠনগুলো বলছে, ছাত্রদলের সঙ্গে আনু্ষ্ঠানিকভাবে জোট গঠনের আগ্রহ আপাতত তাদের নেই।
আর ছাত্রশিবিরের বক্তব্য, বাম সংগঠনগুলো ছাত্রলীগকে আগ্রাসী ও ফ্যাসিবাদী হতে সহযোগিতা করেছে। একইভাবে ছাত্রদলকেও ফ্যাসিবাদী হতে সহযোগিতা করে জনগণ ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে।
খোঁজ-খবরে পাওয়া তথ্য, সম্প্রতি শাহবাগে জাতীয় সংগীত অবমাননার প্রতিবাদে গত ১২ মে সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যে সমবেত কণ্ঠে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রমৈত্রী ও ছাত্র ফেডারেশনের মত অন্যান্য বাম সংগঠনসহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রদলকে জাতীয় সংগীত গাইতে দেখা যায়। এর আগে এদিন বিকেলে ঢাবির বিজয় একাত্তর হল ছাত্রদলের দপ্তর সম্পাদক সাকিব বিশ্বাস সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত পরিবেশন কর্মসূচির আহ্বান জানান। ছাত্রদলকে এ কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দিতে দেখা যায়।
মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশ থেকে খালাস পাওয়া জামায়াত নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলাম কারাগার থেকে মুক্তির রায়ের প্রতিবাদে গত ২৭ মে রাতে মশাল মিছিলের ডাক দেয় গণতান্ত্রিক ছাত্রজোটের নেতাকর্মীরা। এর বিপরীতে শাহবাগবিরোধী এক কর্মসূচি ঘোষণা করে শাহবাগবিরোধী ঐক্য নামে এক প্লাটফর্ম। এই দুই পক্ষের কর্মসূচি চলাকালে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয় এবং অভিযোগ উঠে বাম জোটের ওপর হামলার।
এ ঘটনায় প্রতিবাদ জানিয়ে বাম জোটের পক্ষে একটি বিবৃতি দেয় ছাত্রদলের বিশ্ববিদ্যালয় শাখা। এছাড়াও বাম নেতাদের মশাল মিছিলে ছাত্রশিবিরের হামলার অভিযোগ তুলে প্রতিবাদ জানিয়ে রাতেই বিক্ষোভ মিছিল করে শাখা ছাত্রদল। ২৮ মে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সামনে সংঘটিত হামলা ইস্যুতেও ছাত্রদল ও বাম সংগঠনগুলোকে সক্রিয় ও অভিন্ন ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে।
এর আগে গত ১৩ মে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভেতরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থী ও ছাত্রদল নেতা এসএম শাহরিয়ার আলম সাম্য খুন হন। এ ঘটনায় নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হওয়ার অভিযোগ তুলে শুরু থেকেই ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান এবং প্রক্টর অধ্যাপক সাইফুদ্দীন আহমদের পদত্যাগ দাবি করে আসছে ছাত্রদল।
অনেকে বলছেন, কুয়েটে শিবিরের শিক্ষার্থীরা জোর করে বিএনপিপন্থী ভিসিকে অপসারণ করিয়েছে; সেটার প্রতিবাদে এবার ঢাবির ভিসিকেও সরাতে চান তারা। এ ঘটনায় ভিসি-প্রক্টরের পদত্যাগ দাবির সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফেডারেশন, বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রীসহ অন্যান্য প্রায় অধিকাংশ বাম সংগঠনের নেতাকর্মীরাই ছাত্রদলের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে। ছাত্রদলের মত তাদেরকেও ঢাবি ভিসি-প্রক্টরের পদত্যাগ দাবির বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিতে দেখা যায়।
৫ আগস্ট পরবর্তী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে দুইবার ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে বৈঠকের আয়োজন করা হয়। এ সময় ছাত্রদল, ছাত্রশিবিরসহ বামসংগঠনগুলো অংশ নেয়। তবে ধীরে ধীরে বৈষম্যবিরোধীদের সঙ্গে মতবিরোধ বাড়ে ছাত্রদল এবং বামসংগঠনগুলোর। পরে ঐক্যের জন্য আরেকটি মিটিং ডাকলেও ছাত্রদল তাতে অংশ নেয়নি। তবে মিটিংয়ে ছাত্রশিবির অংশ নেয়।
