Image description

স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে নবগঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। একই সঙ্গে তারা রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ওয়ার্ডে প্রশাসক নিয়োগের লক্ষ্যে কাজ করছে। দলটির নেতারা বলছেন, জুলাই বিপ্লবের পর স্থানীয় সরকারের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের অনেকেই আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় ও ফ্যাসিবাদের দোসর হিসেবে অনেক জনপ্রতিনিধি অপসারিত হওয়ায় কার্যত অচল হয়ে পড়েছে স্থানীয় সরকার কাঠামো। জন্ম-মৃত্যু সনদ, ট্রেড লাইসেন্স প্রদানসহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে স্থানীয় সরকারের মৌলিক সেবাগুলো। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সাময়িক অধ্যাদেশ জারি করে এই দায়িত্ব সরকারি কর্মকর্তাদের দিয়েছে। কিন্তু কাটছে না দুর্ভোগ। এমন পরিস্থিতিতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পক্ষে মত বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রনেতাদের। তারা যোগ্য প্রার্থী গুছিয়ে তালিকা প্রস্তুত করে নির্বাচনের প্রস্তুতিও নিতে শুরু করেছেন। যদিও বিএনপি ও এর সমমনা দলগুলো জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের তীব্র বিরোধিতা করছে।

জানা গেছে, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ১২৯ ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে সরকারের মাধ্যমে ‘প্রশাসক’ নিয়োগের তৎপরতা চালাচ্ছে এনসিপি। সম্ভাব্য প্রশাসকদের তালিকাও তৈরি করছে তারা। সেখানে বিএনপি, জামায়াত, এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ, এনসিপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের নামও রয়েছে।

জানা গেছে, সম্প্রতি এনসিপির একাধিক নেতা ঢাকা সিটি করপোরেশনের আওতাধীন ১২৯টি ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে ‘প্রশাসক’ নিয়োগের সম্ভাব্য প্রার্থীদের মৌখিক পরীক্ষা নিয়েছেন। বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরালও হয়েছে। নানা আলোচনা চলছে রাজনীতির মাঠে। তবে এনসিপি নেতাদের দাবি, প্রক্রিয়াটি ছিল প্রশাসক নয়; বরং স্থানীয় সরকার নির্বাচনে যোগ্য প্রার্থী খোঁজার জন্য প্রার্থীদের যাচাই-বাছাইয়ের একটি সাংগঠনিক প্রক্রিয়া।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এনসিপি স্থানীয় সরকার নির্বাচনের জন্য শিগগির মাঠে নামছে। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে প্রার্থী খোঁজার কাজও শুরু করেছে তারা। জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নিজেদের সাংগঠনিক শক্তি দেখাতে চায় দলটি। প্রার্থী যাচাই-বাছাইয়ের কাজ করছে উচ্চপর্যায়ের টিম।

এদিকে বিএনপি নেতারা বলছেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে স্থানীয় নির্বাচন হওয়ার নজির নেই। বর্তমান সরকারের উচিত জাতীয় নির্বাচনের দিকে ফোকাস করা।’

স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পক্ষে থানা এনসিপি নেতারা বলছেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে দেশে ভোটাধিকার না থাকায় জনগণ ভোট দেওয়া থেকে বিচ্ছিন্ন আছে। এই নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ভোটের প্রতি সম্পৃক্ততা বাড়বে। স্থানীয় প্রশাসন শক্তিশালী না হলে ভোটের পরিবেশ তৈরি করাও কঠিন। জাতীয় নির্বাচনের আগেই নতুন নির্বাচন কমিশন স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তার সক্ষমতার পরিচয় দেবে।’

সংগঠনটির নেতারা আরও জানান, ‘স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু করার মতো পরিস্থিতি এখনো বিরাজমান। ঈদের পর থেকে কয়েক ধাপে এই নির্বাচন হতে পারে। তবে দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের বিপক্ষে মত তাদের। এ ছাড়া যুগপৎভাবে স্থানীয় সরকার ও জাতীয় নির্বাচন (প্রক্রিয়া) চালাতে পারে বলেও তাদের কেউ কেউ মনে করেন।

