'জীবনেরে কে রাখিতে পারে?' পারে না বলেই মৃত্যু, বিজ্ঞানী ও দার্শনিকের বহু ব্যাখ্যার অপর পারে এক অপরাজয়ী সত্য। মৃত্যু কি শুধুই জৈবশক্তির চরম ক্ষয় ও যন্ত্রে যান্ত্রিকতার অবসান, নাকি নভোমণ্ডলীয় কোনো প্রকার আকর্ষণের এক রহস্যময় ঘটনা যে জৈবসত্তার অবশেষ পরিণতি পঞ্চভূতে মিলিয়ে যাওয়া? ব্যক্তিজীবনের কেন আসা, কেন যাওয়া এবং সৃষ্টির উদ্দেশ্যই বা কী- এসব তাত্তি্বক সত্য এখনো আমাদের জ্ঞানের ঊর্ধ্বে।
তবু ব্যক্তিজীবনের আহ্নিক আবর্তনের মূলে এসব তত্ত্বকথা ভুলে প্রাত্যহিকতায় জীবনকে ফুলে-ফলে ভরে তোলার আকাঙ্ক্ষা। জীবনকে ঘিরে মানুষের নিত্যকর্ম, তার চলমানতা জীবনের পরিচর্যা বৈ তো কিছু নয়। পরিচর্যা সুস্থ, সুন্দর জীবন গড়ে তুলতে, তাকে সময়ে, অসময়ে বিদায় জানাতে নয়। তবু একসময় তাকে বিদায় জানাতে হয়, যেতে দিতে হয়, তা কারো কারো জন্য যত কষ্টেরই হোক। আমাদের অভিজ্ঞতা এমন এক অপ্রিয় সত্যের মুখোমুখি।
দুই
বন্ধু আবদুল মতিন, 'ভাষা মতিন' নামে যাঁর সর্বজনীন পরিচিতি, তাঁকে দেখতে হয়েছিল অচেতন একজন চলৎশক্তিহীন মানুষ হিসেবে, হাসপাতালের শয্যায়। নিথর তাঁর শরীর, এক বন্ধু ভাষাসংগ্রামীর উষ্ণ হাতের স্পর্শেও যাঁর চেতনা ফেরেনি। এমনটা কি কখনো ভাবা গিয়েছিল। তবু এ নির্মম সত্যেরই মুখোমুখি হতে হলো। তখনো ভাবিনি, তাঁকে যেতে দিতে হবে।
আবদুল মতিন এক অর্থে ভাষা আন্দোলনের, বিশেষ করে একুশের সন্তান, অন্য অর্থে ওই আন্দোলনের অন্যতম স্রষ্টা। তবে আটচলি্লশের (মার্চ আন্দোলনের) ব্যর্থতার পর, বিশেষভাবে ১৯৫০ থেকে যিনি এ আন্দোলনের বীজতলা তৈরি করেছেন প্রতিকূল আবহাওয়ায়, সে মানুষটির নাম আবদুল মতিন, সংগত কারণে 'ভাষা মতিন'। যে ভুলে ভুলুক, আমি অন্তত মনে রেখেছি আটচলি্লশ মার্চের স্থগিত আন্দোলনকে উজ্জীবিত করতে ১৯৫০ থেকে অবিচল নিষ্ঠায় কর্মরত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক আবদুল মতিনকে। নামে কমিটি, কর্মকাণ্ডে ঘুরেফিরে একজন আহ্বায়ক আবদুল মতিন।
দুই বছর কম নয় সময় ও শ্রমের বিচারে। বিশেষ করে যখন ছাত্রসমাজ স্বতঃস্ফূর্ত উদ্দীপনায় রাজপথে নেমে এসেছিল 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' স্লোগান কণ্ঠে তুলে। কিন্তু স্থগিত তথা সুপ্ত আন্দোলন জাগিয়ে তোলার জন্য হয়তো কমই ছিল ওই সময় পরিসর। কারণ কোনো আন্দোলন একবার স্থগিত করলে তাকে সক্রিয় করে তোলা খুবই শ্রমসাধ্য কাজ। কথাটা বলছিলেন আটচলি্লশ মার্চ আন্দোলনের দুই কারিগর তাজউদ্দীন আহমদ ও মোহাম্মদ তোয়াহা।
