|
এ এম এম শওকত আলী
|
|
ভারতে সরকার পরিবর্তন ও বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক
22 May, 2014
ভারতের ১৬তম লোকসভা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মোদিঝড়ে তাসের ঘরের মতো উড়ে গেল ১২৯ বছরের ঐতিহ্যবাহী ও স্বাধীন ভারতের ৬৭ বছরের মধ্যে প্রথম একনাগাড়ে ৩০ বছর ও পরে কয়েক মেয়াদে ২৪ বছর মোট ৫৪ বছর রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা কংগ্রেস। ভারতের রাজনৈতিক ময়দানে কংগ্রেস এখন অকূলপাথারে। আদর্শগতভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার আরেক অন্যতম খুঁটি বামফ্রন্টের যা কিছু ছিটেফোঁটা প্রভাব পশ্চিমবঙ্গে ছিল তার শেষ সম্বলটুকুও এবার লোকসভা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তছনছ হয়ে গেল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হুংকারে। ভারতের রাজনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উত্তর প্রদেশে এযাবৎকালের দুই সিংহ-সিংহীর কোনো পাত্তা নেই। মহারানি মায়াবতীর বহুজন সমাজবাদী পার্টির (বিএসপি) কোনো নামনিশানা নির্বাচনের পর খুঁজে পাওয়া যায়নি। একটা আসনও পেল না। অথচ দুই বছর আগেও মায়াবতী উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন এবং তাঁর দল পাঁচ বছর রাজ্যের ক্ষমতায় ছিল। আরেক মহারথী মুলায়েম সিংহ যাদবের সমাজবাদী পার্টি (এসপি) রাজ্য সরকারে থাকার পরও খড়কুটোর মতো ভেসে গেছে, মাত্র পাঁচটি আসন পেয়েছে। ১৯৯৬ সালের পর কেন্দ্রে সরকার গঠন ও পরিচালনায় আঞ্চলিক দলগুলোর প্রভাব ও প্রতিপত্তি যেভাবে ছিল, তার বিলুপ্তি ঘটল এবার বিজেপির এককভাবে ২৮৩ আসন প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে। তামিলনাড়ুর আম্মাজি জয়ললিতা ও পশ্চিমবঙ্গের বোনজি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যাপক উত্থান হলেও তাঁরা কেন্দ্রের ওপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারবেন না বিজেপির নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে। কুলদীপ নায়ার ও অমর্ত্য সেনের মতো বিশ্বখ্যাত বুদ্ধিজীবীদের অনেকে আদর্শগত কারণে নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হোক তা চাননি। তার পরও মোদিঝড়ে ভারতের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কংগ্রেসের এত বড় ভরাডুবি হলো এবং বাঘা বাঘা আঞ্চলিক দলগুলো লাপাত্তা হয়ে গেল। ভারতের মতো একটি বিশাল ও শত শত জাতপাতের দেশে এর পেছনে বহুবিধ কারণ আছে। তবে সব বিশ্লেষক যে কারণটির সঙ্গে একমত তা হলো, কংগ্রেসের শেষ মেয়াদে (২০০৯-২০১৪) ভয়ানক দুর্নীতি প্রতিরোধে সীমাহীন ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে মনমোহন সরকার। কমনওয়েলথ গেম্স আয়োজনে কংগ্রেসের দলীয় সাংসদের হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ ও অন্যতম শরিক দল তামিলনাড়ুর ডিএমকেপ্রধান করুণানিধির মেয়ে কানু মাঝি ও একই দলের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এ রাজার বিরুদ্ধে টু-জি স্পেকট্র্যাম কেলেঙ্কারির মাধ্যমে লাখো কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ ছিল মানুষের মুখে মুখে। এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে মানুষ সন্তুষ্ট হতে পারে- এমন কোনো ব্যবস্থা মনমোহন সরকার নিতে পারেনি। উত্তর প্রদেশে পাঁচ বছর মুখ্যমন্ত্রী থাকা অবস্থায় নিজের জন্য রাজপ্রাসাদ তৈরি থেকে শুরু করে হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগে মহারানি মায়াবতীকে মানুষ ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। বিহারের লালুপ্রসাদ যাদবের ডুবে যাওয়ার কারণও একই।
