
জুলাই-আগস্টে রাজধানীর চাঁনখারপুলে ছাত্র-জনতাকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যার ঘটনায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা পড়েছে। আশুলিয়ায় গুলি করে ছাত্রহত্যার পর লাশ পুড়িয়ে মারার ঘটনার খসড়া প্রতিবেদনের চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। কয়েকশ ক্রসফায়ার আর গুমের ঘটনায়ও শেখ হাসিনার সম্পৃক্ততার প্রমাণ মিলেছে। সব মিলিয়ে ট্রাইব্যুনালে ফ্যাসিস্ট হাসিনার আনুষ্ঠানিক বিচার কার্যক্রম শুরু এখন সময়ের অপেক্ষা মাত্র।
ব্যাপক গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট পালিয়ে যায়। কিন্তু তার আগে হাসিনার নির্দেশনায় দেশজুড়ে ব্যাপক গণহত্যা এবং গুম-খুনের মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়। শত শত আয়নাঘরে বছরের পর নির্যাতনের ঘটনা বেরিয়ে আসে। দাবি উঠেছে, ফ্যাসিস্ট হাসিনাসহ তার চিহ্নিত দোসরদের দ্রুত বিচারের।
ট্রাইব্যুনালে হাসিনার বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
সেপ্টেম্বরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ঘোষণার পর অক্টোবরের ১৭ তারিখ হতে এর আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়। এরপর থেকে সারা দেশ থেকে শত শত গুম-খুনসহ নানা ধরনের অভিযোগ আসা শুরু হয় ট্রাইব্যুনালে। সব অভিযোগের গুরুত্ব বিবেচনা করে সাড়ে ৩০০ অভিযোগ আমলে নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৩৯টি অভিযোগ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তদন্ত শুরু করা হয়। আর এখন পর্যন্ত মামলা দায়ের করা হয়েছে ২২টি। যাতে পলাতক ফ্যাসিস্ট হাসিনাসহ ১৪১ জন প্রধান দোসরকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে মোট ৫৪ জনকে; কিন্তু হাসিনাসহ ৮৭ জন পলাতক রয়েছেন।
প্রসিকিউশন সূত্র জানায়, ট্রাইব্যুনালের সবগুলো অভিযোগে প্রধান অভিযুক্ত শেখ হাসিনা। সঙ্গে রয়েছে তার পুরো বাহিনী। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের নিয়ম অনুসারে অভিযোগগুলোতে আলাদা আলাদা করে অভিযোগ বা মামলা না করে পুরো বিষয়ে সুপিরিয়র কমান্ডার হিসেবে শেখ হাসিনাকে রাখা হয়েছে। এ জন্য শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সব মিলিয়ে দুটি মামলা করা হয়েছে। একটি গুম-খুন; অপরটি মানবতাবিরোধী অপরাধ।
চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম আমার দেশকে বলেন, চাঁনখারপুল, আশুলিয়া, যাত্রাবাড়ী, রামপুরা, উত্তরা, নরসিংদীসহ সারা দেশের সব অভিযোগ-মামলায় প্রাথমিকভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও ফ্যাসিস্ট আ.লীগ নেতাকর্মীদের আসামি করা হয়েছে। কিন্তু আদতে সবগুলো নৃশংসতা ও হত্যার মাস্টারমাইন্ড সুপিরিয়র কমান্ডার শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনাই চূড়ান্তভাবে সবগুলো হতাহতের ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত।
ইন্টারপোলে রেড অ্যালার্ট
ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলেও মানবতাবিরোধী অপরাধে তার রক্ষা নেই। আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের নিয়ম অনুসারে ভারতে পলাতক শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ইন্টারপোলে রেড নোটিস জারি করতে আনুষ্ঠানিক অনুরোধ করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, তথ্যমন্ত্রী হাসান মাহমুদ, জাহাঙ্গীর কবির নানকসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলে নোটিস জারি করতে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
ইন্টারপোলে রেড নোটিসের তালিকার অন্যরা হলেন সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, সাবেক মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা তারেক আহমেদ সিদ্দিক। তবে ট্রাইব্যুনালের নিয়ম অনুসারে পলাতক থাকলেও শেখ হাসিনাসহ আসামিদের বিচার ও দণ্ডাদেশে এই আদালতের কোনো বাধা নেই।
কবে শুরু হচ্ছে শেখ হাসিনার বিচার
শেখ হাসিনা ও তার মাস্টারমাইন্ডদের বিরুদ্ধে দায়ের করা প্রধান চার মামলার একটির তদন্ত রিপোর্ট গতকাল সোমবার দেওয়া হয়েছে। বাকি তিনটির সবগুলোর তদন্ত কার্যক্রম প্রায় শেষ। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামিম জানান, আগামী সপ্তাহে আশুলিয়ায় ছাত্রদের লাশ পোড়ানোর মামলাটিরও চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হবে। রামপুরায় কার্নিশে গুলির ঘটনারও সাক্ষ্য-প্রমাণ প্রস্তুত।
তাহলে শেখ হাসিনার বিচার প্রক্রিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে কখন শুরু হচ্ছে- এ প্রশ্নের উত্তরে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম আমার দেশকে বলেন, সার্বিক বিচারে আশা করা যায় মে মাসের শেষদিকে অথবা জুনের শুরুতে শেখ হাসিনার বিচার প্রক্রিয়া পুরোদমে শুরু হয়ে যাবে। আর একটি মামলার যেহেতু প্রতিবেদন জমা হয়ে গেছে, তাই এ মামলাটির বিচারও শিগগিরই শুরু হবে প্রসিকিউশন আদালতে ডকুমেন্ট জমা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। কারণ, ইতোমধ্যে প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থার কাছে জুলাই গণহত্যা, গুম-খুনের শত শত ফরেনসিক ও ডকুমেন্টেড-প্রমাণ চলে এসেছে।