
বৈষম্যের বিরুদ্ধে রাজপথে নেমেছিল লাখো ছাত্র-জনতা। তাদের দাবি ছিল দুর্নীতি বন্ধ হোক, বৈষম্যের অবসান হোক এবং সবার জন্য একটি ন্যায়সঙ্গত সমাজ গড়ে উঠুক। অনেকেই ভেবেছিলেন ক্ষমতার পটপরিবর্তনের মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। কিন্তু কয়েক মাসের ব্যবধানে সেই আশার আলো যেন ম্লান হয়ে যাচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে বৈষম্যবিরোধী সরকারের বৈষম্যমূলক নানা কর্মকাণ্ড নিয়ে।
সম্প্রতি দুটি ঘটনা নিয়ে তীব্র সমালোচনা তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক মহলসহ সব ক্ষেত্রে। বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য এবং নীলফামারী-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য প্রকৌশলী শাহরিন ইসলাম চৌধুরী তুহিনকে বিগত সরকারের দেওয়া রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলায় কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এবং একই ধরনের মামলায় জামায়াত নেতা ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহেরকে ‘ক্লিন শিট’ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া এরকম অসংখ্য মামলা রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যাহার করেছে সরকার। কিন্তু জিয়া পরিবারের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হওয়ায় প্রকৌশলী তুহিনের জামিন নামঞ্জুর করে আটকাদেশ দিয়েছেন আদালত এমনটাই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এই ঘটনা বৈষম্যের উৎকৃষ্ট উদাহরণ।জানা যায়, সরকারের আইন মন্ত্রণালয় এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রকৌশলী তুহিনের মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করে প্রধান উপদেষ্টার দফতরে পাঠানো হলেও কোনো এক অজানা কারণে সেই ফাইল পড়ে রয়েছে। বিএনপি সংশ্লিষ্টদের দাবি, প্রধান উপদেষ্টার দফতরে দুই কর্মকর্তা প্রকৌশলী তুহিনের মামলা সংক্রান্ত ফাইল প্রধান উপদেষ্টার কাছে উপস্থাপন করছেন না।
অন্যদিকে, বরিশাল সিটি করপোরেশনের (বিসিসি) মেয়র ঘোষণার দাবিতে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীমের করা মামলার আবেদন খারিজ করে দেওয়ার বিষয়টিও সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। দলটির অভিযোগ ৫ আগস্ট-পরবর্তী দেশের অন্যান্য সিটি করপোরেশনে কারচুপি ও আওয়ামী লীগের সাজানো ভোটে পরাজিত কয়েকজন প্রার্থীকে মেয়র ঘোষণা করা হলেও বরিশালে তা করা হয়নি। যা পুরোপুরি বৈষম্য বলে মনে করছেন তারা। এমনকি মুফতি ফয়জুল করীমের করা মামলা খারিজ করার পর সাধারণ মানুষের মাঝেও তৈরি হয়েছে তীব্র ক্ষোভ। তাদের ভাষ্য, হাসিনা সরকারের সময়ে সবচেয়ে আলোচিত সিটি কপোরেশন নির্বাচন ছিল বিসিক নির্বাচন। এ নির্বাচনের ইসলামী আন্দোলনের ‘হাত পাখা’ প্রতীকে অংশ নেওয়া প্রার্থী দলটির জ্যৈষ্ঠ নায়েবে আমির ভোট কারচুপি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হামলায় রক্তাক্ত হন। যা দেশের গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার হয়েছিল। জুলাই গণঅভ্যুত্থানেও তিনি ছিলেন সম্মুখসারির নেতৃত্ব। তার মামলা বিবেচনা না নিয়ে আদালতের রায়ে খারিজ করে দেওয়াটা বৈষম্য সৃষ্টি করেছে।
এ ছাড়া রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও আদালতের এমন সিদ্ধান্তকে বৈষম্যমূলক বলে আখ্যা দিচ্ছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষক উইং কমান্ডার এম. সালাহউদ্দিন চৌধুরী (অব.) খোলা কাগজকে বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার এবং আদালতের বেশ কিছু সিদ্ধান্ত আমাদের নজরে এসেছে, যা খুবই বৈষম্যমূলক বলে মনে হয়েছে। বিশেষ করে প্রকৌশলী শাহরিন ইসলাম চৌধুরী তুহিনকে যে মামলায় কারাগারে পাঠানো হয়েছে, একই ধরনের মামলায় অন্যান্য দলের নেতাকর্মীরা ‘ক্লিন শিট’ পেয়েছেন। আবার শেখ হাসিনার আমলে নির্বাচনে অংশ নিয়ে ভোট-কারচুপি কারণে পরাজিত হওয়া কয়েক প্রার্থীকে ৫ আগস্ট-পরবর্তী মেয়র ঘোষণা করলেও বরিশালে তা হয়নি। এটা অনুচিত, এমন বৈষম্য সৃষ্টি করা কাম্য নয়।’
তিনি বলেন ‘যে সরকারের জন্মই বৈষম্য ও দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে, তাদের কাছ থেকে এ ধরনের বৈষম্যমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণ সাধারণ মানুষের প্রত্যাশার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।’
