
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং জনপরিসরে কিছু নেতাকর্মীর সাংগঠনিক শৃঙ্খলাবিরোধী কার্যক্রমের কারণে শুরুতেই কিছুটা ইমেজ সংকটে পড়েছিল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। সাংগঠনিক ধীরগতির কারণেও ভেতরে-বাইরে নানা সমালোচনা তৈরি হয়েছিল। তবে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের আন্দোলন ফের চাঙ্গা করেছে দলটিকে। ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে এবং নেতিবাচক সব মনোভাব পেছনে ফেলে এবার সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চায় তারা। দলটির নেতারা বলছেন, সারা দেশের মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর লক্ষ্যেই কাজ করছে এনসিপি। চলতি মাসেই জেলা কমিটি গঠনের কাজ শুরু এবং আগামী দুই মাসের মধ্যে জেলা-উপজেলায় কমিটিসহ নিবন্ধন সম্পন্ন করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি গণঅভ্যুত্থানের সামনের সারিতে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রনেতাদের হাত ধরে জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশ। দুই মাস পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত কোনো জেলা-উপজেলায় কমিটি গঠন করতে পারেনি তারা। ঢাকার বাইরে হয়নি বড় কোনো কর্মসূচি। এমনকি দলের গঠনতন্ত্রও প্রস্তুত হয়নি। যার ফলে কিছুটা মন্থর গতিতেই এগোনো দলটি রসদ পায় আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের আন্দোলনে। দলটির নেতাকর্মীরা বলছেন, এবার দলের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে সংগঠনের বিস্তৃতি এবং নিবন্ধন কার্যক্রম সম্পন্ন করা। আপাতত বড় কোনো আন্দোলনে যাওয়ার পরিকল্পনা নেই তাদের।
এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব কালবেলাকে বলেন, আমরা আপাতত সংগঠনের বিস্তৃতি এবং নিবন্ধন নিয়ে কাজ করছি। জেলা, উপজেলায় কমিটি গঠন আমাদের এখন প্রথম কাজ। একই সঙ্গে মৌলিক সংস্কার নিয়ে আমাদের কর্মসূচি ও আন্দোলন চলবে। সব দলের সঙ্গে ঐক্যের ভিত্তিতে আমরা মৌলিক সংস্কারগুলো করার জন্য কাজ করব। এ ছাড়া নতুন সংবিধানের জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের দাবিতে আমরা মাঠে থাকব।
দলটির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ আমাদের অন্যতম এজেন্ডা ছিল। এক্ষেত্রে একটা আন্দোলনে আমরা মোটামুটি সফল। এই চাঙ্গা ভাব নিয়েই আমরা সংগঠনটাকে মানুষের ঘরে ঘরে পোঁছাতে কাজ শুরু করেছি। সংগঠনের বিস্তৃতিই এখন অন্যতম লক্ষ্য।
চলতি মাসেই জেলা কমিটি: সাংগঠনিক গতিশীলতার স্বার্থে ৬৪ জেলাকে ১৯টি ভাগে ভাগ করেছে এনসিপি। জেলাগুলোর কমিটি গঠন করতে সাংগঠনিক টিম গঠন করেছে তারা। দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ এবং উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলমের তত্ত্বাবধানে হয়েছে এসব টিম। জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের ৩০ দিনের মধ্যে কমিটি প্রস্তাবনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে কোনো নির্দিষ্ট সাংগঠনিক ইউনিটে দায়িত্বে না থাকলেও কেন্দ্রীয় কমিটির যে কেউ দলের স্বার্থে ওই ইউনিটে তার গুরুত্বপূর্ণ মতামত প্রদান করতে পারবেন বলেও নির্দেশনা দেওয়া হয়।
কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে জেলা কমিটির সর্বনিম্ন ৩১ সদস্য থেকে সর্বোচ্চ ৫১ সদস্যে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া উপজেলা কমিটির সর্বনিম্ন ২১ সদস্য থেকে বাড়িয়ে ৪১ করা হবে। এ ছাড়া জেলা এবং উপজেলা কমিটির আহ্বায়ক নির্ধারণেও বয়স সর্বনিম্ন ৪০ বছর হতে হবে বলে এনসিপির সাধারণ সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। চলতি মাসের মধ্যেই জেলা কমিটি শুরু এবং আগামী দুই মাসের মধ্যে জেলা-উপজেলায় কমিটি গঠনের কাজ শেষ করার পরিকল্পনা এনসিপির। এরই মধ্যে কিছু জেলার কমিটির খসড়াও প্রস্তুত হয়েছে বলে জানা যায়।
