
চীনা অ্যাপের মাধ্যমে প্রতারণার শিকার হয়ে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা খুইয়েছেন ১ হাজারেরও অধিক তরুণ। অ্যাপের মাধ্যমে অনলাইনে বিনিয়োগ ও লোনের ভয়ংকর ফাঁদ তৈরি করে এ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে প্রতারক চক্র। চক্রের সঙ্গে জড়িত চীনা নাগরিকসহ খোদ দেশের মোবাইল ব্যাংকিংয়ের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারাও। এসব অর্থ লেনদেনের জন্য ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে খোলা হয় মার্চেন্ট অ্যাকাউন্ট।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি, র্যাবসহ অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থা চক্রের কয়েকজনকে গ্রেফতারের পর জানতে পারে এ ভয়ংকর চক্রের কারসাজি সম্পর্কে। সম্প্রতি দেশের একটি মোবাইল ব্যাংকিংয়ের কর্মকর্তাসহ ৫ জনকে গ্রেফতার করা হলেও চক্রের মূল হোতা চীনা নাগরিক কেভিন চেন (৪০) পলাতক। এই চীনা নাগরিক দেশের কয়েকজন তরুণের সহযোগিতায় ভুয়া মার্চেন্ট অ্যাকাউন্ট খুলে ৩০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ এবং ভুয়া কাগজপত্র ব্যবহার করে মার্কেন্ট অ্যাকাউন্ট খোলারও প্রমাণ পেয়েছে সিআইডি। এখনও অসংখ্য চীনা অ্যাপের মাধ্যমে অনলাইন বিনিয়োগ করে সর্বস্ব খোয়াচ্ছেন। তাদের ধরতে মাঠে কাজ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।
র্যাবের একটি সূত্র জানিয়েছে, চীনা অ্যাপ ব্যবহার করে অর্থ লেনদেন করছে- এমন অনেক অ্যাপ তারা দেখতে পাচ্ছে। এখনও সচল রয়েছে ১৫টিরও অধিক অ্যাপ। এর মধ্যে মার্স ক্যাশ লোন, মোহাম্মদ ক্যাশ লোন, এজে ক্যাশ লোন ও প্যাসিফিক ক্যাশ লোনের নাম প্রকাশ করেছে র্যাব। এসব অ্যাপের মাধ্যমে অর্থ আদান-প্রদানের জন্য সরাসরি টাকা লেনদেন হচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মার্চেন্ট অ্যাকাউন্টে। ওই পেমেন্ট থেকে সরাসরি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে যাওয়ার পর সেই টাকা তুলে নিচ্ছে চেকের মাধ্যমে।
এ বিষয়ে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন সময়ের আলোকে বলেন, এমন একটি চক্রের সন্ধানে র্যাব বেশকিছু দিন ধরে কাজ করছে। আমরা এরই মধ্যে কয়েকটি চাইনিজ অ্যাপস শনাক্ত করেছি। অ্যাপগুলোর অ্যাডমিন ও প্রতারকদের খুঁজছি।
তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মোবাইল ফিন্যান্স সার্ভিস (এমএফএস) মার্চেন্ট অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য অন্তত ৮টি ক্যাটাগরিতে শর্ত পূরণ করতে হয়। অ্যাপের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের ক্ষেত্রে মার্চেন্ট অ্যাকাউন্টগুলো খোলা হচ্ছে ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে। চক্রটির কয়েকজনকে গ্রেফতারের পর দেখা গেছে, অ্যাপ্লিকেশন ফরম, কেওয়াইএল, মোবাইল নম্বর, ট্রেড লাইসেন্স, টিআইএন, ছবি, মেমোরেনডাম আর্টিকেল এবং এনআইডি সবই ভুয়া। মার্চেন্ট অ্যাকাউন্ট খোলার ক্ষেত্রে এসব শর্ত পূরণের পর আবেদন জমা দিলে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের প্রতিষ্ঠান জমা দেওয়া কাগজপত্র এবং অফিস পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ভিজিট করে মার্চেন্ট অ্যাকাউন্ট খোলার অনুমতি দিয়ে থাকে। তবে এ ক্ষেত্রে এমএফএস অসাধু কর্মকর্তারা যাচাই না করে মার্চেন্ট অ্যাকাউন্টের অনুমোদন দেওয়ায় সেই অ্যাকাউন্টে পেমেন্টের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা লেনদেনের পর সেই টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রতারকরা।
