
গত সরকারের ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদের নামে এ পর্যন্ত চার দেশে টাকা পাচারের তথ্য পাওয়া গেছে। পাচার করা টাকায় তিনি বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। এর মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২২৮টি, যুক্তরাষ্ট্রে ৭টি এবং যুক্তরাজ্যে ৩৩৬টি বাড়ি ও ফ্ল্যাটের সন্ধান মিলেছে। এগুলোর মূল্য ১ হাজার ২২০ কোটি টাকার বেশি। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে ১টি, সিঙ্গাপুরে ৩টি এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৪টি ব্যাংক হিসাব শনাক্ত করা হয়েছে। এগুলোয় জমা ২ কোটি ৭১ লাখ টাকা। এসব সম্পদ উদ্ধারে সরকার থেকে জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে যুক্তরাজ্য ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। যুক্তরাজ্যে জাভেদের সম্পদ এখন জব্দের প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। সরকারের একাধিক তদন্ত সংস্থার প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, বিদেশে স্থাবর ৫৭১টি সম্পত্তি রয়েছে। এর মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২২৮টি ফ্ল্যাট বা বাড়ি আছে। এগুলো কেনার সময় দলিলে মূল্য দেখানো হয়েছে ৯ কোটি ১৩ লাখ ৮০ হাজার ডলার। যুক্তরাষ্ট্রে ৭টি বাড়ি ও ফ্ল্যাটের সন্ধান পাওয়া গেছে। কেনার সময় দলিলে এগুলোর মূল্য দেখানো হয়েছে ৭৫ লাখ ডলার। যুক্তরাজ্যে ৩৩৬টি বাড়ি ও ফ্ল্যাট রয়েছে। এগুলোর ক্রয়মূল্য ৩ লাখ ২০ হাজার ডলার। দলিল অনুযায়ী এগুলোয় মোট বিনিয়োগ ৯ কোটি ৯২ লাখ ডলার বা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ হাজার ২২০ কোটি ১৬ লাখ টাকা।
অস্থাবর সম্পত্তির মধ্যে তিন দেশে ৮টি ব্যাংক হিসাবের তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে একটি ব্যাংক হিসাবে ২ লাখ ডলার স্থিতি রয়েছে। সিঙ্গাপুরে তিনটি ব্যাংক হিসাবের সন্ধান পাওয়া গেছে। এগুলোর স্থিতি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতে রয়েছে চারটি ব্যাংক হিসাব। এগুলোয় জমা ৮৮ হাজার ২৬৮ দিরহাম বা ২০ হাজার ডলার। এসব হিসাবে মোট জমা ২ লাখ ২০ হাজার ডলার বা বাংলাদেশি মুদ্রায় ২ কোটি ৭১ লাখ টাকা।
বিদেশে স্থাবর ও অস্থাবর মিলে ৫৭৯টি সম্পত্তি রয়েছে। এগুলোর মোট মূল্য ৯ কোটি ৯৪ লাখ ২০ হাজার ডলার বা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ হাজার ২২২ কোটি ৮৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা। এসব সম্পদের মূল্য বর্তমানে আরও কয়েকগুণ বেশি হবে।
সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন, দেশ থেকে পাচার করা টাকা দিয়ে বিদেশে তিনি এসব সম্পদ গড়েছেন। এগুলো উদ্ধারে সরকার থেকে জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও সংযুক্ত আরব আমিরাত-এই তিন দেশে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট বা এমএলএআর পাঠানো হয়েছে।
এমএলএআর-এর মাধ্যমে পাচার করা সম্পদ ফেরাতে তিন দেশের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। কোনো দেশে টাকা পাচারের সুনির্দিষ্ট তথ্য পেলেই কেবল ওই দেশে এমএলএআর পাঠানো হয়। এটি এমন এক পদ্ধতি, যা দুই দেশের প্রচলিত আইনকানুন মেনে পাঠানো হলে সংশ্লিষ্ট দেশ সহায়তা করে। পাচার করা সম্পদের পক্ষে রাষ্ট্রের প্রকৃত মালিকানা বা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ বা কর ফাঁকি দিতে সম্পদ পাচার করা হয়েছে, এটি প্রমাণ করতে পারলেই তা জব্দ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। তিন দেশে এমএলএআর পাঠানোর পর যুক্তরাজ্য সবচেয়ে বেশি ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। তারা বাংলাদেশকে ফিরতি চিঠি দিয়েছে। এতে বলেছে, বাংলাদেশ সরকার যেসব সম্পদ তাদের দেশ থেকে পাচার করা অর্থে কেনা হয়েছে বলে দাবি করেছে, সেগুলোর সপক্ষে সম্পদের ‘প্রুফ অব ওনারশিপ’ বা প্রকৃত মালিকানার প্রমাণ ও দেশীয় আদালত থেকে ওইসব সম্পত্তি ফ্রিজ করার অর্ডারের কপি চেয়েছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের আদালতের রায়ে যুক্তরাজ্য সংশ্লিষ্ট সম্পদের অংশ ফ্রিজ করার যেসব নির্দেশনা রয়েছে, সেগুলো আলাদাভাবে পাঠাতে অনুরোধ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বাংলাদেশ থেকে ইতোমধ্যে ওইসব তথ্য যুক্তরাজ্যের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। তারা সেগুলো পর্যালোচনা করছে বলে ঢাকায় প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে। তাদের কাছে ওইসব সম্পদ অর্জনের ক্ষেত্রে অনিয়ম প্রতিয়মান হলেই কেবল সেগুলো জব্দ করার প্রক্রিয়া শুরু করবে। যুক্তরাষ্ট্র ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। তারা বাংলাদেশে ফিরতি চিঠি পাঠিয়ে আরও কিছু তথ্য চেয়েছে। সেগুলো তৈরি করে পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে, সম্প্রতি গভর্নরের আমিরাত সফরের সময় এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। তবে দেশটি এখনো অফিশিয়ালি কোনো সাড়া দেয়নি।
