
রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিল হবে কি না, সে বিষয়ে আজ সোমবার জরুরি বৈঠকে বসতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সোমবার (১২ মে) এই বৈঠক হতে পারে বলে ইসি সূত্র নিশ্চত করেছে।
জানা গেছে, সরকারের পক্ষ থেকে দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার আনুষ্ঠানিক গেজেট ইসির হাতে এলে, নিবন্ধন ইস্যুতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিতের সুপারিশ আসতে পারে বলেও গুঞ্জন রয়েছে। ইসির একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
তবে আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বিষয়ে ইসিকে তাড়াহুড়া না করার পরামর্শ নির্বাচন বিশেষজ্ঞের। এ বিষয়ে নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সদস্য আব্দুল আলিম সারাবাংলাকে বলেন, আমাদের নিবন্ধন বাতিলের যে আইন আছে তা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিলের জন্য পর্যাপ্ত আইন এখনো নেই ইসির কাছে। কারণ সরকার যদি কোনো দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে তাহলে সেই দলের নিবন্ধন বাতিলের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু সরকার আওয়ামী দলকে নয়, আওয়ামী লীগের কার্যক্রমকে নিষিদ্ধ করেছেন।
আব্দুল আলিম আরও জানান, নির্বাচন কমিশন যদি আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিল করতে চায় সেক্ষেত্রে কমিশনকে আরও অপেক্ষা করতে হৰে।
তিনি বলেন, চাইলে কমিশন আদালতের শরণাপন্নও হতে পারে। তবে ইসিকে তাড়াহুড়া করে কোনো সিদ্ধান্ত না নেওয়ার পরামর্শ দেন নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সদস্য আব্দুল আলিম।
কোনো রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিলে আইন কি বলছে?
আরপিও-এর ৯০ জ(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কী কারণে কোনো দলের নিবন্ধন বাতিল করতে পারে ইসি।
(ক) দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী কমিটি, সেটি যে নামেই অভিহিত হোক না কেন, সেই কমিটি যদি দলকে বিলুপ্ত ঘোষণা করে বা নিবন্ধন বাতিলের জন্য দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বা তাদের সমপর্যায়ের পদাধিকারী ব্যক্তি কর্তৃক দলীয় সিদ্ধান্তের কার্যবিবরণীসহ কমিশন বরাবর আবেদন করা হয়; বা
(খ) নিবন্ধিত কোনো রাজনৈতিক দল সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়; বা
(গ) এই আদেশ ও বিধিমালার অধীন কমিশনে প্রেরিতব্য কোনো তথ্য [একাদিক্রমে তিন বৎসর] প্রেরণ করতে যদি কোনো দল ব্যর্থ হয়; বা
(ঘ) কোনো রাজনৈতিক দল কর্তৃক [অনুচ্ছেদ ৯০খ এর দফা (১)(খ)] এর কোনো বিধান লঙ্ঘন করা হয়; বা
(ঙ) কোনো রাজনৈতিক দল পরপর দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে; তাহলে সংশ্লিষ্ট দলের নিবন্ধন বাতিল করতে পারে ইসি।
অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এক্ষেত্রে আরপিও-এর ৯০জ অনুচ্ছেদের (১)(খ) দফা অনুযায়ী, সরকারের নিষেধাজ্ঞা আলোকে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধি করতে পারে ইসি।
এ ছাড়াও কমিশন থেকে চাহিদা মোতাবেক কোনো তথ্য পরপর তিন বছর কোনো দল না দিতে পারলে; ২০৩০ সালের মধ্যে দলের সকল স্তরের ৩৩ শতাংশ নারী সদস্য পদ পূরণ করতে না পারলে; শিক্ষক, ছাত্র, আর্থিক, বাণিজ্যিক বা শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বা সংস্থার কর্মচারী বা শ্রমিকদের বা অন্য কোনো পেশার সদস্যদের সমন্বয়ে সহযোগী বা অঙ্গ সংগঠন করলে প্রভৃতি কারণে সংশ্লিষ্ট নিবন্ধন বাতিল করতে পারে ইসি।
সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষণার জন্য কোনো শুনানির প্রয়োজন নেই। তবে অন্য কোনো কারণে নিবন্ধন বাতিল করতে হলে সংশ্লিষ্ট দলকে শুনানির সুযোগ দেওয়ার বিধান রয়েছে আইনে। এ ছাড়া নিবন্ধন বাতিল হলে সংশ্লিষ্ট নামে অন্য কোনো দল আর পরবর্তী নিবন্ধন পাবে না এবং নিবন্ধন বাতিলের গেজেট প্রকাশ হলে ইসির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করা যাবে।
প্রসঙ্গত, ছাত্র-জনতা ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) টানা আন্দোলনের পর গত শনিবার (১০ মে) রাতে অন্তর্বর্তী সরকার এক জরুরি বৈঠকে আওয়ামী লীগের সকল রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
সেই বৈঠকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধন অনুমোদন পায়। সংশোধনী অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এখন রাজনৈতিক দল কিংবা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিচার করতে পারবে এবং শাস্তির আওতায় আনতে পারবে।
সরকারি সিদ্ধান্তে বলা হয়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত, আওয়ামী লীগ, তাদের অঙ্গসংগঠন এবং ঘনিষ্ঠ সমর্থক গোষ্ঠীর সকল কার্যক্রম সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় নিষিদ্ধ থাকবে। এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় সাইবার জগতে তাদের কর্মকাণ্ডও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
সরকারি ব্যাখ্যায় আরও বলা হয়, এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে মূল উদ্দেশ্য, জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষা, জুলাই আন্দোলনের কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, এবং ট্রাইব্যুনালের বাদী ও সাক্ষীদের সুরক্ষা।
এ নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, সরকারের সিদ্ধান্তের গেজেটটা হলে আমরা কমিশন বৈঠক করব। আমি একা তো সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। এটার আইন আছে সরকার কোনো দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করলে কী করতে হবে। গেজেটটা হোক, কমিশনের সংখ্যাগরিষ্ট সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
তিনি আরও বলেছিলেন, আমরা কেবল নিবন্ধন বাতিল করতে পারি। কার্যক্রম নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে সরকার। কাজেই গেজেটটা পেলেই আমরা বৈঠকে বসব। এজন্য সরকার থেকে ইসিতে কোনো নির্দেশনার প্রয়োজন হবে না।
উল্লেখ্য, বর্তমানে ইসিতে নিবন্ধিত দলের সংখ্যা ৫০টি। নিবন্ধন প্রথা চালু হয়, নবম সংসদ নির্বাচনের আগে ২০০৮ সালে। এ পর্যন্ত ৫৫টি দল ইসির নিবন্ধন পেলেও পরবর্তীতে শর্ত পূরণ, শর্ত প্রতিপালনে ব্যর্থতা এবং আদালতের নির্দেশে পাঁচটি দলের নিবন্ধন বাতিল করে ইসি। দলগুলো হলো,জামায়াতে ইসলামী, ফ্রিডম পার্টি, ঐক্যবদ্ধ নাগরিক আন্দোলন, পিডিপি ও জাগপা।