জাতীয় নাগরিক কমিটির যুগ্ম সদস্য সচিব আলাউদ্দিন মোহাম্মদ কালবেলাকে বলেন, ‘স্থানীয় সরকার কাঠামো একেবারেই ভেঙে পড়েছে। নাগরিকরা ন্যূনতম সেবাও পাচ্ছে না। এ অবস্থায় এটি একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর মাধ্যমে জাতীয় নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশন তাদের সক্ষমতার পরিচয় দেবে।’

নির্বাচনে দলীয় প্রতীকের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হচ্ছে, এটি খুব ধ্বংসাত্মক। দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হওয়ার কারণে বিভিন্ন জায়গায় জাতীয় রাজনীতি থেকে বাইরে থাকা সম্ভব হয় না। সামাজিক যে সংহতির বিপরীতে দলীয় বিভাজনের শিকার হচ্ছে। আমরা চাচ্ছি দক্ষ, কার্যকর ও জাতীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত স্থানীয় সরকার।’

ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে প্রশাসক নিয়োগের জন্য ভাইভা বা মৌখিক সাক্ষাৎকার নেওয়ার অভিযোগ বিষয়ে আলাউদ্দিন মোহাম্মদ বলেন, ‘দল হিসেবে স্থানীয় নির্বাচন থেকে শুরু করে জাতীয় নির্বাচনে যোগ্য প্রার্থী যাচাই-বাছাই করা আমাদের সাংগঠনিক প্রক্রিয়ার অংশ। যে অভিযোগটি আসছে সেটি মিথ্যা। এটা সম্পূর্ণ আমাদের নিজস্ব সাংগঠনিক বিষয়। যেহেতু আমরা স্থানীয় সরকার নির্বাচন চাচ্ছি, সেহেতু প্রার্থী চূড়ান্ত করাও আমাদের কাজ। আমরা এনসিপির পক্ষ থেকে শুধু ঢাকা নয়, ঢাকার বাইরেও কোনো সিটি করপোরেশন বা পৌরসভায় কারা সম্ভাব্য প্রার্থী হতে পারেন, তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছি।’

দলটির আরেক যুগ্ম সদস্য সচিব রিফাত রশিদ বলেন, ‘সারা দেশে স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি না থাকায় নাগরিক সেবা ব্যাহত হচ্ছে। তাই অবিলম্বে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি। জাতীয় নির্বাচনের আগে এসব স্থানীয় নির্বাচনের মাধ্যমে মাঠ পর্যবেক্ষণেরও সুযোগ সৃষ্টি হবে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও নির্বাচন কমিশনকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনের আহ্বান জানাচ্ছি।’

ঈদের পর থেকেই স্থানীয় সরকার নির্বাচন হতে পারে বলে মন্তব্য করছেন এনসিপির যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘জনসাধারণের কল্যাণে অতি দ্রুত স্থানীয় সরকার নির্বাচন চাই। তারপর গণপরিষদ ও জাতীয় নির্বাচন।’

দলটির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা স্থানীয় নির্বাচন চেয়েছিলাম জাতীয় নির্বাচনের আগে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো এতে বাধা দিচ্ছে। আমরা মনে করছি যে, এই নির্বাচন হওয়া জরুরি। তাহলে নির্বাচনের পরিবেশটাও যাচাই করা যেত। পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে কিছু জায়গায় স্থানীয় সরকার নির্বাচন হওয়া দরকার। অনেকে এর বিপক্ষে মত দিয়েছেন। আমরা চাই অন্তত কিছু জায়গায় যেন নির্বাচন হয়ে যায়।’

স্থানীয় নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনের সক্ষমতার মানদণ্ড উল্লেখ করে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আব্দুল্লাহ কালবেলাকে বলেন, ‘ভোট না দিয়ে মানুষ অভ্যস্ত, অবৈধভাবে ১০টি ভোট দিয়ে মানুষ অভ্যস্ত। এই পরিবেশ এখন পরিবর্তন হয়েছে। এখন ভোটের আমেজ ফেরানো জরুরি। ধাপে ধাপে স্থানীয় নির্বাচন করে ফেললে যে ভুলগুলো হবে, সেগুলো উত্তরণ করে জাতীয় নির্বাচন করা যাবে। সরাসরি জাতীয় নির্বাচন হলে সেখানে ভুল কাটানোর সুযোগ থাকবে না। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য এটি রাউন্ড ওয়ার্ক হয়ে যাবে।’