রাজনৈতিক বিচারে আমার ধারণা, কথাটা শতভাগ সত্য। তাই আন্দোলনকে জড় অবস্থা থেকে সক্রিয় তরল বিস্ফোরক অবস্থায় তুলে আনতে পূর্বোক্ত কমিটির আহ্বায়ক আবদুল মতিনকে একাই দুই হাতে কাজ করতে হয়েছে। কমিটির কেউ এ কাজে শ্রম ও সময় দিতে খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না। কথাটা আমাকে একাধিকবার বলেছিলেন আবদুল মতিন। তাই আন্দোলনের গতানুগতিক কর্মসূচি নির্ধারণ ও পালন ইত্যাদিতে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা নিতে হয়েছে আবদুল মতিনকে। এ মানুষটিকেই একক চেষ্টায় পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য ও পশ্চিম পাকিস্তানের সংবাদসেবী মহলে বাংলা রাষ্ট্রভাষার পক্ষে লিখিত স্মারকলিপি পাঠাতে হয়েছিল। অন্তত সংবাদপত্র মহলে এর সুফল দেখা গিয়েছিল। নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে আবদুল মতিনসহ বিভিন্ন নেতা-কর্মীর তৎপরতায় আমরা পেঁৗছে যাই উপদ্রুত বায়ান্নর বিস্ফোরক একুশে ফেব্রুয়ারিতে।
তিন
তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের ঘনঘটায়। একুশে ফেব্রুয়ারির শেষ বিকেলে ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতালের ইমারজেন্সি রুমের বাইরে সিঁড়িতে কান্নাভেজা মুখে বসে আছেন আবদুল মতিন, ছবিটি এখনো চোখের সামনে ভাসে। চট্টগ্রামের প্রগতিশীল রাজনৈতিককর্মী বন্ধু আবদুস সাত্তার ও আমি সেখানে দাঁড়িয়ে। সেদিন এবং একুশের উত্তাল দিনগুলোতে একাধিক ঘটনায় মতিন সাহেবের সঙ্গে আমার রাজনৈতিক সম্পর্কের ভিত তৈরি করেছিল।
অবশ্য তখন আমরা রাজনৈতিক মতাদর্শে পুরোপুরি একই পথের যাত্রী নই। সে সম্পর্কটা তৈরি হয় আরো পরে। তবে একুশের দিনগুলোতে মেডিক্যাল হোস্টেলের ব্যারাকে দিনভর নেতা-কর্মীদের তৎপরতায় চেনাজানার সম্পর্কটা কিছু গভীর হয়ে ওঠে, এই যা। মতিন সাহেবের মধ্যে আমি তখন দেখতে পাই সর্বজনীন মানুষের মঙ্গলকামী একজন রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে। নেতৃত্বের পদমর্যাদার আকাঙ্ক্ষা তাঁর ছিল না। কমই ছিল জীবনের মূল লক্ষ্য।
অনেক অসম্পূর্ণ রেখে গেলে চলে
বলতে হয়, ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে যে তাঁর প্রকৃত রাজনৈতিক জীবনের সূচনা, তা এক ধরনের আশীর্বাদের মতো। জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার বিষয় নীতির রাজনৈতিক গুরুত্ব অন্য মার্ঙ্বাদী কারো কারো মতো, তাঁর বুঝতে ভুল হয়নি। রাজনৈতিক আলোচনায় বসলে প্রায়ই তাঁর মুখে কথাটা উচ্চারিত হতো আমাদের মার্ঙ্বাদীরা তো- 'ন্যাশনাল কোয়েশ্চেনটাই' বুঝতে শিখল না।
