Image description

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের নেই কোনো সন্তান। এর জন্য বড় ভাই আলী আশরাফের ছেলে মইনুল হোসেন বিপ্লবকে ছেলে সম্বোধন করতেন তিনি। ছোট বেলা থেকে বিপ্লবকে নিজের সন্তান পরিচয়ে মানুষ করেছেন তোফায়েল। চাচার প্রশ্রয় পেয়ে একপর্যায়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেন বিপ্লব। সাবেক মন্ত্রীর ক্ষমতার জোরে বনে যান জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। হয়ে উঠেন গোটা ভোলার মূর্তিমান আতঙ্ক।

চাচা তথা পালক বাবার প্রভাবে বেপরোয়া বিপ্লব জেলাজুড়ে আতঙ্ক ছড়ানোর পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেন সব সরকারি দপ্তরের ঠিকাদারি। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে চাঁদাবাজিসহ আরও নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। একপর্যায়ে বিপ্লবের কথার বাইরে গাছের পাতা না নড়ার মতো পরিস্থিতিও হয় ভোলায়।

শুধু বিপ্লবই নয়, তার বড় ভাই আলী আজম মুকুলকেও রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন তোফায়েল। দলীয় মনোনয়ন এনে তাকে করা হয় ভোলা-২ আসনের এমপি। বর্তমানে অবশ্য তিনি হত্যাসহ একাধিক মামলায় গ্রেফতার হয়ে জেলে আছেন।

সম্প্রতি বিপ্লব ও তার স্ত্রী ইসরাত জাহান বিন্তির নামে প্রায় ৩৪ কোটি টাকার সম্পদ থাকার তথ্য পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন। এর মধ্যে প্রায় সোয়া ১২ কোটি টাকার সম্পদের কোনো বৈধ উৎস না থাকায় স্বামী-স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুটি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

৫ আগস্টের আগে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী বিপ্লব বর্তমানে পলাতক রয়েছেন। তার স্ত্রী সাবেক বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী একেএম শাহজাহান কামালের কন্যা বিন্তিও আছেন আত্মগোপনে।

আওয়ামী লীগের আমলে বেপারোয়া অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হওয়া বিপ্লব দম্পত্তির অবৈধ সম্পদের সন্ধানে সম্প্রতি তদন্তে নামে দুদক। প্রাথমিক অনুসন্ধানে জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাটসহ বিপুল সম্পদের মালিকানা থাকার প্রমাণও মেলে বিপ্লব ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিভিন্ন সময়ে আয়কর নথিতে দেওয়া তথ্যে মাত্র কয়েক বছরে ৭৪ কোটি ৯৯ লাখ ৯ হাজার ৯৪৫ টাকা আয়ের তথ্য দেন বিপ্লব। এর মধ্যে রেমিট্যান্স, ভুয়া ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, গাড়ি বিক্রি ও মাছ চাষ খাতে দেখানো হয় ২৯ কোটি ৫৩ লাখ ৩৬ হাজার ৭৩৯ টাকার আয়। তবে দুদকের তদন্তে এর পুরোটাই ভুয়া বলে প্রমাণ মিলেছে। এসব আয়ের পক্ষে কোনো দালিলিক প্রমাণ মেলেনি দুদকের অনুসন্ধানে। বারবার নোটিশ দেওয়ার এসব আয়ের পক্ষে কোনো যৌক্তিক প্রমাণও দাখিল করতে পারেনি এ দম্পতি।

রোববার ভোলা বিশেষ জজ আদালতে দাখিল হওয়া দুদকের মামলার নথিপত্র সূত্রে জানা গেছে, দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুসন্ধানে ৪১টি দলিলে মোট ১৩ কোটি ৬ লাখ ৮৯ হাজার ৯৯৮ টাকার ভবন, ফ্ল্যাট এবং জমির সন্ধান মিলেছে বিপ্লবের। এর মধ্যে রয়েছে রাজধানীর বনানীতে বাড়ি ও ফ্ল্যাট। এছাড়া বিভিন্ন ব্যবসায় বিনিয়োগ, শেয়ার ও ব্যাংকে স্থায়ী আমানতে মিলেছে ২০ কোটি ৬৩ লাখ ৪৮ হাজার ৮৩৬ টাকার সন্ধান। এই মোট ৩৩ কোটি ৭০ লাখ ৩৮ হাজার ৮৩৪ টাকার সম্পদের বিপরীতে বিপ্লবের বৈধ আয় পাওয়া গেছে ৪৫ কোটি ৪৫ লাখ ৭৩ হাজার ২২৫ টাকা। আলোচ্য সময়ে তার জীবন নির্বাহে ব্যয় হওয়া ২৩ কোটি ৫১ লাখ ৭ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা বাদ দেওয়ার পর অবশিষ্ট থাকে ২১ কোটি ৯৪ লাখ ৬৫ হাজার ৮১৯ টাকা। অথচ তার মোট সম্পদের পরিমাণ ৩৩ কোটি ৭০ লাখ ৩৮ হাজার ৮৩৪ টাকা। এ হিসাবে মোট ১১ কোটি ৭৫ লাখ ৭৩ হাজার ১৫ টাকার সম্পদের কোনো বৈধ উৎস তার নেই। একইভাবে তার স্ত্রী ইসরাত জাহান বিন্তির মালিকানায় পাওয়া গেছে ৩৯ লাখ ৪২ হাজার ৭৭২ টাকার অবৈধ সম্পদ।

আদালত সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, অবৈধ সম্পদ অর্জনের এসব অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪-এর ২৭ ধারার ১ উপধারা অনুসারে বিপ্লব এবং একই ধারার ২ উপধারা অনুসারে বিন্তির বিরুদ্ধে দুটি মামলা করেছেন কমিশনের সহকারী পরিচালক খোন্দকার কামরুজ্জামান। এদের বিরুদ্ধে আরও কোনো অবৈধ সম্পদের তথ্য পাওয়া গেলে তা তদন্ত রিপোর্টে দাখিল করা হবে উল্লেখ করা হয়েছে মামলার বর্ণনায়।

ভোলা জেলা বিএনপির আহ্বায়ক গোলাম নবী আলমগীর বলেন, ‘এটি হচ্ছে আওয়ামী লীগ আমলে ভোলায় চলা বেপরোয়া লুটপাটের ছোট্ট নমুনা। বিপ্লবের মতো ছেলে ৩৩ কোটি টাকার সম্পদের মালিক। আমার তো মনে হয় এটুকু শুধু নয়, তার আরও অনেক সম্পদ রয়েছে যা এখনো তদন্তে বের হয়নি। আওয়ামী শাসনামলে পৌরসভা, এলজিইডি, ফ্যাসিলিটিজ, গণপূর্তসহ সব দপ্তর ছিল তার নিয়ন্ত্রণে। আর এর সবকিছুরই নেপথ্যে ছিলেন তার পালক পিতা তোফায়েল আহমেদ।’

এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য মইনুল হোসেন বিপ্লব এবং স্ত্রীর মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও তা বন্ধ পাওয়া গেছে।