Image description

প্রধানমন্ত্রী এবং নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা কমতে পারে– এমন সুপারিশে একমত হয়নি বিএনপি। জাতীয় নির্বাচনের ভোটের অনুপাতে সংসদের উচ্চকক্ষে আসন বণ্টন এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমাতে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনেও রাজি হয়নি তারা। 

প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এ দুই সুপারিশকেই ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিতের প্রধান চাবিকাঠি আখ্যা দিয়েছে। কমিশনের সঙ্গে তিন দিনের আলোচনায় বিএনপি তার অবস্থান বদল করেনি। যেসব সুপারিশে দলটি একমত হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নে পরবর্তী সংসদে বিশদ আলোচনার প্রয়োজন বলেও মতামত দিয়েছে।

অতীতে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে এ বি এম খায়রুল হককে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের নজির থাকলেও বিএনপি আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম তিন বিচারপতির মধ্য থেকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগসহ বিভিন্ন প্রস্তাব করেছে গতকাল মঙ্গলবারের বৈঠকে। এর মাধ্যমে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে দলটির সঙ্গে প্রথম পর্যায়ের সংলাপ শেষ হয়েছে।

 

বিএনপি ভোটের অনুপাতে উচ্চকক্ষ ও এনসিসি গঠনে রাজি না হওয়ায় কমিশন সদস্যরা হতাশা জানিয়েছেন বলে বৈঠক সূত্র সমকালকে জানিয়েছে। বৈঠকে তারা বিএনপি নেতাদের বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ব্যর্থ হবে যদি সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য নিশ্চিত করা না যায়। হাজারের বেশি মানুষের আত্মত্যাগ ব্যর্থ হবে। জবাবে বিএনপি নেতারা বলেছেন, অতীতের স্বৈরাচারের সঙ্গে তুলনা করলে ভুল হবে। বিএনপি গণতান্ত্রিক সরকার গঠন করবে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রধানমন্ত্রী ও নির্বাহী বিভাগের হাতে প্রয়োজনীয় ক্ষমতা থাকতে হবে।

বিএনপির প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। বৈঠক শেষে তিনি বলেছেন, আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক পথ খোলা আছে। কমিশন সময় নির্ধারণ করে আমন্ত্রণ জানালে বিএনপি আরও আলোচনার জন্য প্রস্তুত। বিএনপিই প্রথম দল, যারা সংস্কারের কথা বলেছে। বিএনপি সংস্কার চায়। সংস্কারে সহযোগিতা করছে।

ঐকমত্য কমিশনে সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করা প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার সমকালকে বলেন, প্রথম পর্যায়ের সংলাপে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে যেসব মতামত ও প্রস্তাব পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলো যাচাই এবং একত্রীকরণের পর সিদ্ধান্ত হবে, দ্বিতীয় পর্যায়ের সংলাপ কীভাবে হবে। তিনি জানান, বিএনপির সঙ্গে প্রথম পর্যায়ের সংলাপ শেষ হয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সংলাপের সময় পরিবর্তন হয়েছে। আগামী শনিবার দলটির সঙ্গে বৈঠক শুরু করবে ঐকমত্য কমিশন। 

বিএনপি যেসব প্রস্তাব করেছে
গতকাল বেলা ১১টায় সংসদ ভবনে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে বিএনপির সঙ্গে বৈঠক শুরু হয়। মধ্যাহ্ন বিরতি দিয়ে তা চলে সন্ধ্যা পৌনে ৭টা পর্যন্ত। এর আগে ১৭ ও ২০ এপ্রিলও ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে দিনব্যাপী বৈঠক করেছিল বিএনপি। আগের দুই দিন সংবিধান সংস্কারের ৭০ সুপারিশের ৬২টি এবং বিচার বিভাগ সংস্কারের তিন সুপারিশ নিয়ে আলোচনা হয়। গতকাল সংবিধানের বিচার বিভাগ-সংক্রান্ত সুপারিশ নিয়ে আলোচনা হয় বৈঠকের প্রথম পর্বে। দ্বিতীয় পর্বে জনপ্রশাসন, দুদক এবং নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার নিয়ে আলোচনা হয়। 