সূত্রের তথ্য, ৫ আগস্ট পরবর্তী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে দুইবার ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে বৈঠকের আয়োজন করা হয়। এ সময় ছাত্রদল, ছাত্রশিবিরসহ বামসংগঠনগুলো অংশ নেয়। তবে ধীরে ধীরে বৈষম্যবিরোধীদের সঙ্গে মতবিরোধ বাড়ে ছাত্রদল এবং বামসংগঠনগুলোর। পরে ঐক্যের জন্য আরেকটি মিটিং ডাকলেও ছাত্রদল তাতে অংশ নেয়নি। তবে মিটিংয়ে ছাত্রশিবির অংশ নেয়।
অন্যদিকে, গত ৫ ডিসেম্বর ছাত্রদলের আহবানে ৩০টি ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীদের বৈঠক হয়। সে বৈঠকে দাওয়াত পায়নি ইসলামী ছাত্রশিবির ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। জানা যায়, সভায় শিবিরের ‘গুপ্ত রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের’ সমালোচনা করেন অনেক নেতাকর্মী। আবার অনেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীদের ‘স্বেচ্ছাচারিতার’ সমালোচনা করেন।
গত ১০ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ‘ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির প্রকৃতি ও ধরন’ বিষয়ক কমিটির সঙ্গে দুই ধাপে ছাত্রসংগঠনগুলোর মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। ছাত্রশিবির সেই আলোচনায় অংশ নিলে সভা ছেড়ে চলে যায় ৩ বাম ছাত্রসংগঠন। সেগুলো হল- বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট (মার্ক্সবাদী) ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট (বাসদ)।
বাম-ছাত্রদলের সম্পর্ক প্রসঙ্গে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে এবি যুবায়ের নামে এক ঢাবি শিক্ষার্থী দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আওয়ামী লীগের অধিকাংশ অপকর্মের বৈধতা দিয়ে আসছে বাম সংগঠনগুলো। হাসিনা ২০১৩ সালে যে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে সেগুলোরও বৈধতা তারা দিয়েছে। হাসিনার অবৈধ শাসনকেও তারাই বৈধতা দিয়েছে। ছাত্রদল ও শিবিরের মতো বড় সংগঠনগুলো ক্যাম্পাসে ঢুকতেই পারতো না। আর বাম সংগঠনগুলো ১০-১২ জন নিয়েই মিছিল মিটিং করেছে; আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগ তাদেরকে ফুলের টোকাও দিতো না। এতেই বুঝা যায়, তারা আওয়ামী লীগের একটা বি-টিম হিসেবে কাজ করে। বাম সংগঠনগুলো পরগাছার মতো থাকে। সেই জায়গা থেকে হাসিনা যাওয়ার পর থেকে বাম দলগুলো সম্ভাব্য ক্ষমতাশীল দল বিএনপি ও ছাত্রদলের সঙ্গে জোট করার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষার্থী আশিক খান বলেন, বাম ছাত্র সংগঠনের বৃহত্তর মাদার সংগঠনগুলোই ফ্যাসিবাদের মদদপুষ্ট ১৪ দলের সদস্য; যারা আওয়ামী লীগের সাথে মিশে দীর্ঘদিন গুম-খুন ও নিপীড়নের সাথে জড়িত ছিল। বামরা সারাজীবন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে চায়। এখন যখন বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে; তখন এরা আবার বিএনপির ঘাড়ে চড়ে বসার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে।