গত বছর চীনা অ্যাপের ফাঁদে পড়ে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ লেনদেন করে প্রায় ১ হাজার তরুণ প্রায় ৩০০ কোটি টাকা খুইয়েছেন। চলতি বছর ১৯ জানুয়ারি প্রতারণার শিকার হয়ে পুরান ঢাকার বাসিন্দা আবু তালহা নামে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক শিক্ষার্থী চকবাজার থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন। মামলা নম্বর ৫১। মামলাটি তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ বিভাগের (সিআইডি) সাইবার পুলিশ সেন্টার (সিপিসি)। মামলায় ১২ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ২০-২৫ জনকে আসামি করা হয়। মামলার প্রধান আসামি করা হয় চীনা নাগরিক কেভিন চেনকে। মামলার হওয়ার আগেই চীনা নাগরিক কেভিন চেন দেশ ত্যাগ করেছেন বলে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে। ওই সূত্র জানায়, কেভিন চেন নামটি ছদ্মনাম। তার আসল নাম চিহ্নিত করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আসল নাম আপাতত বলা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে সূত্র।
এ বিষয়ে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (সাইবার পুলিশ সেন্টার) মো. রেজাউল মাসুদ সময়ের আলোকে বলেন, সম্প্রতি এক তরুণের মামলার তদন্ত করতে গিয়ে দেখা গেছে, এ চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে হাজার হাজার তরুণ অধিক ইনকামের লোভে অ্যাপের ফাঁদে পড়ে শত শত কোটি টাকা খুইয়েছেন। তিনি বলেন, সম্প্রতি আমরা অভিযান চালিয়ে চক্রের ৪ সদস্যকে গ্রেফতার করেছি। তালিকাভুক্ত আরও ৮ জনের নাম পেয়েছি। তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
রেজাউল মাসুদ আরও বলেন, বর্তমানে সবচেয়ে বেশি প্রতারণা হচ্ছে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে। বিশেষ করে চীনা অ্যাপের মাধ্যমে বিনিয়োগ-লোন নেওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ হয়ে লেনদেন হয় মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। এরপর লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করলে হঠাৎ অ্যাপগুলো বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ভুক্তভোগীরা বুঝতে পারে তারা প্রতারণার শিকার হয়েছে।
সিআইডির অপর এক কর্মকর্তা জানান, এ চক্রের ৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা হলেন- টিএনএস অ্যান্ড বোরঘাটা গ্যাস থানডার লাইট টেকনোলজি লিমিটেডের ইমানুয়েল এডয়ার্ড গোমেজ (৩৩), ওকে ক্লিক টেকনোলজি লিমিটেডের জেরি পলিকাপ রোজারিও (৩৬), টিএনএস অ্যান্ড বোরঘাটা গ্যাস থানডার লাইট টেকনোলজি লিমিটেড ও ওকে ক্লিক টেকনোলজি লিমিটেডের অ্যাডমিন মো. বুরহান উদ্দিন (৩৫), মো. শহীদুল ইসলাম (৩২) ও এসএম আবু সায়েম। এ সময় তাদের কাছ থেকে ৭টি মোবাইল ফোন, ১০টি সিম, ১টি ল্যাপটপ ও ৮২টি সিল জব্দ করা হয়।
তাদের জিজ্ঞাসাবাদের পর তারা জানায়, চাইনিজ নাগরিক কেভিন চেনের মাধ্যমে তারা এ প্রতারণার জগতে প্রবেশ করে। কেভিন তাদের নামে বিভিন্ন কোম্পানি চালু করে সেখানে তাদের ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে নিয়োগ দেয় এবং ওই কোম্পানির নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে সেই ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে তারা এ প্রতারণার টাকার লেনদেন করে। বাংলাদেশে কেভিনের প্রধান সহযোগী ইমানুয়েল এডয়ার্ড গোমেজ প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে সব ধরনের লেনদেন করত। জেরি পলিকাপ রোজারিওকেও এ কাজে যোগদান করায়।
জেরিকে তারা ‘ওকে ক্লিক টেকনোলজি লিমিটেড’ প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে নিয়োগ দেয়। এরপর কোম্পানির নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার সব কার্যক্রম করেন মো. বুরহান উদ্দিন। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ছাড়াও বিভিন্ন এমএফএস মার্চেন্ট অ্যাকাউন্টের পেমেন্ট সিস্টেমের মাধ্যমে তারা এ প্রতারণার টাকা সংগ্রহ করে থাকে। তারা বিভিন্ন নামসর্বস্ব কোম্পানির নামে মার্চেন্ট অ্যাকাউন্ট তৈরি করে। অ্যাপসে বিনিয়োগে আগ্রহীদের তারা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করত এবং প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিত। এর মধ্যে ৯৯১ সদস্যবিশিষ্ট একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের তথ্য প্রাথমিকভাবে পাওয়া গেছে বলে জানায় সিআইডি।