আঞ্চলিক তো বটেই, বিশ্বের রাজনৈতিক ও সামরিক সমীকরণে ভারত এখন অন্যতম আমলযোগ্য শক্তি। তাই বিশ্বের বড় বড় রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা রাতের ঘুম হারাম করছেন এই ভেবে যে বিশ্বে এই সময়ের সর্ববৃহৎ ফেডারেল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতের অখণ্ডতা রক্ষার মূল দর্শন উদার প্রগতিশীল ধর্মনিরপেক্ষতা কি ১৬তম লোকসভা নির্বাচনের মাধ্যমে পরাজিত হলো! কারণ ধর্মীয় উন্মাদনা ও হিন্দুত্ববাদে বিশ্বাসী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) বিজেপির মূল চালিকা শক্তি হওয়ায় ও বাবরি মসজিদ ভাঙার কারণে বিজেপিকে ধর্মনিরপেক্ষ দল কেউ বলতে পারছে না। তবে বিশ্লেষণের এখানেই শেষ নয়, আরো আছে। প্রত্যেক রাষ্ট্রের জন্য অন্তর্নিহিত সহজাত কিছু আদর্শভিত্তিক শক্তি থাকে, যা শেষ বিচারে ওই রাষ্ট্রের অখণ্ডতার রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে। ভারতের জন্য সেই জায়গাটি হলো ধর্মনিরপেক্ষতা ও পূর্ণ গণতন্ত্র। একটা বিষয় লক্ষণীয়, ভারতের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা মৌলিক নীতি হিসেবে প্রোথিত থাকলেও জন্মের পর থেকে আজ অবধি বিজেপি এ প্রসঙ্গে কোনো রকম কোনো কথা বলেনি। ভারতের গণতন্ত্র শক্ত ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠিত- এ কথা সত্য। তার পরও টাকা ও অনৈতিক ও শিষ্টাচারবহির্ভূত গলাবাজির কুপ্রভাব থেকে ভোটের রাজনীতি এখনো মুক্ত নয়, যা এই নির্বাচনে আরো প্রকটভাবে দেখা গেছে। সুতরাং বিজেপি নির্বাচনী প্রচারণায় হিন্দুত্ববাদের কার্ড দক্ষতার সঙ্গে খেললেও তা রাষ্ট্র পরিচালনায় কতটুকু দেখাতে পারবে বা আদৌ দেখানোর চেষ্টা করবে কি না, তা নিয়ে বিশ্লেষকদের মধ্যে বিভক্তি আছে। কেউ সন্দিহান, আবার অনেকেই দোদুল্যমানতায় আছেন।
সবাই এখন দেখার অপেক্ষায়। তবে এ প্রসঙ্গে ভারতের প্রখ্যাত বর্ষীয়ান সাংবাদিক কুলদীপ নায়ারের মন্তব্যটি আমার কাছে বেশি প্রণিধানযোগ্য মনে হয়েছে। তিনি বলেছেন, 'কোনো দল বা ব্যক্তির ইচ্ছানুসারে ভারতের নীতি নির্ধারিত হয় না, বিশেষ করে বৈদেশিক নীতি। সংবিধান, গণতন্ত্র ও সুধীসমাজ সর্বভারতীয় স্বার্থের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করবে।' ভারতের বেশির ভাগ রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেছেন, এমন উত্থানের পেছনে বিজেপির না যতটুকু কৃতিত্ব, তার চেয়ে ঢের বেশি কাজ করেছে কংগ্রেস সরকারের ব্যর্থতা ও দুর্নীতি এবং উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের স্বপ্ন দেখানো মোদি ক্রেজ। তাই এখনই বলা ঠিক হবে না যে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের পরাজয় ঘটেছে। বরঞ্চ নির্দিষ্ট করে বলতে চাইলে বলতে হবে, ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলগুলো আপাতত পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে।
ভারতে সরকার পরিবর্তন ও বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক
ভারতের জনগণ ভোটের মাধ্যমে কোন ব্যক্তিকে প্রধানমন্ত্রী করবে বা কোন রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় বসাবে, সেটি তাদের একান্ত নিজস্ব ও অভ্যন্তরীণ বিষয়। কিন্তু বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমাদের বিচার-বিশ্লেষণের জায়গা হলো, ভারতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হলে তার কুপ্রভাব বাংলাদেশে এসে পড়ে। এর উদাহরণ বাবরি মসজিদ ভাঙার পর দেখেছি ১৯৯২ সালে, তার আগে পাকিস্তানের সময়ও দেখেছি। আর উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রশ্নে বাংলাদেশের জন্য ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক অপরিহার্য। অন্যদিকে ভারতের রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতার স্বার্থে সব অঞ্চলের সমোন্নয়ন যদি ভারত চায়, বিশেষ করে দারুণভাবে পিছিয়ে পড়া ও সশস্ত্র বিদ্রোহের হুমকিতে থাকা উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর নিরাপত্তা ও উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে ভারতের জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা অপরিহার্য। ভারত-বাংলাদেশের আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্কটি দুই দেশের মানুষের রক্তের ওপর প্রতিষ্ঠিত। ১৯৭১ সালে একজন ছোট গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দেখেছি ভারতীয় সৈন্য ও মুক্তিযোদ্ধারা কিভাবে এক সঙ্গে ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে বাংলাদেশের ধানক্ষেতে বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য রক্ত ঢেলেছে। ভারতীয় সৈন্য আর মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ত মিলিমিশে সিক্ত হয়ে আছে বাংলাদেশের মাটি। তাই ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর ভারতীয় সৈন্য ও মুক্তিযোদ্ধারা আবেগে আপ্লুত হয়ে একে অপরকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিল। মনে হয়েছিল, এই বন্ধন চিরদিন অটুট থাকবে। কিন্তু ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড, ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধীর শোচনীয় পরাজয় ও ১৯৮৪ সালে তাঁর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড, বাংলাদেশে সাতচল্লিশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান ইত্যাদি কারণে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক আর কখনো একাত্তরের মাত্রায় উঠতে পারেনি। তবে বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ২০১০ সালে দিল্লি সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের সম্পর্কের একটা নতুন মাইলফলক তৈরি হয়েছে। সম্পর্ক উন্নয়নের প্রধান বাধা একে অপরের প্রতি অনাস্থা ও অবিশ্বাসের ছিদ্রগুলো এখন আর নেই। আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর সশস্ত্র বিদ্রোহীদের জন্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সব ধরনের অবস্থানের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখাতে সক্ষম হয়েছে। এটা ভারতের নিরাপত্তার উদ্বেগ যে কতখানি কমিয়েছে, তা ভারতের নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা স্বীকার করেন। কিন্তু বিদায়ী কংগ্রেস সরকারের সব রকম সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশা অনুযায়ী ভারত সাড়া দিতে পারেনি। এর প্রধান কারণ, ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সমীকরণে কেন্দ্রে শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তির অনুপস্থিতি ও দুর্বল কোয়ালিশন সরকারের অক্ষমতা। সীমান্ত চিহ্নিতকরণ ও তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি দুটো হয়েও হলো না শুধু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতার কারণে। সংবিধান অনুসারে দুটো বিষয়ই ভারতের ফেডারেল সরকারের আওতাভুক্ত।
কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী যে উদাহরণ সৃষ্টি করলেন, তা একদিকে যেমন বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, তেমনি এমন উদাহরণ ভারতের মতো এত বড় একটা ফেডারেল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার জন্য অশনিসংকেত হয়ে থাকবে। ভারতের মতো বিশাল জনসংখ্যা অধ্যুষিত ফেডারেল রাষ্ট্রব্যবস্থা বিশ্বে দ্বিতীয়টি এখন আর নেই। বিশ্বের অন্যতম একটি ফেডারেল রাষ্ট্র ভূতপূর্ব যুগোস্লাভিয়া ভেঙে এখন ছয়টি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র। জোশেফ টিটো ছিলেন যুগোস্লাভিয়ার অবিসংবাদিত নেতা, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের অন্যতম প্রভাবশালী পুরোধা। টিটোর নেতৃত্বে যুগোস্লাভিয়া একমাত্র সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ছিল, যেটি তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব বলয়ের বাইরে থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমদূরত্ব রক্ষা করে চলেছে। অভ্যন্তরীণ জাতিগত দ্বন্দ্বে ক্লান্ত হয়ে টিটো ১৯৭৪ সালে যুগোস্লাভিয়ার জন্য নতুন সংবিধান প্রণয়ন করলেন, যেখানে জাতিগতভাবে বিভক্ত প্রদেশগুলোকে ব্যাপক ক্ষমতা প্রদান করা হয়। ওই সংবিধানে এমন ধারা ছিল, যার বলে প্রাদেশিক সরকার ইচ্ছা করলে ফেডারেল সরকারের