জানতে চাইলে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান খোলা কাগজকে বলেন, ‘একই ধরনের মামলার রায়ে ইতোমধ্যে তিনজনকে মেয়র ঘোষণা করা হলেও, আমাদের প্রার্থীর মামলাটি আদালত খারিজ করে দিয়েছেন। অথচ, এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কর্মীরা তাকে (ফয়জুল করীম) রক্তাক্ত করেছে, তিনি আহত হয়েছেন। যা বিভিন্ন গণমাধ্যমেও প্রচার হয়েছে। কিন্তু এসব বিষয় আমলে না নিয়ে আদালত মামলাটি খারিজ করে দেয়। যা আমাদের সঙ্গে অবিচার করা হয়েছে।’ বিষয়টি নিয়ে উচ্চতর আদালতে আপিল করবেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘যদিও সরকার এটাকে আদালতের বিষয় বলছে, তবে আমরা দেখছি মামলা চলাকালীন সময়ে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজিব ভূঁইয়া মন্তব্য করেছেন ‘হাসিনার আমলে প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থীর আদালতের রায়ের মাধ্যমে পদে বসাকে সমর্থন করে না স্থানীয় সরকার’, সুতরাং তার এই মন্তব্যকে আমরা মনে করছি স্থানীয় সরকারের প্রধান হিসেবে অবশ্যই তিনি আদালতের রায়কে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে।”
এদিকে আদালত বিএনপির সেকেন্ড হোম হয়ে গেছে উল্লেখ করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার বিরুদ্ধে অনেক মামলা ছিল, সব প্রত্যাহার করা হয়েছে। অথচ তাকে প্রায়ই আদালতে যেতে হচ্ছে। সোমবার জাতীয় প্রেসক্লাবে বাংলাদেশ পেশাজীবী জোট আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, ‘আদালত এখন আমাদের সেকেন্ড হোম হয়ে গেছে। আমাদের প্রায়ই কোর্টে যেতে হয়। প্রধান উপদেষ্টার বিরুদ্ধেও অনেক মামলা ছিল, আমরা তখন তার পক্ষে প্রতিবাদ করেছিলাম। এখন তিনি সব মামলা প্রত্যাহার করে চেয়ারে বসে আছেন, অথচ আমি গয়েশ্বর এখনো কোর্টে হাজিরা কেন দিচ্ছি?’
প্রসঙ্গত, বরিশাল সিটি করপোরেশনের (বিসিসি) মেয়র ঘোষণার দাবিতে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম মামলা করলে তার আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন নির্বাচনি ট্রাইব্যুনাল। গতকাল সোমবার দুপুরে পূর্ব নির্ধারিত দিনে আদালতে শুনানিতে অংশ নেন ফয়জুল করীমের আইনজীবীরা। শুনানি শেষে বরিশাল সিটি নির্বাচনি ট্রাইব্যুনালের বিচারক ও সিনিয়র সহকারী জজ হাসিবুল হাসান আবেদন খারিজের আদেশ দেন। ফয়জুল করীমের পক্ষে মামলায় অংশ নেওয়া আইনজীবী শেখ নাসির উদ্দিন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেছেন, আমরা এ আদেশ চ্যালেঞ্জ করে আপিল ট্রাইব্যুনালে যাব।
মামলার আবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল, ২০২৩ সালের ১২ জুন বিসিসি নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ওই নির্বাচনে এক নম্বর প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে আবুল খায়ের আবদুল্লাহ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। নির্বাচনে ভোট গ্রহণকালে নগরীর ২২ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেরা খাতুন মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র পরিদর্শনে গেলে সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীমের ওপর হামলা চালান আওয়ামী লীগের প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকরা। এতে তিনি রক্তাক্ত জখম হয়েছিলেন।
একই সঙ্গে নগরীর ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের জাগুয়া কলেজ কেন্দ্র থেকে ইসলামী আন্দোলন প্রার্থীর এজেন্টকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। এসব বেআইনি কর্মকাণ্ড চালিয়ে দরখাস্তকারীকে (ফয়জুল করীম) প্রাপ্ত ভোটের চেয়ে কম দেখিয়ে (৩৩ হাজার ৮২৮ ভোট) পরাজিত দেখানো হয়। এক নম্বর প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবুল খায়ের আবদুল্লাহকে ৮৭ হাজার ৮০৮ ভোট দেখিয়ে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছিল। আবেদনে নির্বাচনি ফল বাতিল করে সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীমকে মেয়র হিসেবে ঘোষণা করার আদেশ দেওয়ার জন্য আবেদন করা হয়েছিল।