গত বুধবার স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পোস্টে এ বিষয়ে বলেন, স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে ওয়ার্ড প্রশাসক নিয়োগ দেওয়ার কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এখনো স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয়টি সরকারের বিবেচনাধীন। নির্বাচনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হওয়ার আগে প্রশাসক নিয়োগের প্রশ্ন অবান্তর। জনগণ প্রাত্যহিক নানা সেবার প্রয়োজনে স্থানীয় সরকারের ওপর নির্ভরশীল। সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, সিটি ও পৌর ওয়ার্ডগুলোয় জনপ্রতিনিধি না থাকায় এসব সেবা ব্যাহত হচ্ছে। জনগণের প্রাত্যহিক দুর্ভোগ নিরসনে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয়ে বারবার বলছি। তবে এ বিষয়ে সরকারের চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। নির্বাচনের মাধ্যমে প্রকৃত জনপ্রতিনিধি দিয়ে স্থানীয় সরকার পরিচালনাই সর্বোত্তম।’

এর আগে গত জানুয়ারিতে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ইউরোপীয় বিনিয়োগ ব্যাংকের (ইআইবি) ভাইস প্রেসিডেন্ট নিকোলা বিয়ারের সঙ্গে আলোচনায় বলেছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার প্রস্তুতিও নিচ্ছে, যাতে স্থানীয় সরকার সত্যিকার অর্থে স্থানীয় ও কার্যকর সরকার হয়।

প্রশাসক নিয়োগের তৎপরতা: ওয়ার্ডগুলোয় প্রশাসক নিয়োগের তৎপরতা চালাচ্ছে সরকার। স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন, ২০০৯ সংশোধন করে অন্তর্বর্তী সরকার একটি কমিটি গঠনের বিধান যুক্ত করেছে। কমিটির সদস্যরা কাউন্সিলরের ক্ষমতা প্রয়োগ ও দায়িত্ব পালন করতে পারবেন।

বিএনপি সংসদের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ঘোর বিরোধী হলেও দলটির স্থানীয় পর্যায়ের কতিপয় নেতা তালিকায় নাম দিয়েছেন। আগে স্থানীয় নির্বাচন চাওয়া জামায়াতে ইসলামীর কয়েক নেতার নামও রয়েছে। এবি পার্টিসহ আরও কয়েকটি দলের নেতারা ‘প্রশাসক’ হওয়ার দৌড়ে আছেন। যদিও স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া জানিয়েছেন, ওয়ার্ড ‘প্রশাসক’ নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়নি।

ওয়ার্ডে প্রশাসক নিয়োগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের বলেন, ‘প্রশাসক নিয়োগের চেয়ে বরং স্থানীয় নির্বাচন হয়ে গেলে জনপ্রতিনিধিত্ব শূন্যতা কেটে যাবে।’

গত বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর দেশের ১২ সিটি করপোরেশনের সব কাউন্সিলরকে অপসারণ করে সরকার। একই দিন ৩২৩ পৌরসভার কাউন্সিলরকেও অপসারণ করা হয়। এর আগেই অপসারণ করা হয় আওয়ামী লীগ নির্বাচিত সিটি ও পৌরসভার মেয়রদের। জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্য এবং উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যানদেরও আগস্টে অপসারণ করে সরকার। মেয়র ও চেয়ারম্যান পদে সরকারি কর্মকর্তাদের প্রশাসকের দায়িত্ব দেওয়া হলেও কাউন্সিলর, ভাইস চেয়ারম্যান এবং সদস্যপদগুলো শূন্য রয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ ছাড়া স্থানীয় সরকারের বাকি সব প্রতিষ্ঠান চলছে জনপ্রতিনিধি ছাড়াই।

শুধু চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে আদালতের রায়ে মেয়রের দায়িত্ব পালন করছেন বিএনপি নেতা ডা. শাহাদাত হোসেন। গত ১২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে প্রশাসক নিয়োগ পেয়েছেন মোহাম্মদ এজাজ। তিনি জাতীয় নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য ছিলেন।