বাম-ছাত্রদলের সম্পর্ক ও জোট প্রসঙ্গে বক্তব্য জানতে চাইলে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দিন নাছির বলেন, ‘বাম সংগঠনগুলোর সঙ্গে আমাদের জোট হয়নি। তবে ন্যায্যতার ভিত্তিতে বাম সংগঠনগুলোর সঙ্গে কিছু জায়গায় মিল হয়তো দেখেছেন। তারা যদি কোনো বিপদে পড়েছে এবং যদি আমাদের কাছে ন্যায্য মনে হয়েছে যে তারা ক্ষতিগ্রস্ত, তাদের পাশে দাঁড়ানো প্রয়োজন। তখন স্বাভাবিকভাবেই আমরা তাদের পক্ষে গিয়েছি।
তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্য হত্যার বিষয়ে তাদের অবস্থান আমার জানা নেই। তবে রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের ওপর অন্য একটা সংগঠন যখন হামলা করেছে; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন তাদের কর্মসূচিতে বাঁধা দেওয়া হয়েছে, তখন আমরা সংগঠন হিসেবে এসব ঘটনায় প্রতিবাদ জানিয়েছি। ভবিষ্যতে তাদের সঙ্গে জোট করা বা না করার বিষয়টি নির্ভর করবে সময় ও পরিস্থিতির উপর।
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি এস এম ফরহাদ বলেন, গত দেড় যুগে আওয়ামী লীগের সময়ে ফ্যাসিবাদী বয়ান নির্মাণে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে বাম সংগঠনগুলো। সর্বশেষ গত বছরের আগস্টেও হাসিনার পতনের আগে ফ্যাসিবাদী সিংহাসন টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে ১৪ দলের অধিকাংশ বাম সংগঠনগুলো মিটিং করেছে। সেই ১৪ দলভুক্ত বাম দলগুলোর ছাত্র সংগঠনগুলোসহ ভিনদেশি সংস্কৃতিকে মনে-প্রাণে ধারণকারী সংগঠনগুলোকে ছাত্রদল এভাবে আপন করে নেবে তা বেশ বেমানান এবং দুঃখজনক।
অথচ এই বামপন্থীদের কারণেই আওয়ামী লীগের সময়ে দীর্ঘদিন ধরে বিএনপি-ছাত্রদলের নেতৃবৃন্দ সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, যেসব ঘটনায় শিবির কোনোভাবেই জড়িত ছিল না, সেগুলোতে শিবিরকে জড়িয়ে নানা কর্মসূচি পালন করেছে বাম সংগঠনগুলো। আর তাদেরকে ছাত্রদল সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছে। অথচ ছাত্রদলের সঙ্গে ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত কাজ করেছে শিবির। ফ্যাসিবাদ আমলে ফ্যাসিবাদ দমনেও ছাত্রদল ও শিবির সহযোগিতামূলক কার্যক্রম করেছে। কিন্তু বর্তমানে এসে এই বাম সংগঠনগুলোকে ছাত্রদল ইন্ধন দিচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, আমি আশঙ্ককা করি- এই বাম সংগঠনগুলো যেভাবে ছাত্রলীগকে আগ্রাসী ও ফ্যাসিবাদী হতে সহযোগিতা করেছে, ঠিক তেমনিভাবে ছাত্রদলকেও ফ্যাসিবাদী হতে ভূমিকা রাখবে, তাদের বৈশিষ্ট্যই এটা। ছাত্রদলকে তারাই জনগণ ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের থেকে বিচ্ছিন্ন করবে এবং কঠিন পরিণতি ভোগ করাবে। আমরা সম্প্রতি খেয়াল করছি, শিবিরকে কোনো নেতিবাচক ঘটনায় জড়াতে পারলে বাম সংগঠনগুলো ও ছাত্রদল মিলে আন্দোলন করে তুলকালাম করে ফেলে। অথচ ছাত্রদলসহ বিএনপির কোনো অঙ্গসংগঠনের কারো মাধ্যমে দিনের পর দিন নেতিবাচক কিছু হলেও তাদের মুখ খুলতে দেখি না। গতকালও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নারী শিক্ষার্থী ও তার পরিবারকে ছাত্রদল কর্তৃক হেনস্থার ঘটনায় তাদেরকে চুপ থাকতে দেখেছি। তাদের এরকম দ্বিচারিতামূলক আচরণ ফ্যাসিবাদের পতন পরবর্তী বাংলাদেশে প্রত্যাশিত ছিল না।