তখনো এবং এখনো আমি তাঁর সঙ্গে এ বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করি এবং দুঃখবোধ করি মার্ঙ্বাদীদের ওই বিভ্রান্তিতে। ষাটের দশকের বিভ্রান্তিকর অবস্থানের পরিণতি তাদের বর্তমান অবস্থা। জাতীয়তাবাদের প্রবক্তারা সে সুযোগের সদ্ব্যবহার ভালোভাবেই করেছিলেন। অবশ্য পরে মতিন-আলাউদ্দিন গ্রুপও নকশালবাদী রাজনীতির জাদুকরী বাঁশির ডাকে বিভ্রান্ত হয়েছিল 'খতমের' নীতিতে বিশ্বাস স্থাপন করে। সেটা সাময়িক ঘটনা।
স্বচ্ছ চিন্তায়, মুক্ত মনে ওই ভুলের বিষয়টি কথা প্রসঙ্গে বহুবার আমাকে বলেছেন আবদুল মতিন। এখানেই অনেকের তুলনায় তাঁর রাজনৈতিক সততার পরিচয়- অপ্রিয় সত্যকেও সত্য বলে মেনে নেওয়া। বাম রাজনীতিতে ব্যর্থতা তাঁর একার নয়, সবার। এবং এর অন্তত একটা বড় কারণ সংগঠনে আদর্শ-নিরপেক্ষ বিভাজন আর বিভাজন। ফলে শক্তিক্ষয় ও শক্তিক্ষয়, যে জন্য বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাদের অবস্থান দুর্বলতম বিন্দুতে গিয়ে পৌঁছেছে।
এটা আবদুল মতিন ভালোভাবেই বুঝেছেন। বুঝেছেন ওই জাদুকরী মুগ্ধতা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর থেকে। আদর্শিক ভাবনা তাঁকে বুঝতে শিখিয়েছে ঐক্যবদ্ধ গণশক্তির গুরুত্ব, ঐক্যবদ্ধ সংগঠনের গুরুত্ব। তাই আশির দশকে তিনি মত ও পথের দ্বিধা কাটিয়ে শুদ্ধ আদর্শিক বাম ঐক্য গঠনের চেষ্টায় আরো অনেকের সঙ্গে পথের সাথি হয়েছেন। তবে শুদ্ধ মার্ঙ্বাদী সংগঠনের গুরুত্ব তাঁর কাছে বরাবরই বড় হয়ে থেকেছে।
আমার এখনো মনে পড়ে সিদ্ধেশ্বরীর বাড়িতে বহু দুপুর, বহু বিকেল, বহু সন্ধ্যায় এ দেশে শুদ্ধ রাজনীতির সম্ভাবনা নিয়ে কথাবার্তার মুহূর্তগুলো, ঘণ্টাগুলো। মনে পড়ে তাঁকে নিয়ে একাধিক নেতার সঙ্গে বৈঠকের কথা, সম্ভাবনার বিন্দুগুলো খতিয়ে দেখার কথা। আশ্বাস মিলেছে, আবার তা ভেঙেও গেছে। চট্টগ্রামে মিলকি সাহেবের সঙ্গে, আরো অনেকের সঙ্গে বৈঠক কেমন অর্থহীন হয়ে গেল। এমন আরো বহু ঘটনা, যা পচনেরও ইঙ্গিত দিয়েছে। তবু আবদুল মতিন আশাবাদী।
আমি হতাশ হলেও আবদুল মতিন হতাশ হননি। তাঁদের কথা : বসে থাকলে কি চলবে। চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। ফলাফল একদিন ঠিকই মিলবে। ভবিষ্যৎ তো আমাদের। বন্ধু তোমার আজকে প্রশ্ন : আমি তো দেখছি সামনে শুধু শূন্যতা, ভ্রান্তি আর বিভাজন। দু-চারটে ছোট্ট আলোকবিন্দুতে বিভ্রান্তির অন্ধকার দূর হবে কি? এখনো কি ধরে রাখবে পূর্ববিশ্বাসে?
