
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে সন্তুষ্ট না হলেও বিএনপি নির্বাচনের দাবিতে এখনই মাঠে নামছে না। ধীরে চলো নীতিতে দলটি আরও কিছু সময় পর্যবেক্ষণ করবে। অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন জোগাবে। একই সঙ্গে নির্বাচন ইস্যুতে সমমনা বিভিন্ন দল, মত ও সংগঠনকে এক প্ল্যাটফর্মে আনার উদ্যোগ নেবে। নির্বাচন সামনে রেখে সাংগঠনিক প্রস্তুতি নিতে নানামুখী কর্মসূচির মাধ্যমে মাঠে থাকার পরিকল্পনাও নিয়েছে বিএনপি।
বুধবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমরা একেবারেই সন্তুষ্ট নই। আমরা পরিষ্কার করে বলেছি– ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন না হলে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে।’ ডিসেম্বরে নির্বাচন না হলে কী করবে বিএনপি– এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমরা আবার আপনাদের সামনে আসব দলের মধ্যে আলোচনা করে এবং আমাদের অন্য মিত্র দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব।’
শিগগির রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামবে: দলীয় সূত্র জানায়, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের পর দলীয় ফোরামে অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় এখনই সরকারবিরোধী কিংবা নির্বাচনী রোডম্যাপ দাবিতে আন্দোলনের পক্ষে নন নেতারা। তাদের মত, সরকারকে আরও সময় দিতে হবে। এখনই আন্দোলনে গেলে পতিত স্বৈরাচারের দোসররা সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে নানা ষড়যন্ত্র করে পরিস্থিতি জটিল করে তুলতে পারে তারা, যার দায় বিএনপিকে নিতে হবে। তবে ধৈর্য ধরার পরও যদি পরিস্থিতি নির্বাচনী পরিবেশের দিকে না যায় এবং সরকার টালবাহানা করে, তাহলে কঠোর আন্দোলনের বিকল্প প্রস্তুতি রাখছে বিএনপি। এরই অংশ হিসেবে শিগগির রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামবে দলটি। কর্মসূচির মধ্যে থাকবে সভা-সমাবেশ, পদযাত্রা ও মিছিল। তৃণমূল থেকে শুরু হয়ে উপজেলা, জেলা, মহানগরে ধাপে ধাপে পালিত হবে এ কর্মসূচি।
নির্বাচন ইস্যুতে জনমত গঠনে সব দল ও মতকে এক প্ল্যাটফর্মে আনার উদ্যোগ নেবে বিএনপি। এ জন্য শিগগির গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, বাম গণতান্ত্রিক জোট ছাড়াও ডান-বাম ঘরানার দলের সঙ্গে বৈঠক করার সিদ্ধান্ত রয়েছে বিএনপির। নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে কোনো জটিলতা দেখা দিলে যুগপৎভাবে মাঠে নামার প্রস্তুতি রয়েছে পরিকল্পনায়।
এ ব্যাপারে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না সমকালকে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের মতপার্থক্য স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। নির্বাচন ইস্যুতে দলগুলো কাছাকাছি হচ্ছে। জামায়াতে ইসলামীও দ্রুত নির্বাচন চাইছে, এটি ভালো লক্ষণ। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, নির্বাচন ইস্যুতে বিএনপি থেকে এখনও তারা কোনো বৈঠকের আমন্ত্রণ পাননি। পেলে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা জানান, আমন্ত্রণ না পেলেও বিদ্যমান পরিস্থিতি নিয়ে শিগগির তারা বিএনপির সঙ্গে বসার পরিকল্পনা করছেন। সেখানে নির্বাচনসহ বিভিন্ন ইস্যু আলোচনা হবে।
বিএনপি নেতারা বলছেন, নির্বাচন ইস্যুতে সমন্বিত কর্মসূচির বাইরে গিয়ে তারা মাঠে নামার পরিকল্পনা নিয়েছেন। সম্প্রতি বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদকদের বৈঠকে ভিন্ন কর্মসূচির বিষয়ে কর্মপরিকল্পনা হয়। পরে হাইকমান্ডকে অনানুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি জানানো হয়। চলতি মাসের শেষদিকে এ কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামতে পারে বিএনপি।
এসব কর্মসূচির মাধ্যমে একদিকে যেমন নির্বাচন প্রস্তুতির জন্য সাংগঠনিক গতিশীলতা আনতে চায় বিএনপি, তেমনি জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ধারাবাহিক কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারের ওপর চাপ তৈরি করতে চায় তারা, যাতে সরকার নির্বাচন ইস্যুতে দ্রুত ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেয়।
নেতারা বলছেন, বিদেশে বসে পতিত স্বৈরাচারের দোসররা ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত করছে। এ জন্য বিএনপির হাইকমান্ড নির্বাচনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। রোডম্যাপ ঘোষণা করলে পুরো দেশ ও জাতি নির্বাচনী আমেজে প্রবেশ করবে। তখন আর কোনো ষড়যন্ত্র কাজ করবে না বলে তাদের বিশ্বাস। কিন্তু প্রত্যাশিত রোডম্যাপ না পাওয়ায় বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে মাঠে সরব উপস্থিতি ও দলীয় অবস্থান শক্ত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। এরই অংশ হিসেবে আগামী তিন মাস দেশব্যাপী সভা-সমাবেশ, পদযাত্রা ও মিছিলের পরিকল্পনা করছেন শীর্ষ নেতারা। তৃণমূল অর্থাৎ ইউনিয়ন থেকে ধাপে ধাপে জেলা, মহানগর ও বিভাগীয় পর্যায়ে কর্মসূচি হবে। এরপর পরিস্থিতি বুঝে ঢাকায় বড় সমাবেশ করা হবে। প্রতিটি কর্মসূচিতে ভোটবঞ্চিত জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার পরিকল্পনা থাকবে। পুরো দেশকে করা হবে নির্বাচনমুখী।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য সমকালকে জানান, সরকারের সঙ্গে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি দাবি আদায়ে চাপ অব্যাহত রাখা হবে। বর্তমান সরকার ব্যর্থ হোক, এটা তারাও চান না। সে কারণে সরাসরি সরকারের বিরুদ্ধে কোনো অবস্থান নেবে না বিএনপি; দেবে না কঠোর কর্মসূচিও। তবে দ্রুত নির্বাচন এবং নির্বাচন নিয়ে যাতে কোনো ষড়যন্ত্র না হয়, সে জন্য নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকার চিন্তা করা হচ্ছে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু সমকালকে বলেন, ‘গণতান্ত্রিক দল হিসেবে বিএনপির মূল শক্তি জনগণ। জন্মলগ্ন থেকে বিএনপি জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ইস্যুতে কর্মসূচি নিয়ে মাঠে ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে।’