Image description

রাজধানীর আন্ডারওয়ার্ল্ডে চলছে নতুন মেরুকরণ। একদিকে জেল থেকে বের হয়ে অথবা দেশে ফিরেই এলাকায় একক রাজত্ব করতে চাচ্ছেন তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীরা। অপরদিকে একসময়ে এসব সন্ত্রাসীর নির্দেশে যারা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে এসেছেন তারাও এলাকার কর্তৃত্ব ছাড়তে নারাজ। কারণ দখল, চাঁদাবাজি, খুনোখুনি, ভাড়ায় খাটা, আধিপত্যের লড়াইসহ নানা অপকর্মের মাঠ পর্যায়ের নিয়ন্ত্রক এখন তারাই। এসব নিয়ে চরম অস্থিরতা চলছে ঢাকার অপরাধ জগতে। 

এমন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন সময়ে দলছুট ক্যাডারদের কাছে টেনে নিচ্ছেন ৫ আগস্টের পর মুক্তি পাওয়া ও দেশে ফিরে আসা শীর্ষ সন্ত্রাসীরা। বিনিময়ে মোটা অঙ্কের টাকা, চাঁদার ভাগ বাড়ানো ও এলাকার নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়াসহ অত্যাধুনিক অস্ত্র হাতে তুলে দেওয়ারও প্রলোভন দেখানো হচ্ছে। সম্প্রতি কুষ্টিয়া থেকে গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডে থাকা দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদ জিজ্ঞাসাবাদে এমনই চাঞ্চ্যকর তথ্য দিচ্ছেন। যার সত্যতা পাওয়ার পর দেশে অবস্থানরত আরও কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসীকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে বলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার মোহাম্মদ নাসিরুল ইসলাম গতকাল শনিবার বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ ও সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারে আমাদের দুই ধরনের পুলিশিং ব্যবস্থা চলমান। আমরা গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি করেছি। এ ব্যাপারে নানামুখী প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। সেখানে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অপতৎপরতার বিষয়টি সামনে এসেছে। এ ছাড়া বাইন ও মাসুদের কাছ থেকেও কিছু তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। ওইসব তথ্য যাচাইয়ের পর দ্রুতই অ্যাকশনে যাবে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।’

জানা যায়, গত বছর আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শীর্ষ সন্ত্রাসী আব্বাস আলী ওরফে কিলার আব্বাস, শেখ মোহাম্মদ আসলাম ওরফে সুইডেন আসলাম, ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলাল, সানজিদুল ইসলাম ওরফে ইমন, খন্দকার নাঈম আহমেদ ওরফে টিটন, খোরশেদ আলম ওরফে রাসু ওরফে ফ্রিডম রাসু ও আরমান কারাগার থেকে মুক্তি পান। আর মোল্লা মাসুদ ভারত থেকে দেশে ফিরে আসেন।

এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফেরেন আমিন রসুল সাগর ওরফে টোকাই সাগর। এরপরই তারা এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। জেলে থাকা অবস্থায় যেসব ক্যাডার তাদের কথামতো চলত এবং টাকা ওঠাত তাদের ডেকে নেওয়া হয় এসব শীর্ষ সন্ত্রাসীদের ডেরায়। এরপর তাদের কাছে এলকাভিত্তিক টাকা আদায়ের তালিকা চাওয়া হলে অনেকে বেঁকে বসেন। তারা আগের মতো চাঁদার ভাগ দিতে রাজি হলেও এলাকার পুরো নিয়ন্ত্রণ ছাড়তে অনেকে অস্বীকার করেন। এ নিয়ে অনেক শীর্ষ সন্ত্রাসীর সঙ্গে তাদেরই পালিত ক্যাডারদের মনোমালিন্য হয়। বিষয়টি মাথায় নিয়ে অনেকে দল পুনর্গঠনে হাত দিয়েছেন। বিভিন্ন এলাকায় তৎপর হয় তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের গ্রুপ-উপগ্রুপ। এরপরই আন্ডারওয়ার্ল্ডে শুরু হয় অস্থিরতা। 

শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমন, সুব্রত বাইন, মোল্লা মাসুদ ও ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলাল গ্রুপের সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও দখলবাজির খবর বারবার সামনে আসে। এরপর সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে সুইডেন আসলামের বিরুদ্ধে এখনও কোনো অভিযোগ ওঠেনি। তিনি এখনও পর্যন্ত পরিবারের সদস্য ছাড়া কারও সঙ্গে দেখা করেননি, এমনকি কোনো ধরনের যোগাযোগ মাধ্যমও ব্যবহার করেন না বলে একাধিক সূত্র দাবি করেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে লুট হওয়া অত্যাধুনিক ও ক্ষুদ্র অস্ত্র এখনও উদ্ধার হয়নি। অনেক সন্ত্রাসী বাহিনীর প্রধানরা এসব অস্ত্র তাদের হেফাজতে আছে এবং নিজস্ব ক্যাডারকে দেওয়া হবে বলে গোপনে প্রচারণা চালাচ্ছেন। উদ্দেশ্য উঠতি ক্যাডারদের নিজেদের দলে ভেড়ানো। কারণ উঠতিদের কাছে দামি ও অত্যাধুনিক অস্ত্র সোনার হরিণ। এমন প্রলোভনে পড়ে অনেকে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। এরপর ওইসব ক্যাডারের কিছু মিশন দিয়ে মাঠে পাঠানো হচ্ছে। মিশন সফল হলে তবেই তাদের অস্ত্র ও এলাকার দায়িত্ব দেওয়া হবে বলে আশ্বস্ত করা হয়েছে। অপরদিকে দীর্ষদিন ধরে মাঠ দখলে রাখা ক্যাডাররাও নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে মরিয়া। তারাও উঠতি ছেলেদের হাতে ধারালো ও ক্ষুদ্র অস্ত্র তুলে দিচ্ছেন। এলাকায় আধিপত্য বজায় রাখতে ও আতঙ্ক বাড়াতে কোপাকুপি এবং বোমাবাজির ঘটনাও ঘটাচ্ছেন। অনেকে আবার বিভিন্ন দলের কর্মী, সমর্থক ও নেতা দাবি করেও এলাকায় নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে ধারাবাহিক অভিযান চালাচ্ছে বিভিন্ন থানা পুলিশ। গ্রেপ্তার করা হচ্ছে কিশোর গ্যাংসহ ছিঁচকে অপরাধীদের। তবে আড়ালে থেকে যাচ্ছে নেপথ্যের নায়করা।

সূত্রমতে, গত ২৭ মে কুষ্টিয়া থেকে দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদ সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ার পর ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসী ও তাদের সহযোগীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। গ্রেপ্তার এড়াতে তারা পুরোনো ডেরা পাল্টে উঠছেন নতুন ডেরায়। কেউ কেউ দেশ ছাড়ারও পরিকল্পনা করছেন। একটি সূত্রমতে, শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন মালয়েশিয়া পালিয়ে গেছেন। আর পিচ্চি হেলাল দেশেই আছেন। মালয়েশিয়া থেকেই রাজধানীর ধানমন্ডি, নিউমার্কেট, এলিফ্যান্ট রোড ও হাজারীবাগ এলাকায় নিজের সন্ত্রাসী বাহিনী চালাচ্ছেন সানজিদুল ইসলাম ইমন। আর মোহাম্মদপুর ও আশপাশ এলাকায় নিজের সন্ত্রাসী বাহিনী চালাচ্ছেন পিচ্চি হেলাল। ইতোমধ্যে দখলবাজি, চাঁদাবাজি ও খুনোখুনিতে জড়িতের অভিযোগে ইমন, পিচ্চি হেলাল এবং তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা ও জিডি হয়েছে। ইমন বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড জাহিদ হোসেন ওরফে চাচা জাহিদকে পুলিশ গ্রেপ্তার করলেও সম্প্রতি তিনি জামিনে মুক্ত হয়ে নিউমার্কেট এলাকায় তৎপর রয়েছেন। ক্ষমতার পালাবদলের পর এই জাহিদ হোসেন নিউমার্কেট এলাকার একটি মার্কেট কমিটির নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। আর গত বছর ক্ষমতার পালাবদলের পর থেকেই ইমন ও পিচ্চি হেলাল বাহিনীর মধ্যে আধিপত্যের লড়াই চলে আসছে। তবে সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদ গ্রেপ্তার হওয়ার পর এই দুই বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। 

গোয়েন্দাদের একটি সূত্রমতে, অন্তত ৩ জন শীর্ষ সন্ত্রাসীকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। যেকোনো সময় তাদের গ্রেপ্তার করা হতে পারে। সম্প্রতি রাজধানীতে অপরাধের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার পেছনে তাদের ইন্ধন পাওয়া গেছে।

জানা গেছে, গত দুই মাসে রাজধানীতে তিনটি খুন, দখল, চাঁদাবাজি এবং হামলার ঘটনায় শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন, মোল্লা মাসুদ ও বিকাশের নাম আসে। বাড্ডার গুদারাঘাট এলাকায় বিএনপির নেতা কামরুল আহসানকে (সাধন) গুলি করে হত্যার পেছনেও শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনের নাম সামনে আসে। এর আগে ১৯ এপ্রিল হাতিরঝিলে ওয়ার্ড যুবদলের সদস্য আরিফ শিকদারকে গুলি ও ছুরিকাঘাতে হত্যার পেছনেও সুব্রত বাইনের সম্পৃক্ততা পায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। 

এ ঘটনার কিছুদিন আগে ১৩ মার্চ মগবাজারের ওয়্যারলেস রেলগেটের পাশে একটি ক্লাব ঘরের ভেতরে কুপিয়ে ও মাথা থেঁতলে দেওয়া হয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৩৬ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সদস্য মো. রাজনকে। পরে চিকিৎসা নিয়ে বেঁচে ফেরেন তিনি। এ ঘটনায়ও সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদের সংশ্লিষ্টতা পায় পুলিশ। এরপরই অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়েন তারা।