তোমার মতো প্রবল আত্মবিশ্বাসী না হলেও অনেকটা সদর্থক বিশ্বাস নিয়ে আমাদের জনাকয় বন্ধু তাঁদের যাত্রা শেষ করেছেন সম্ভাবনার আলোকবিন্দু সামনে না দেখেই। এবার এক এক করে ঝরে যাওয়ার পালা। বিশ্বাসের সেই বিন্দুগুলো উত্তর প্রজন্মে কতটা সঞ্চারিত হয়েছে বা হবে তা জানি না। তবে এটুকু বোঝা যায়, সমাজ পরিবর্তনের কাজটি বড় কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বন্ধু, ঝড় ওঠার সময় এখনো অনেক দূর, সোনালি স্বপ্নের সমাজ আরো বহুদূর। আদর্শগত দ্বন্দ্বীর কালো মেঘ আস্তে আস্তে সব সম্ভাবনা ঢেকে দিতে চাইছে। দীর্ঘ জীবনে এত ত্যাগ, এত কষ্ট, এত অর্থনৈতিক অনটনের বিনিময়ে কী পেলে', সমাজতান্ত্রিক সমাজ কখন ধরা দেবে, হিসাবে মিলেছে কি? না, তুমি পাওয়া-না পাওয়ার হিসাব কখনো মেলাতে চাওনি। কাজের মাধ্যমে, আদর্শ ও সততার মাধ্যমে গন্তব্যে পেঁৗছতে চেয়েছ। না-পাওয়ার হিসাব মেলাতে চাননি গীতিকার রবীন্দ্রনাথও।
কিন্তু কাজ যে তোমার অসমাপ্ত রয়ে গেল। রাজনীতির ম্যারাথন রেসে পরবর্তীজনের হাতে ব্যাটন তুলে দেওয়া- সে কাজটি কি সঠিকভাবে করা গেছে, না আদৌ করা গেছে? কী হলো, কথা বলছ না কেন? না, কথা বলার অবস্থায় তুমি আর নেই। তবে যা বলে গেছ ঘরোয়া পরিবেশে, ব্যক্তিগত বৃত্তে বা বাইরে, তাতে আত্মবিশ্বাস ও ভবিষ্যৎ সময়ের ওপর আস্থা বড় হয়ে থাকছে। এটাই বড় কথা। সেখানে আবদুল মতিন তাঁর রাজনৈতিক ব্যর্থতার জবাব দিয়েছেন। সেই সঙ্গে উত্তর প্রজন্মের ওপর আস্থার প্রকাশ ঘটিয়েছেন।
হ্যাঁ, আবদুল মতিন তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতা, তাঁর সৎ ও সরল জীবনযাপন, ক্ষমতার অবাঞ্ছিত কাড়াকাড়িতে যুক্ত না হয়ে যুক্তি ও বুদ্ধির চর্চায় পথের নিশানা করে নেওয়ার যে দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন, সেটাই দেশকে তাঁর সর্বোত্তম দান। এখানে ফাঁকির বা সংক্ষিপ্ত পথের যেমন কোনো সুযোগ নেই, তেমনি নেই ব্যক্তিগত প্রাপ্তির। নেই রাজনৈতিক সততার সঙ্গে আপসের কোনো অবকাশ।
ভুলকে ভুল, অপ্রিয় সত্যকে সত্য হিসেবে গ্রহণ করে ভুল সংশোধনের যে চেষ্টা বরাবর আবদুল মতিনের মধ্যে দেখা গেছে, তা একালের রাজনীতিতে শিক্ষণীয় উদাহরণ বলে মনে করি। নির্দ্বিধায় তাঁর রাজনৈতিক পথের আপাত ব্যর্থতা মেনে নিয়ে আবদুল মতিন তাই বলতে পেরেছেন, 'ভাষা আন্দোলনই আমার জীবনের একমাত্র সাফল্য', যে ভাষা আন্দোলন এ দেশের রাজনীতিতে যুক্তিসংগত মুক্তির প্রথম নিশানা, সেই ভাষা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান রূপকার আবদুল মতিন, যাঁকে আমরা 'রাষ্ট্রভাষা মতিন' বা 'ভাষা মতিন' হিসেবে চিনি। তাই বলতে হয়, ভাষাসংগ্রামী আবদুল মতিন যুগ যুগ জিয়ো। অনেক অসম্পূর্ণ কাজ রেখে গেলে চলে। জানি না, কারা সেসবের হাল ধরবে।
লেখক : কবি, গবেষক ও ভাষাসৈনিক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন