
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগের সরকার পতনের পর থেকেই রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি প্রশ্ন ঘুরেফিরে আসছে–বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কবে দেশে ফিরবেন? এ বিষয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে বরাবরই বলা হয়েছে, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে থাকা সব মামলা নিষ্পত্তির পরই তিনি দেশে ফিরবেন। সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার ঘুষ গ্রহণের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের করা একটি মামলায় খালাস পেয়েছেন তিনি। বিচারিক আদালতে তার বিরুদ্ধে আর কোনো মামলা না থাকলেও সাজাপ্রাপ্ত একটি মামলা এখনো রয়ে গেছে। ফলে তার দেশে ফেরা আরও কিছুটা বিলম্বিত হতে পারে। বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, ঈদুল ফিতরের পর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দেশে ফিরবেন। লন্ডনে চিকিৎসা শেষে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে তিনি দেশে ফিরতে পারেন। কেউ কেউ বলছেন, খালেদা জিয়ার সঙ্গে তারেক রহমানও দেশে ফিরতে পারেন। তবে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
বিএনপির দায়িত্বশীল কয়েকজন নেতা জানান, তারেক রহমান আগামী জাতীয় নির্বাচনের কিছু আগে কিংবা নির্বাচনের পরেও দেশে ফিরতে পারেন। সব মামলা থেকে মুক্ত হওয়ার পর নির্বাচনের আগে কিংবা পরে যখনই দেশে ফেরেন না কেন, আগামী নির্বাচনে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন এবং বিএনপি ভোটে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করলে দেশে ফিরে রাজনীতির হাল ধরবেন। তবে তার দেশে ফেরার ইস্যুটি আইনি প্রক্রিয়ার পাশাপাশি রাজনৈতিক বিষয় বলেও দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে।
জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কালবেলাকে বলেন, আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মামলাগুলো নিষ্পত্তি হলেই তিনি দেশে আসবেন। আর মামলামুক্ত হওয়ার পর কবে দেশে ফিরবেন, সে ব্যাপারে তিনি নিজেই সিদ্ধান্ত নেবেন এবং সুবিধামতো সময়ে তিনি ফিরবেন। ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) চিকিৎসার জন্য এখন লন্ডনে আছেন। সেখানে মায়ের চিকিৎসার বিষয়টি তিনি (তারেক) দেখভাল করছেন।
এক প্রশ্নের জবাবে ফখরুল বলেন, তারেক রহমানের দেশে ফেরার ক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিয়ে কোনো শঙ্কা নেই। ওয়ান-ইলেভেনের সরকারের সময় ২০০৭ সালের ৭ মার্চ তারেক রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরের বছর ৩ সেপ্টেম্বর জামিনে মুক্তি পেয়ে ১১ সেপ্টেম্বর চিকিৎসার জন্য সপরিবারে যুক্তরাজ্য যান। তখন থেকেই তিনি লন্ডনে রয়েছেন। লন্ডনে থাকাকালে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে যান তার মা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। যদিও বিএনপির দাবি, মিথ্যা মামলায় তাকে সাজা দেওয়া হয়েছিল। এরপরই দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেওয়া তারেক রহমান বিএনপির নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। স্থায়ী কমিটির সদস্যদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি দল পরিচালনা করছেন তিনি।
বিএনপি নেতারা বলছেন, তারেক রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পথ ধরেই গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের পতন ঘটে এবং শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। কেউ কেউ বলছেন, শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তিনি ইচ্ছা করলেই দেশে ফিরতে পারতেন। কিন্তু তিনি আইনি প্রক্রিয়ায় সব মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার পরই দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন।
বিএনপি বলছে, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে করা মামলাগুলো মিথ্যা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তারেক রহমানের জনপ্রিয়তায় ভীত হয়ে তাকে হয়রানি করার উদ্দেশ্যেই এসব মামলা করা হয়েছিল। দলটির নেতারা বলছেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এসব মিথ্যা মামলা থেকে মুক্ত হওয়াই তারেক রহমানের লক্ষ্য। সেজন্য তিনি আইনিভাবে লড়াই করতে দলীয় আইনজীবীদের নির্দেশনা দেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার বসুন্ধরা গ্রুপের পরিচালক সাব্বির আহমেদ হত্যা মামলার আসামিদের বাঁচাতে ২১ কোটি টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে মামলায় তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ আটজনকে খালাস দিয়েছেন ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ আদালত। এর মধ্য দিয়ে বিচারিক আদালতে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে আর কোনো মামলা রইল না।
তারেক রহমানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ, মানহানি, নাশকতা, গ্রেনেড হামলা ও দুর্নীতির অভিযোগে ঢাকাসহ দেশব্যাপী ৮০ থেকে ৮২টির মতো মামলা দায়ের করা হয়। ওয়ান-ইলেভেনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এসব মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ১৭টি মামলা হয়। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে করা মামলাগুলোর মধ্যে ৬২টির মতো মানহানির মামলা ছিল বলে তার আইনজীবীরা জানান।
আইনজীবীরা জানান, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলায় দণ্ড হয়েছে। এর মধ্যে চারটিতে তিনি খালাস পেয়েছেন। সেগুলো হলো—২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলা, সিঙ্গাপুরে অর্থ পাচার মামলা এবং নড়াইলে মানহানির মামলা। দণ্ডপ্রাপ্ত অন্য মামলাটি (জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের মামলা) এখনো বাকি রয়েছে। তারা আরও জানান, ৮০ থেকে ৮২টি মামলার মধ্যে বাকিগুলো সংশ্লিষ্ট আদালত কর্তৃক বাতিল বা খারিজ হয়েছে।
বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, তারেক রহমান দীর্ঘ সময় ধরে দেশের বাইরে আছেন। এ ক্ষেত্রে আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি তার দেশে ফেরার বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থান কী, দলের পক্ষ থেকে সেটাও জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। পাশাপাশি বাংলাদেশের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত প্রভাবশালী দেশগুলোর মনোভাবও জানার চেষ্টা করছে বিএনপি।
অবশ্য পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তারেক রহমানের ফেরার প্রতীক্ষায় রয়েছেন বিএনপির সারা দেশের নেতাকর্মীরা। তারা আশা করছেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দেশে ফেরার ক্ষেত্রে এখন কোনো কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। বিএনপির দাবি, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ক্ষমতাচ্যুত ফ্যাসিবাদী সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে নানা ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত করেছিল, সেটি এখন বিশ্বজুড়ে স্পষ্ট হয়ে গেছে। ফলে তার দেশে ফেরার ক্ষেত্রে আইনি বা রাজনৈতিক বিষয় কোনো ইস্যু হবে না।