সিদ্বান্তের ওপর ভেটো দিতে পারত। ১৯৮০ সালে টিটোর মৃত্যুর পর ওই সংবিধানই যুগোস্লাভিয়ার সংহতির জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। গত শতকের নব্বইয়ের দশকজুড়ে জাতিগত দাঙ্গা ও ভয়াবহ যুদ্ধে প্রায় ২০ লাখ মানুষ নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে যুগোস্লাভিয়া নামক শক্তিশালী একটি ফেডারেল রাষ্ট্রের বিলুপ্তি ঘটে এবং আলাদা ছয়টি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হয়। বিদায়ী কংগ্রেস কোয়ালিশনের যে রাজনৈতিক দুর্বলতা ছিল, বিজেপি সরকারের সেই দুর্বলতা ও অক্ষমতা থাকবে না। কারণ তারা একাই ২৮৩টি আসন পাওয়াতে সাংবিধানিকভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের আওতাধীন বৈদেশিক সম্পর্কের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে কোনো রাজ্য সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে না। কিন্তু বিগত পার্লামেন্টে বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় উল্লিখিত দুই চুক্তির ব্যাপারে বিজেপি যেহেতু কোনো ইতিবাচক ভূমিকা দেখায়নি, তাই বিশ্লেষকরা দোদুল্যমানতা থেকে বের হতে পারছেন না। ভারতের সঙ্গে কোনো সমস্যা দ্বিপক্ষীয়ভাবে আলোচনায় বাংলাদেশের জন্য দুর্বল জায়গাটি হলো অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে রাষ্ট্রের মৌলিক নীতি, আদর্শ ও চেতনাগতভাবে দুই প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর একেবারে বিপরীতমুখী অবস্থান। যার জন্য ভারতের সঙ্গে দরকষাকষিতে কখনো বাংলাদেশ রাজনৈতিক ঐকমত্য দেখাতে পারেনি। ১৯৭৫ সালের পর বাংলাদেশে পাকিস্তানমুখী সাতচল্লিশের চেতনার ধারকরা দীর্ঘ সময় রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকার কারণে এমন পরিস্থিতির উদয় হয়েছে। এই একই কারণে ভারতে যদি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হয়, অথবা ভারত যদি অযৌক্তিকভাবে বাংলাদেশের ন্যায্য দাবিকে অগ্রাহ্য করে, যেমন অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন, সীমান্ত হত্যা বন্ধ করা বা সমভাবে বাণিজ্যিক সুবিধা প্রদান ইত্যাদি, তাহলে বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তি সেগুলোর সমাধানের কৌশলের কথা না বলে ভোটের অঙ্ক বাড়ানোর জন্য ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে এবং সস্তা ভারতবিরোধী স্লোগানে মুখর হয়। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ তাতে বিভ্রান্ত হয় এবং সেটিকে ভর করে সাম্প্রদায়িক শক্তি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় চলে আসে। তাতে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এর জ্বলন্ত উদাহরণ ২০০১ সালে নির্বাচন এবং তার ফল অনুসারে ২০০১-২০০৬ মেয়াদে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক শক্তির ক্ষমতায় আরোহণের মধ্য দিয়ে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ভয়ানক অবনতি। যার পরিণতিতে ১০ ট্রাক অবৈধ অস্ত্র বাংলাদেশ হয়ে ভারতের সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জন্য পাঠানোর অপচেষ্টা হয়েছিল। যেটি নিম্ন আদালতে এখন প্রমাণিত হয়েছে, যাতে দেখা যায় ওই অপচেষ্টার সঙ্গে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্রত্যক্ষ যোগসাজশ ছিল। ফলে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাষ্ট্রগুলোর নিরাপত্তার বিষয়টি ভারতের নতুন বিজেপি সরকারের কার্যতালিকায় টপ প্রায়োরিটি বা সর্বাগ্রে থাকবে বলে ধারণা করা যায়। যার জন্য ভারতের বুদ্ধিজীবী মহল থেকে বারবার বলা হচ্ছে ভারতের সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের নীতির কোনো পরিবর্তন হবে না। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমরা ভারতের বুদ্ধিজীবীদের এই আশ্বাসে কতখানি ভরসা রাখতে পারছি, তা এ মুহূর্তে বলতে পারছি না। দেখার অপেক্ষায় রইলাম।
লেখক : কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন