বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ নিয়ে সম্প্রতি আবার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা শুরু হয়েছে। স্বভাবতই এসেছে পাকিস্তানের কথা। এ দেশে তাদের গোয়েন্দা সংস্থা 'আইএসআই'-এর তৎপরতার বিষয় নিয়ে কথকতা। ঘটনা অবশ্য আজকের নয়। বহু কথিত বলেই সবাই জানেন যে পাকিস্তান একাত্তরের পরাজয় মেনে নেয়নি। এখনো তাদের সে মনোভাব অটুট। দু-চারজন পাকিস্তানি সাংবাদিক বা মানবাধিকারকর্মী যেমনই বলুন না কেন, পাকিস্তানের বিশাল জনমত এখনো 'স্বাধীন' বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। তাদের আচার-আচরণে তা খুবই স্পষ্ট। এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো কারণ নেই, সুযোগও নেই।
এই তো দিন কয় আগে আমাদের এক প্রবীণ সাংবাদিক পুরনো বিষয়টিকে নতুন করে তুলে ধরেছেন। সবার জবানিতে এমন কথাই উঠে আসছে যে মধ্যপ্রাচ্যের সাহায্য নিয়ে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে জঙ্গিবাদের যে প্রকাশ, তার পেছনে মূল শক্তি যুক্তরাষ্ট্র, তাদের চতুর গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর গভীর কর্মতৎপরতা। তারা পাকিস্তানকে, পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনকে, বিশেষ করে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইকে এমন প্রশিক্ষণ (!) দিয়েছে যে উভয়ে হাত ধরাধরি করে চলার ক্ষমতা রাখে, বলতে হয় চলতে অভ্যস্ত।
বাংলাদেশকে তো পাকিস্তান হতে দেওয়া যায় না
যুক্তরাষ্ট্রে যেমন প্রেসিডেন্ট কেনেডি, তাঁর ভাই রবার্ট কেনেডির রহস্যজনক হত্যার অন্দরমহল উদ্ঘাটিত হয়নি, তেমনি হয়নি পাকিস্তানে একাধিক সরকারপ্রধান হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন ও বিচার। এত সহজে সেখানকার প্রশাসন, উচ্চবর্গীয় ও মননশীল সমাজ সেই সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে হাত ধুয়েমুছে ফেলে কিভাবে? যতই 'কসাই' নামে পরিচিত হোক, পাকিস্তানের একজন প্রেসিডেন্ট হিসেবে, আরেক স্বৈরমনোভাবাপন্ন শাসক জুলফিকার আলী ভুট্টোর হত্যাকারী হিসেবে হলেও সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলির প্রকৃত তথ্য উদ্ঘাটন দরকার ছিল।
একই কথা খাটে পাকিস্তানি শাসনপ্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো সম্পর্কেও। তাঁকে নামকাওয়াস্তে বিচারে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল, নাকি তার আগেই তাঁকে মেরে ফেলা হয়, সেসব নিয়ে অনেক জল্পনাকল্পনা রয়েছে। এই তো বছর কয় আগে পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো নিহত হলেন। বলা হলো, মৌলবাদীরা তাঁকে হত্যা করেছে, কিন্তু তা নিয়ে দক্ষ অনুসন্ধান সম্পন্ন হলো না।
সবচেয়ে বড় বিস্ময়, পাকিস্তান পিপলস পার্টিও এ বিষয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। দলীয় প্রধান, সরকারপ্রধান হত্যা পাকিস্তানি রাজনীতি ও সমাজনীতির কাছে যেন ডালভাত। হরহামেশা যা ঘটে থাকে, তা নিয়ে মাথাব্যথা কেন? অনেকে মনে করেন, এগুলোর পেছনে যেমন মার্কিনদের সুদক্ষ হাতে তৈরি তালেবানি জঙ্গিগোষ্ঠীর হাত রয়েছে, তেমনি রয়েছে অথবা একটু বেশি মাত্রায়ই রয়েছে 'আইএসআই'-এর গোপন হাত। অর্থাৎ সামরিক সংশ্লিষ্টতা।
কাজেই পাকিস্তানে কে করবে কার বিচার! পাকিস্তানি সামরিক গোয়েন্দা যেখানে 'সর্প হয়ে দংশন করে, ওঝা হয়ে ঝাড়ে', সেখানে কখন কী যে ঘটে, কিভাবে ঘটে তা নির্ধারণ করা খুবই কঠিন। শুনেছি, ওসামা বিন লাদেনের ইসলামাবাদ সন্নিহিত গোপন আস্তানাটি ছিল পাকিস্তানি সামরিক গোয়েন্দাদেরই ব্যবস্থাপনায়। তাই অধিকতর চতুর সিআইএর চররা ঠিকই সব গুপ্ত কথা বের করে তাদের প্রধান শত্রু ওসামাকে হত্যার ব্যবস্থা করে, পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে। আর তা নিয়ে পাকিস্তানের রাজনীতিতে কয়েক দিন কী তুমুল ঝড়! তারপর যথারীতি সব শান্ত!