দলটির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম কালবেলা বলেন, আমাদের সাংগঠনিক প্রক্রিয়া চলছে। আশা করি আগামী দুই মাসের মধ্যে বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা-উপজেলায় সাংগঠনিক কমিটি বিস্তার করতে পারব। এরপর ইউনিয়ন এবং ওয়ার্ড কমিটিগুলো হবে। এনসিপি চলতি মাস থেকে মূলত সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করেছে। একটা রাজনৈতিক দল জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন, ওয়ার্ড অতিক্রম করে ঘরে ঘরে পোঁছাতে সময় প্রয়োজন। আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী যদি কাজ করতে পারি, দ্রুতই মানুষের দোড়গড়ায় এনসিপি পৌঁছে যাবে।
আসছে একাধিক উইং: সংগঠনকে সম্প্রসারিত এবং ছড়িয়ে দিতে এনসিপি এরই মধ্যে একাধিক উইং গঠন করেছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো শ্রমিক উইং এবং স্বাস্থ্য উইং। গতকাল শুক্রবার আত্মপ্রকাশ করেছে এনসিপির যুব উইং ‘জাতীয় যুব শক্তি’। এদিন রাজধানীর গুলিস্তানের মহাসড়কে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সংগঠনটির যাত্রা শুরু করে।
এ ছাড়া নারী উইং, আইনজীবী উইং, ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স উইং গঠন নিয়েও কাজ চলছে। উইংগুলো আত্মপ্রকাশ করতে প্রস্তুতি কমিটি গঠন করেছেন এনসিপি নেতারা। মূল দলের পাশাপাশি এসব সংগঠন ভালোভাবে পরিচালনার লক্ষ্যে দায়িত্ব বণ্টন করা হচ্ছে এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতাদের।
গত মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় নাগরিক পার্টি ছাত্র সংগঠন করবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, আমাদের যুব, শ্রমিক ও নারী উইং রয়েছে। তারা সহযোগী সংগঠন হিসেবে কাজ করবে। আর ছাত্ররা স্বাধীন সংগঠন হিসেবে কাজ করবে। কোনো লেজুড়বৃত্তি থাকবে না। অবশ্য কেউ আমাদের আদর্শের সঙ্গে মিল রেখে কাজ করতে চাইলে আমরা তাদের স্বাগত জানাব।
নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিবন্ধনের প্রস্তুতি: নির্বাচন কমিশনের (ইসি) গণবিজ্ঞপ্তি গত ২০ এপ্রিল নতুন দলের নিবন্ধনের আবেদনের সময়সীমা শেষ হওয়ার তারিখ ছিল। তবে এনসিপিসহ কয়েকটি দল নিবন্ধন আবেদনের সময় বাড়াতে অনুরোধ জানিয়েছিল। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এই সময় বাড়িয়ে আগামী ২২ জুন পর্যন্ত করেছে নির্বাচন কমিশন। এনসিপি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই নিবন্ধনের আবেদন করতে চায়। এ লক্ষ্যে কাজ করছে দলটির একটি টিম। এ সময়ের মধ্যে শর্ত পূরণের চেষ্টা আছে তাদের। ইসিতে নিবন্ধিত হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক দলীয় কার্যালয় স্থাপনসহ আনুষঙ্গিক কাজের প্রস্তুতি চলছে বলে জানান তারা।
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক তাজনূভা জাবীন কালবেলাকে বলেন, আমরা নিবন্ধনের আবেদনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। গঠনতন্ত্র, লোগো, প্রতীক এসব নিয়ে কাজ চলছে। প্রতীকের বিষয়ে একটা শর্টলিস্ট হয়েছে। আমরা এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি। এর মধ্যে কমিটি গঠন এবং কার্যালয় স্থাপনের কাজও হচ্ছে। আমরা আশা করি এই মাসের মধ্যে একটা ভালো ফল পাব।
সার্বিক বিষয়ে এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন কালবেলাকে বলেন, সারা দেশের জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ের লক্ষ্যে দলকে কয়েকটি অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে এবং নেতাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আমরা আশা করি অল্প সময়ের মধ্যে কমিটি গঠনের কাজ শুরু করতে পারব। নির্বাচনে নিবন্ধনের জন্য যে শর্তগুলো পূরণ করতে হয়, সেগুলো যত দ্রুত সময়ের মধ্যে সম্ভব পূরণ করে আমরা নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করব।
তিনি বলেন, আমরা সংগঠনকে শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত সবার কাছে পৌঁছানোর লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করেছি। আমাদের নেতৃবৃন্দ গ্রাম পর্যায়ে যাচ্ছেন, মানুষের সঙ্গে কথা বলছেন, সংগঠনের নীতি-আদর্শ নিয়ে আলাপ করছেন।