গতকালের বৈঠকে বিএনপি প্রস্তাব করে, আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম তিন বিচারপতির মধ্য থেকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করা হবে। প্রধানমন্ত্রী একই সঙ্গে দলীয় প্রধান এবং সংসদ নেতা হতে পারবেন না বলে যে সুপারিশ কমিশন করেছে, তাতে একমত হয়নি তারা। তবে বিচারপতি নিয়োগ সরকারের প্রভাবমুক্ত করতে জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কমিশন গঠনের প্রস্তাবে একমত হয়েছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় পৃথক সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় গঠন, অধস্তন আদালতকে স্থানীয় আদালতে রূপান্তর করে প্রধান বিচারপতির নিয়ন্ত্রণে রাখার সুপারিশেও ঐকমত্য জানিয়েছে দলটি।

প্রস্তাবিত স্থানীয় আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলার জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের আদলে ন্যাশনাল জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব করেছে বিএনপি। বিচারপতি এবং বিচারকদের অপসারণে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ও ন্যাশনাল জুডিশিয়াল কাউন্সিলে দুর্নীতির বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা এবং অভিযোগকারীর অভিযোগ আমলে নেওয়ার বিধানের প্রস্তাব করেছে তারা। দলটি হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ বিভাগীয় পর্যায়ে স্থাপনের সুপারিশে রাজি হয়নি।

 

 

 

জ্যেষ্ঠ বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমানকে ডিঙিয়ে ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে খায়রুল হককে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি। পদত্যাগ করেন শাহ নাঈম। খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ পরের বছরের মে মাসে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেন। বহুল আলোচিত এ রায়ের নজির দিয়ে আওয়ামী লীগ দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিধান করে। ফল স্বরূপ পরবর্তী তিনটি বিতর্কিত নির্বাচন হয়। 

এমন নজির থাকার পরও বিএনপি কেন জ্যেষ্ঠতম তিন বিচারপতি থেকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের প্রস্তাব করেছে– এ প্রশ্নে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কমিশন গঠন হলে বিচারপতি নিয়োগ সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। ফলে ফ্যাসিস্ট সরকার যেভাবে দলীয় অনুগত বিচারপতি নিয়োগ করেছিল, বিএনপির গণতান্ত্রিক সরকার তা করবে না।

এর আগে মধ্যহ্ন বিরতিতে সালাহউদ্দিন বলেন, ‘জ্যেষ্ঠতম বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের সুপারিশ করেছে বিচার ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। এতে দ্বিমত জানিয়েছে বিএনপি। রাষ্ট্রে আগে কিছু অসংগতি দেখা গেছে বলে সর্বক্ষেত্রে যদি নির্দিষ্ট করে দিই, তা রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর হবে না। অন্তত একটি বিকল্প থাকা উচিত। বিএনপির প্রস্তাব এখনও গৃহীত হয়নি, এখনও আলোচনা চলছে। নেসেসিটি মেকস ল (প্রয়োজন আইন তৈরি করে)। ডকট্রিন অব নেসেসিটি বিবেচনা রেখেই কিছু অপশন রাখা দরকার। না হলে রাষ্ট্র এমন কোনো ব্যক্তির হাতে পড়ে যাবে, যা রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর হবে না।’

কমিশন বিচারপতিদের অবসরের বয়স ৭০ বছর নির্ধারণের সুপারিশ করেছে। এতে দ্বিমত জানিয়ে বিএনপি বলেছে, এ নিয়ে বিশদ আলোচনা প্রয়োজন। কারণ রাষ্ট্রের অন্যান্য কর্মবিভাগ থেকেও এমন দাবি উঠতে পারে।

প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা খর্বে ‘না’ 
কমিশন প্রস্তাব করেছে, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা সরকার পরিচালনা করবে। এতে রাজি নয় বিএনপি। সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা কর্তৃক সরকার পরিচালিত হলে প্রধানমন্ত্রীর কর্তৃত্ব থাকে না। 

তবে রোববার মুলতবি হওয়া বৈঠকে কমিশন প্রস্তাব করেছিল, এক ব্যক্তি সর্বোচ্চ তিনবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন। টানা দুইবার দায়িত্ব পালনের বিরতি দিয়ে আবার প্রধানমন্ত্রী হওয়া যাবে– এ বিষয়ে বিএনপি সেদিন জানিয়েছিল, দলীয়ভাবে আলোচনা করে তারা মত দেবে। সালাহউদ্দিন আহমেদ গতকাল বলেন, বিকল্প প্রস্তাবের জন্য অপেক্ষা করুন। আর কমিশনও প্রস্তাবটি আনুষ্ঠানিকভাবে দেয়নি।

সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, একজন ব্যক্তি যাতে প্রধানমন্ত্রী, দলীয় প্রধান এবং সংসদ নেতা পদে না থাকেন, এ নিয়ে আলাপ হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদীয় দলের সিদ্ধান্তে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। এটা জরুরি নয়– দলের প্রধান প্রধানমন্ত্রী হবেন। কিন্তু সুযোগ রাখা উচিত। আর প্রধানমন্ত্রী যিনি হবেন, তিনিই সংসদ নেতা হবেন। এটাই রীতি। কোনো কোনো দেশে পৃথক সংসদ নেতার নজির রয়েছে। কিন্তু সেখানে সংসদ নেতার নির্বাহী ক্ষমতা নেই। বাংলাদেশে সংসদ নেতা এবং প্রধানমন্ত্রী অনেকটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। 

রাষ্ট্রপতির অভিশংসনে সংসদের উভয় কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন, ন্যায়পাল নিয়োগে একমত হয়েছে বিএনপি। সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য বিএনপির অঙ্গীকার। 

প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়াই রাষ্ট্রপতি কী কী কাজ করতে পারবেন– এ সংক্রান্ত প্রস্তাব দেওয়ার কথা বলেছে বিএনপি। সালাহউদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেছেন, নির্বাচিত সংসদে আলোচনার মাধ্যমে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।

আগের দিনের মতো গতকালও সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, মানবাধিকার কমিশন, দুদক, প্রস্তাবিত স্থানীয় সরকার কমিশনকে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে রূপ দিতে রাজি নয় বিএনপি। সব প্রতিষ্ঠানকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হলে জটিলতা বাড়বে। 

আনুপাতিক উচ্চকক্ষ এবং এনসিসিতে ঘোর আপত্তি
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, উচ্চকক্ষ তথা সিনেট গঠন এবং সংবিধান সংশোধনে উভয় কক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থনের সুপারিশে বিএনপি একমত। কিন্তু কীভাবে সিনেট গঠিত হবে, তা আগামী সংসদে আলোচনা করে ঠিক করা হবে। 

বৈঠক সূত্র সমকালকে জানায়, বিএনপি আবারও বলেছে, বিদ্যমান পদ্ধতিতে যেভাবে সংরক্ষিত নারী আসন বণ্টন হয়, সেভাবেই উচ্চকক্ষে আসন বণ্টন চায় বিএনপি। এ অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে কমিশন সদস্যরা বলেন, উচ্চকক্ষ আনুপাতিক না হলে সংবিধান পরিবর্তনের যথেচ্ছাচার বন্ধ হবে না। অভ্যুত্থানও সফল হবে না। বিএনপি নেতারা তখন বলেন, সংসদে এ বিষয়টি ঠিক করা উত্তম হবে।

সংবিধান সংশোধনে গণভোটের বিধানে রাজি হয়নি বিএনপি। রাজি নয় এনসিসি গঠনেও।

সালাহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, যখন সংসদ থাকবে না, সেই সময়ে এনসিসির পাঁচ সদস্যের চারজনই থাকবেন অনির্বাচিত। সংবিধানের মূল নির্যাস হলো, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির শাসন।

একই যুক্তি দিয়ে শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছিলেন। এর পাল্টা হিসেবে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’র কারণে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার সবাই মেনে নিয়েছে। 

আপিল বিভাগের রিভিউয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরবে বলে আশাবাদী বিএনপি। এ কথা জানিয়ে সালাহউদ্দিন বলেন, যদি বিচার বিভাগকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার থেকে দূরে রাখা যায়, তাহলে বিকল্প প্রস্তাব নিয়ে ভাবা যাবে। 

সালাহউদ্দিন বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারে উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ১৪ জন; প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করলে উপদেষ্টামণ্ডলী থেকে একজনকে নির্বাচিত করা– এসব সুপারিশে বিএনপি একমত।

স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে এমপিদের না রাখার বিষয়ে বিএনপি নীতিগতভাবে একমত হলেও এ নিয়ে সংসদে আলোচনার দাবি রাখে বলে মন্তব্য করেন সালাহউদ্দিন। 

বৈঠকে ছিলেন কমিশন সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, ইফতেখারুজ্জামান, বিচারপতি এমদাদুল হক, সফর রাজ হোসেন। বিএনপির পক্ষে আরও ছিলেন চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইসমাইল জবিউল্লাহ, রুহুল কুদ্দুস কাজল ও সাবেক সচিব আবু মো. মনিরুজ্জামান খান।