একটি দেশের অভ্যন্তরে তাদের সর্বোচ্চ প্রশাসনকে না জানিয়ে মার্কিন সেনাদের অনুপ্রবেশ, আগ্রাসন ও হত্যাকাণ্ড কতটা সম্ভব; আর সম্ভব হলেও তা কতটা আন্তর্জাতিক বিধিবিধানসম্মত, সে প্রশ্ন দু-চারজন করলেও তা ব্যাপকভাবে উত্থাপিত হয় না। একটি অসাধু ঘটনা প্রশ্নবিদ্ধ হয়নি, যে পরিমাণ হওয়া উচিত। এর আরো একটি কারণ কি পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফের সংশ্লিষ্টতা পূর্বোক্ত দুই ঘটনার সঙ্গেই। এঁরা ফ্রাঙ্কেনস্টাইন তৈরিতে সহযোগিতা করেন, আবার তাদের উৎখাতে গোপন হাত বাড়িয়ে দেন। ওই যে প্রবাদ, যা একটু আগে উল্লেখ করা হয়েছে। এ হলো পাকিস্তানি রাজনীতি এবং তা পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই শুরু এবং এখনো সচল।
তাই যেমন পাকিস্তানের জন্মলগ্নের কিছু সময় পরই সংঘটিত 'রাওয়ালপিণ্ডি ষড়যন্ত্র মামলা'র আসল রহস্য বেরিয়ে আসেনি, তেমনি এক বেলচা মাটিও সরানো হয়নি 'কায়েদে মিল্লাত' নামে খ্যাত পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান হত্যাকাণ্ডের রহস্য নিয়ে, বিচার দূরে থাক। আশ্চর্য এ নিয়ে পাকিস্তানি এলিট শ্রেণি, রাজনীতির উচ্চবর্গীয়দের জোরশোর প্রতিবাদ করতে শোনা যায়নি, দেখা যায়নি। সেটা কি পাকিস্তানি সামরিক সংস্থার ভয়ে? সিআইএকে কে না ডরায়, তেমনি আইএসআইকে। অথচ ওই সংস্থা তাদেরই গড়া।
এভাবে মার্কিন মদদে পরিচালিত পাকিস্তান, মার্কিন পরামর্শে পরিচালিত পাকিস্তান আত্মনাশী রাজনীতির দম আঁটা ধোঁয়াটে গলির মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। মাঝেমধ্যে এসবের বিরুদ্ধে সরব নিঃসঙ্গ দু-চারটি কণ্ঠস্বর। কিন্তু বেশি কথা বললে যে বিপদ তার প্রমাণ তো মিলেছে পাকিস্তানের খ্যাতনামা সাংবাদিক হামিদ মীরের গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনায়। ভাগ্যিস, ভদ্রলোক এ যাত্রা প্রাণে বেঁচে গেছেন।
কিন্তু কদিন দুই নৌকায় পা রেখে চলা যায়? হয়তো শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসন ও সংস্থাবিশেষের সিদ্ধান্তে মার্কিন ড্রোন হামলার ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীও তাদের উপজাতীয় এলাকায় সামরিক অভিযান চালিয়েছে, বিশেষ করে ওয়াজিরিস্তানে। শুরু হয়েছে পূর্ণাঙ্গ সামরিক অভিযান। সেটা কি পাকিস্তানি বাহিনীর সর্বোচ্চ অংশের ঐকমত্যে অর্থাৎ সর্বসম্মতিক্রমে?