যেভাবে কৌশলে ফাঁদ ফেলত প্রতারকরা : গ্রেফতার ব্যক্তিরা জিজ্ঞাসাবাদে প্রতারণার ফাঁদ সৃষ্টির কৌশল সম্পর্কে তদন্তকারীদের জানায়, ক্যাশমানি নামক একটা অ্যাপসের মাধ্যমে তারা প্রথমে গ্রাহকদের ক্ষুদ্র পরিসরে শর্তসাপেক্ষে ঋণ দেয়। ঋণের মাধ্যমে তারা গ্রাহকদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলে তাদের বিনিয়োগে উৎসাহী করত। তাদের পাঠানো ইউআরএল লিংকে ক্লিক করলে গ্রাহক একটি বিজ্ঞাপন দেখতে পেত। যেখানে উল্লেখ থাকে ‘টিএনএস অ্যান্ড বোরঘাটা’ অ্যাপটি ইনস্টল করুন এবং ৪ দিনে ৪০০ টাকা ফ্রি ইনকাম করুন। বিনিয়োগকারীরা অ্যাপসটি তাদের স্মার্টফোনে ইনস্টল করলে প্রথমে প্রতিদিন ১০০ টাকা করে ৪ দিনে ৪০০ টাকা তাদের ‘এমএফএস’ অ্যাকাউন্টে যোগ হতো। ৪ দিনে তাদের আবারও হোয়াটসঅ্যাপে ম্যাসেজ করা হতো।
তারা বলত- ‘আপনি যদি স্থায়ীভাবে আমাদের সদস্য হতে চান তাহলে ১০ হাজার টাকা বিনিয়োগ’ এবং ‘দৈনিক স্থায়ীভাবে ৮০০ টাকা থেকে ৫ হাজার টাকা আয় করুন।’ পরে বিনিয়োগকারীরা অ্যাপসে দেওয়া ‘এমএফএস’ নম্বরে ১০ হাজার পাঠিয়ে স্থায়ী সদস্য হয়। স্থায়ী সদস্য হওয়ার পর প্রথম কিছু দিন প্রতিদিন ২৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা করে লাভ দেওয়া হতো। এ অ্যাপসে তাদের রেফারেন্সে নতুন বিনিয়োগকারী সংযুক্ত করতে পারলে তাদের বিনিয়োগের ওপর ২০ শতাংশ কমিশন দেওয়া হবে বলে সদস্য বৃদ্ধির জন্য উৎসাহী করা হতো।
বিনিয়োগের কয়েক দিন পরই একটা সিস্টেম চালু করে দেওয়া হতো যে, বিনিয়োগকারীদের অ্যাকাউন্টে ১০ হাজার টাকার নিচে নেমে এলে তাদের অ্যাকাউন্ট ব্যান্ড করে দেওয়া হতো এবং বিনিয়োগের কোনো টাকাই গ্রাহক আর ফেরত পেত না। ফলে বিনিয়োগকারীরা তাদের টাকা ফেরত পাওয়ার আশায় ও তাদের অ্যাকাউন্ট যাতে বন্ধ না হয় সে জন্য আরও অধিক পরিমাণে টাকা বিনিয়োগে বাধ্য হতো। যাদের অ্যাকাউন্টে ১০ হাজার টাকার কম টাকা থাকত ওই টাকাসহ তাদের পূর্বের সব বিনিয়োগের টাকা বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে নেওয়া হতো।
এ ছাড়াও ‘ডি৩ টিএনএস অ্যান্ড বোরঘাটা’ অ্যাপসে কিছু দিন পর বিভিন্ন রকম আপডেট আসতে থাকে- ‘আপনার নিজের অ্যাকাউন্টে ১ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা টপআপ করুন, প্রতিদিন ৪০ থেকে ৫০০ টাকা আয় করুন’, ৭ দিন পরে আবার আপডেট আসে ‘আপনি ১৫০০ থেকে ৪ হাজার টাকা তুলতে পারবেন, মাসিক ২৫ হাজার থেকে ৩৫ হাজার টাকা আয় করুন’।
এ ছাড়াও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম অফার আসত যেমন, আপনি ২১ জন সদস্যকে রেজিস্ট্রেশন করাতে পারলে আপনার মাসিক ইনকাম বেড়ে যাবে ইত্যাদি। তাদের প্রলোভনে প্রলুব্ধ হয়ে বিপুলসংখ্যক তরুণ টাকা বিনিয়োগ করে। টাকার পরিমাণ যখন কোটি ছাড়িয়ে যায় তখন প্রতারকরা অ্যাপসটি বন্ধ করে দেয়। ভুক্তভোগীর সঙ্গেও সম্পূর্ণ যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। গত ডিসেম্বরের শেষ দিকে চীনা নাগরিক কেভিন চেনের নেতৃত্বে প্রতারক চক্রটি প্রায় ৩০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে অ্যাপসটি বন্ধ করে দিয়ে পালিয়ে যায়।
প্রতারণার শিকার ও মামলার বাদী মো. আবু তালহা সময়ের আলোকে বলেন, আমরা প্রথমে না বুঝেই অ্যাপসের মাধ্যমে অর্থ বিনিয়োগ করি। প্রাথমিকভাবে আমরা ভেবেছিলাম, এটি ব্যবসায় সুফল বয়ে আনবে। কিন্তু আসলে তারা ভয়ংকর প্রতারক। দেশের মোবাইল ব্যাংকিংয়ের কিছু কর্মকর্তা এর সঙ্গে জড়িত। তিনি আরও বলেন, আমাদের মতো এমন হাজার হাজার তরুণ লাখ লাখ টাকা খুইয়ে এখন সর্বস্বান্ত।