স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্রসংসদের আহবায়ক জামালুদ্দীন মুহাম্মাদ খালিদ বলেন, রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে এক সংগঠন আরেক সংগঠনের সাথে সম্পর্ক রাখতে পারে বা জোটবদ্ধ হতে পারে, এটা স্বাভাবিক। এটা গণতন্ত্রের বার্তা। ছাত্রদল বামদের সঙ্গে জোট করলে সমস্যার কিছু দেখি না। তবে আপত্তি এক জায়গায় রয়েছে। সেটা হল— বাম সংগঠনগুলো রাজনৈতিকভাবে আওয়ামীবিরোধী হলেও সাংস্কৃতিকভাবে আওয়ামী লীগকে দেশে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালাতে সমর্থন জুগিয়েছিল। অধিকাংশ বামরা কালচারালি আওয়ামী ফ্যাসিবাদেরই অংশ।
তিনি বলেন, এরই মধ্যে যখন আমরা দেখি, বামদের সঙ্গে ছাত্রদল কালচারালিও মেশার চেষ্টা করছে, তখন বিষয়টাকে আশঙ্কাজনক মনে হচ্ছে। এটার একটা খারাপ প্রভাব ইতোমধ্যে পড়া শুরু হয়েছে। আওয়ামী লীগের সময়ে কেউ ইসলাম চর্চা করলেই শিবির ও জঙ্গী ট্যাগ দেওয়া হতো। এই চর্চাটা ফের ছাত্রদলের মাঝে ফিরে আসার প্রবণতা বাড়ছে। কারণ, শিবিরের বিরোধিতা করতে গিয়ে বামদের সঙ্গে মিশে তারা আওয়ামী কালচারাল রেটোরিককে বা বয়ানকে আপন করে নিচ্ছে। এটা সহজ হচ্ছে বামদের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার কারণেই।
ছাত্র অধিকার পরিষদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহবায়ক সানাউল্লাহ হক বলেন, বাম সংগঠনগুলো হচ্ছে শিবিরের প্রতিপক্ষ। তাদের মাঝে কখনোই ভাল সম্পর্ক বিরাজ করেনি। এদিকে ছাত্রদলও শিবিরের প্রতিপক্ষ। রাজনীতিতে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে প্রতিপক্ষের প্রতিপক্ষকে হাত করা একটা কৌশল। আমার মনে হয়, পারষ্পরিক দূরত্বকে এই দুই পক্ষই বর্তমানে কাজে লাগাচ্ছে।
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের সহ-সাধারণ সম্পাদক খাইরুল আহসান মারজান বলেন, ছাত্রদলের উপরে ভর করে বামদের কালচারাল হেজিমনি ধরে রাখার যে প্রচেষ্টা তা সফল হবে বলে মনে হয় না। বরং উক্ত সংগঠনগুলো ছাত্রদলকেও ডোবাবে। বিএনপির সব সময় রাজনৈতিক বয়ান ছিল ‘বামের ডানে এবং ডানের বামে’। কিন্তু ইদানিং দেখছি ঢাবি ছাত্রদল বামের সাথে মিলেমিশে একাকার হতে চলেছে। ঐক্য করতেই পারে। তবে মধ্যমপন্থী অবস্থান থেকে সরে বামদের কোলে উঠে যদি ইসলামপন্থীদের মুখোমুখি হতে চায়; তাহলে সেটা হবে ছাত্রদলের জন্য আত্মঘাতী।
সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সভাপতি ইউসুফ আদনান মানসুর বলেন, বামদের সঙ্গে মিলে ছাত্রদল যদি ইসলামপন্থিদেরকে বিরোধী পক্ষ হিসেবে চিন্তা করে তাহলে এটা ছাত্রদলের জন্য আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হবে। কারণ, ছাত্রদলের সঙ্গে আমাদের মতো ইসলামি সংগঠনগুলোর খুব বেশি আদর্শগত বিরোধ নেই, কিন্তু বামদের সঙ্গে তাদের এই পার্থক্যটা বেশি হওয়ার কথা। এজন্য এখন ছাত্রদলের ভাবা উচিৎ যে, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের বোধ-বিশ্বাসের বিপরীতে তারা যাবে কিনা। যদি তারা অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের বাইরে গিয়ে চিন্তাভাবনা করে সেটা অবশ্যই ছাত্রদলের জন্য কল্যাণকর হবে না।
ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদী বলেন, রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে সংগঠনগুলোর মধ্যে বোঝাপড়া থাকাকে আমি নেতিবাচকভাবে দেখি না। আমি চাই শিবিরের সাথেও কিছু কিছু জায়গায় ছাত্র ইউনিয়নসহ অন্যান্যদের বোঝাপড়া তৈরি হোক। রাজনীতি হোক বৈচিত্র্যময়। বাম সংগঠনগুলো নিয়ে আমার কোনো বিপরীত অবস্থান নেই। আমার আপত্তি হলো— বামপন্থার নামে ভারতপন্থা টিকিয়ে রাখার রাজনীতি করা; যেটা বাংলাদেশে হচ্ছে। আমার নিজস্ব মতামত হচ্ছে, ছাত্রদলের নিজস্ব কাজ বা এজেন্ডা সেটা তারা জারি রাখুক, অন্যদের মার্জ করা বা মিলিয়ে ফেলার বিষয়টি ছাত্রদের রাজনৈতিক অঙ্গনের বৈচিত্র নষ্ট করে ফেলবে।
তিনি আরও বলেন, ছাত্রদলের তো লড়াই সংগ্রামের একটা ইতিহাস আছে। এখন সাধারণ শিক্ষার্থী-জনতা যদি খেয়াল করে যে, তাদেরকে অন্যকেউ ন্যারেটিভ নির্মাণ করে দিচ্ছে তাহলে শহীদ জিয়া ও বেগম জিয়াকে যারা ভালবাসে তারাই তো আহত হবে। এজন্য আমি মনে করি, ছাত্রদল, শিবির, বাম ও অন্যান্য সংগঠনগুলো নিজেদের মত করেই রাজনীতি করুক। তাতে ছাত্ররাজনীতিতে বৈচিত্র্যময় পরিবেশ বিরাজ করবে।
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের একাংশের সভাপতি মাহির শাহরিয়ার রেজা বলেন, অভ্যুত্থানের পর থেকে ছাত্রদলের সঙ্গে আমাদের বেশ কয়েকবার আলোচনা হয়েছে। সেটা পুরোটাই রাজনৈতিক আলোচনা। আমরা এতে জোট করার কোনো কথা বলিনি বা চিন্তা করিনি। মতাদর্শের ভিন্নতা থাকায় জোটের মাধ্যমে কাজের বিষয়টি নিয়ে কথা বলা হয়নি। তবে ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্ররাজনীতির গুনগত মান বৃদ্ধি নিয়ে আমাদের আলাপ-আলোচনা হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে সাম্য ইস্যুতে আমরা একসাথে ছিলাম।
আর শিবির অভ্যুত্থানের পর থেকে ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্রলীগের মত একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, সেই বিষয়ে আমরা সকল ছাত্রসংগঠন প্রতিবাদ জানিয়েছি। কিছুদিন আগে ছাত্রদলের পোস্টার লাগানোতে বাঁধা দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেক ছাত্রসংগঠনেরই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ রয়েছে। সেই সুযোগে বাধাগ্রস্থ হলে তাদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের দায়িত্ব। সেই জায়গা থেকে ছাত্রদলের সঙ্গে আমাদের কর্মসূচিভিত্তিক একটা সম্পর্ক রয়েছে।
বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদাক সৈকত আরিফ বলেন, ছাত্রদলের সঙ্গে বাম সংগঠনগুলোর যে ঐক্য দেখা যাচ্ছে— সেটা অনেকটা রাজনৈতিক। এটা প্রকাশ্যে এসেছে অনেকটা সাম্য হত্যার পর। এ হত্যাকাণ্ডের বিচার ইস্যুতে ছাত্রদলের সঙ্গে বামসংগঠনগুলো আনঅফিসিয়ালি এক প্লাটফর্মে কাজ করছে। আর আওয়ামী লীগের সময়ও এ সংগঠনগুলো একসাথে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, সেই জায়গা থেকে এ সম্পর্কের দীর্ঘসূত্রিতা রয়েছে। রাজনৈতিক হিসেব-নিকেশ অনুযায়ী ভবিষ্যতেও বাম সংগঠনগুলো ছাত্রদলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চাইবে হয়তো। তবে সাম্য ইস্যু ছাড়া আক্ষরিক অর্থে ছাত্রদলের সঙ্গে অ্যালায়েন্স নেই।
গণতান্ত্রিক ছাত্র জোটের সমন্বয়ক ও বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সভাপতি দিলীপ রায় বলেন, কর্মপদ্ধতি বা নীতিগত জায়গা থেকে ছাত্রদলের সঙ্গে জোট হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। আমরা মনে করি, ছাত্ররাজনীতি হবে বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গা থেকে; প্রতিযোগিতা হবে ভাল কাজ এবং শিক্ষার্থীবান্ধব হওয়ার মাধ্যমে। আমরা ক্যাম্পাসগুলোতে মারামারি, হানাহানি, ভিন্নমতের ওপর আক্রমণ করে দমনের পরিস্থিতি আমরা চাই না। এমন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমাদের কিছু কাজ বা কর্মসূচি হয়তো তাদের সঙ্গে মিলে যেতে পারে। সব বিষয় যে মেলে; তা কিন্তু না। নির্দিষ্ট কোনো ইস্যুতে তাদের সঙ্গে হয়তো কিছু বিষয় মিলে যাচ্ছে কাকতালীয়ভাবে।