সাবেক ভূমিমন্ত্রী জাভেদের পাচার করা সম্পদ পুনরুদ্ধারের বিষয়ে কাজ করছে এমন একাধিক সূত্র থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে তিনি যে টাকা পাচার করেছেন, সেটি বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের বা বিএফআইইউর তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে। প্রয়োজনীয় দলিলপত্র দিয়ে তা প্রমাণ করা যাবে। পাচার করা অর্থেই তিনি বিদেশে বিপুল সম্পদ গড়েছেন। পাচার করা টাকা ছাড়া এত সম্পদ গড়ার অর্থ তিনি কোথায় পাবেন। এর আগে বিগত সরকারের সময়ে এক সংবাদ সম্মেলনে যদিও জাভেদ দাবি করেছেন, তিনি বাংলাদেশ থেকে কোনো টাকা পাচার করেননি। তার বাবার বিদেশে আগে থেকেই ব্যবসা ছিল। সেই ব্যবসার পুঁজি বড় হয়ে আরও সম্পদ ক্রয় করেছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, জাভেদ বাংলাদেশের একজন সংসদ-সদস্য ও মন্ত্রী ছিলেন। বিদেশে তার কোনো সম্পদ থাকলে সেই তথ্য নির্বাচনি হলফনামায় উল্লেখ করতে হবে। তার কোম্পানি বা ব্যক্তিগত আয়কর নথিতেও এসব তথ্য থাকতে হবে। কিন্তু বাস্তবে বিদেশে সম্পদ থাকার তথ্য হলফনামায়ও দেননি। আয়কর নথিতেও উল্লেখ করেননি। এর মানে হচ্ছে, তিনি ওইসব সম্পদ গোপন করেছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে-সম্পদ বৈধ হলে তিনি তা গোপন করবেন কেন?
সূত্র জানায়, এসব তথ্য-উপাত্ত ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ যুক্তরাজ্যের কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে ধরা হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই প্রমাণ করা সম্ভব হবে ভূমিমন্ত্রী বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার করেছেন।
বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার করে যুক্তরাজ্যে সম্পদ গড়ার দায়ে সোমবার সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানার একটি বাড়ি জব্দ করেছে দেশটির ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি (এনসিএ)। এর আগে ২২ মে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের ছেলে সায়ান এফ রহমানের মালিকানাধীন লন্ডনের দুটি সম্পত্তি জব্দ করেছে এনসিএ। নানামুখী পদক্ষেপের ফলে ক্ষমতাচুত্য আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম মজুমদার ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে বিদেশে শনাক্ত করা ৬২০ কোটি টাকার সম্পদও সরকারের কবজায় নিয়ে আসা হয়েছে। তারা ওইসব সম্পদ বিক্রি বা হস্তান্তর করতে পারবেন না। তবে আপাতত ভোগ করতে পারবেন।
সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদের বিদেশের মতো দেশেও সম্পদের কমতি নেই। তবে দেশের চেয়ে বিদেশি সম্পদ বেশি। দেশে অস্থাবর সম্পত্তির মধ্যে ৩৯টি ব্যাংক হিসাবের সন্ধান পাওয়া গেছে। এগুলোয় জমা ৫ কোটি ২৭ লাখ টাকা। ১০২ কোটি ৮৬ লাখ টাকার বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারের সন্ধান মিলেছে। এ খাতে মোট ১০৮ কোটি ১৩ লাখ টাকা আটক করা হয়েছে। দেশে স্থাবর সম্পদ ২৭৮ কোটি ৪০ লাখ টাকার। এর মধ্যে গুলশানে ছয়টি ফ্ল্যাটের দলিলমূলে দাম ২০ কোটি ৫০ লাখ টাকা। বাজারমূল্য ২০৫ কোটি টাকা। চট্টগ্রামের চান্দগাঁও থানা ও আনোয়ারা উপজেলায় ৩১৫ দশমিক ৯১ একর জমি রয়েছে। দলিলমূলে এর মূল্য ৩ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। স্থাবর সম্পত্তির মোট মূল্য ২৭৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা। দেশে মোট ৩৮৬ কোটি ৫৩ লাখ টাকার সম্পদ রয়েছে। বিদেশে মোট সম্পদ ৯ কোটি ৯৪ লাখ ২০ হাজার ডলার, অর্থাৎ যা ১ হাজার ২২২ কোটি ৮৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা। প্রকৃত মূল্য আরও বেশি হবে। দেশে-বিদেশে মিলে ১ হাজার ৫৯১ কোটি ৩৯ লাখ ৬০ হাজার টাকার সম্পদের সন্ধান মিলেছে। জালিয়াতি, প্রতারণা ও অন্যান্য অপরাধমূলক অভিযোগে একটি মামলা করা হয়েছে। আরও দুটি মামলা দায়েরের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।