বলা কঠিন। তেমনি বলা কঠিন যে এ অভিযান লোকদেখানো (মার্কিন প্রশাসনকে বিশেষভাবে) নাকি ঘটনা সত্যই আন্তরিক! অর্থাৎ পাকিস্তান কি চাইছে তালেবান জঙ্গিদের পাকিস্তানি এলাকা থেকে বিতাড়ন। যাক তারা যথারীতি আফগানিস্তানে, তার সন্নিহিত এলাকায়, না হয় বাংলাদেশে বা সন্ত্রাসী জঙ্গিগোষ্ঠী হিসেবে কাশ্মীরে ও ভারতের নানা স্থানে, উৎপাতটা যেন তাদের ওপর দিয়েই যায়। ওই যে কথায় আছে, 'যা শত্রু পরে পরে।' সে ক্ষেত্রে শত্রু-মিত্র ভেদাভেদ নেই। তা কি আফগানিস্তান, কি ভারত বা বাংলাদেশ!
পাকিস্তানের বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব জাভেদ বারকি 'পাকিস্তানের ঘরোয়া যুদ্ধ' অর্থাৎ তালেবানি লড়াই নিয়ে কিছুটা এ ধরনের মন্তব্যই করেছেন। তিনি কি সন্তুষ্ট যে শীর্ষ পাকিস্তানি সামরিক নেতারা শেষ পর্যন্ত পথে এসেছেন। তবে তাঁর আশঙ্কা, সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো তাদের ঘাঁটি থেকে উৎখাত হয়ে শহর করাচিসহ পাকিস্তানের বিভিন্ন এলাকায় না ছড়িয়ে পড়ে। তা ছাড়া ব্যাপক বিমান হামলায় শরণার্থী সমস্যাও সৃষ্টি হতে পারে। হতে পারে কি, হয়ে থাকে। তাই তাঁর শেষ বক্তব্য, উত্তর ওয়াজিরিস্তানে সামরিক অভিযানের পরিণতি ভালো হবে না। বরং পরিস্থিতি অধিকতর সহিংস হয়ে উঠতে পারে।
পাকিস্তান ও তার মৌলবাদী জঙ্গিগোষ্ঠী নিয়ে এই সাতকাহনের গুরুত্ব কম নয়। কারণ ওই অঞ্চল থেকে আসা এদেশীয় তালেবানদের একসময়কার স্লোগান ছিল 'বাংলা হবে আফগানিস্তান'। সে প্রচেষ্টায় পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা নানাভাবে কম মদদ জোগায়নি। অর্থ, পরামর্শ, অস্ত্র, কী না। উদ্দেশ্য, একাত্তরের বাংলাকে একহাত নেওয়া। আর এ ব্যাপারে এদেশীয় রাজনীতির একাংশ সমান তালে পা ফেলে এগিয়েছে। এবং আশ্চর্য, তাতে আমাদের উগ্র বামপন্থীদের একাংশ মদদ জুগিয়েছে।
তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের সৌভাগ্য যে বিশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও আওয়ামী লীগ শাসন শক্ত হাতে মৌলবাদী জঙ্গিদের উৎখাতে তৎপরতা চালিয়ে আপাত শান্তির ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, এ ক্ষেত্রে আত্মতুষ্টির অবকাশ নেই। কারণ এ দেশে আইএসআই সদা তৎপর। তদুপরি বাংলাদেশি রাজনীতির একাংশ এখনো পাকিস্তানমুখী, পাকিস্তাননির্ভর। তারা ভুলে গেছে একাত্তরের দুঃস্বপ্ন। তা ছাড়া বড়সড় একটি আন্তর্জাতিক মহল এ বিষয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছে। আর এ দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সংস্থায় রয়েছে জঙ্গিগোষ্ঠীর বা পাকিস্তানের সমর্থক, সংখ্যায় যত কমই হোক।
তাই জঙ্গিদের বাংলার মাটি থেকে পুরোপুরি উচ্ছেদ করা যায়নি। আর এ কারণেই বর্তমান সরকারের পক্ষে খুবই গুরুত্বপূর্ণ জঙ্গিবাদ উৎখাতের তৎপরতা সচল রাখা। বিশেষ করে যখন তাদের সমর্থক রাজনৈতিক সংগঠন এ দেশে কম নয়, বিশেষ করে জামায়াত ও অনুরূপ গোষ্ঠী। কিছু সাম্প্রতিক ঘটনা তেমন প্রমাণই দেয়। আর যা-ই হোক, বাংলাদেশকে তো ফের পাকিস্তান হতে দেওয়া যাবে না। তাই সতর্কতা ও তৎপরতা শুধু সরকারপক্ষের হলেই চলবে না, দরকার হবে এদেশীয় জনশক্তির পক্ষেরও।
লেখক : কবি, গবেষক ও ভাষাসৈনিক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন