|
ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী
|
|
দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা : কিছু কথা
06 Feb, 2014
‘দশ ট্রাক অস্ত্র’ পাচারের মামলায় দু’জন সাবেক মন্ত্রীসহ ১৪ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। তন্মধ্যে আসামের ‘স্বাধীনতাকামী’ সংগঠন ‘উলফা’র (ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসাম) প্রধান পরেশ বড়–য়াও আছেন। আদালত দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নানা সাক্ষ্য-সাবুদ বিবেচনায় এ রায় দিয়েছেন। আদালতের এখতিয়ার ও রায় সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। কারণ এখানেই এ মামলার সমাপ্তি ঘটছে না। নিশ্চিতরূপেই এটি এখন উচ্চ আদালতে যাবে।
এই মামলার সূচনা পর্বে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলাম, বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর, কারণ এতে রাজনীতিক ও সরকারি কর্মকর্তা ছাড়াও বাংলাদেশের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেছেন এমন কয়েকজন সশস্ত্র বাহিনীর জ্যেষ্ঠ অফিসারকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এ পর্যায়ের কোনো ব্যক্তি যদি অপরাধ করেও থাকেন সেক্ষেত্রে এ বিচার প্রক্রিয়ায় যেন সামগ্রিকভাবে আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রশাসন, বিশেষ করে জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ও নিরাপত্তা বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন না হয়। এ বক্তব্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আমলে নিয়েছেন বলে মনে হয় না।
আদালত তার রায়ে স্পষ্ট করেই বলেছে, এ অস্ত্র বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারতের আসাম রাজ্যের বিদ্রোহী ‘উলফা’ বাহিনীর কাছে চোরাচালান করা হচ্ছিল। বাংলাদেশের ভেতরে ব্যবহার করার কোনো লক্ষ্য চোরাচালানিদের ছিল না। তবে বিষয়টি অবগত থাকা সত্ত্বেও অভিযুক্ত মন্ত্রী, গোয়েন্দা কর্মকর্তা এবং অন্যরা নীরবতা অবলম্বন করেন। তাতে প্রমাণিত হয়, তারা এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন, অথবা, ইচ্ছাকৃতভাবে এ ব্যাপারে চোখ বন্ধ করে অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করেছেন। আদালত তার পর্যবেক্ষণে এ কথাও বলেছেন, এ ঘটনায় ‘সর্বোচ্চ মহলের সায় ছিল’।
এ চোরাচালানে যেসব অস্ত্র পাচার হচ্ছিল তা দেখে আতংকিত হতে হয়। স্বস্তির বিষয় এগুলো বাংলাদেশের ভেতরে ব্যবহারের জন্য আমদানি করা হয়নি; যা আদালতের রায়ে স্পষ্ট হয়েছে। এসব অস্ত্রের গন্তব্য ছিল ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, তথা আসাম রাজ্যের একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহী বাহিনী; যারা ওই অঞ্চলের ‘স্বাধীনতা’র দাবিতে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত। এ বিদ্রোহীদের স্বাধীনতার দাবি আদৌ যৌক্তিক কি-না, কিংবা তাদের প্রতি ওই এলাকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থন আছে কি-না, সে বিষয়ে আমরা মন্তব্য করতে পারি না। ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্কের কারণে বিষয়টি আমাদের জন্য খুবই বিব্রতকর। বন্ধুরাষ্ট্রের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে প্রত্যক্ষে-পরোক্ষে সহায়তা করা রীতিবিরুদ্ধ কাজ।
তবে আসাম ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জনগণ ভৌগোলিকভাবে আমাদের নিকট প্রতিবেশী। তাদের সঙ্গে আমাদের ঐতিহাসিক, নৃতাত্ত্বিক ও ঐতিহ্যগত সম্পর্ক অতি সুপ্রাচীন। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে আমরা এ অঞ্চলের মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়েছি। তাই তাদের ন্যায্য দাবি-দাওয়ার প্রতি আমাদের সমর্থন তারা আশা করতেই পারেন। তাদের যৌক্তিক দাবির প্রতি এ দেশের মানুষের মানবিক সংবেদনশীলতা অন্যায় হতে পারে না। সে ক্ষেত্রে তাদের আন্দোলন-সংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা না দিলেও আমরা অন্তত প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি থেকে বিরত থাকতে পারি। একই সঙ্গে আমাদের সদিচ্ছার নিদর্শনস্বরূপ আমরা ভারত সরকারকে অনুরোধ জানাতে পারি তাদের প্রতি ন্যায়ানুগ আচরণ করতে এবং এ স্থলবেষ্টিত পার্বত্য এলাকাটির উন্নয়নের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে। কারণ সেখানকার অশান্তি সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আমাদেরও স্পর্শ করে। আমাদের দিক থেকে এর বেশি কিছু করতে গেলে তা অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের শামিল হবে। আমরা যার ঘোরতর বিরোধী। আমাদের নিজেদের দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যেমন আমরা অন্যের হস্তক্ষেপ একেবারেই পছন্দ করি না।
তবে এ কথাও মনে রাখতে হবে, এ দেশের মানুষ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ‘সাত বোন’ অঞ্চলের ('Seven sisters' : আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, মিজোরাম, মণিপুর, নাগাল্যান্ড, অরুনাচল) মানুষের প্রতি নানা কারণেই সহাভূতিশীল। নিকটতম প্রতিবেশী হওয়া ছাড়াও এর আরও কিছু বাস্তব কারণ রয়েছে। বাংলাদেশের প্রায় সব মানুষ বাংলা ভাষাভাষী ও মুসলমান। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যেও বিপুলসংখক বাঙালি ও মুসলমান আছেন। কিছু উগ্রপন্থী ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী সেখানে ‘বাঙালি খেদাও’ বা মুসলমান মাত্রেই ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ এমন কথা বলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানোর চেষ্টা করে থাকে। তবে এ গোষ্ঠীর চাপে আশির দশকে আসাম সরকার অবৈধ অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিত করার জন্য কমিশন করলে কয়েক ডজনের বেশি লোককে সেই সংজ্ঞায় ফেলা যায়নি।
আশির দশকে এ অঞ্চল নিয়ে একটি গবেষণাপত্র তৈরি করতে গিয়ে লক্ষ্য করেছি, ওই অঞ্চলে বসবাসরত মুসলমানরা প্রায় সবাই ভারত বিভাগের আগে থেকেই সেখানে আছেন। তাদের একাংশ ‘আদি অসমীয়া’, বাঙালি নন। অন্যরা সেখানে বসবাস শুরু করেন অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকে। সেখানকার বিরান এলাকা আবাদ করতে ব্রিটিশ সরকার, তথা আসাম সরকারের উৎসাহ ও পৃষ্ঠপোষকতায়। অতঃপর তারা বংশ পরম্পরায় সেখানকার স্থায়ী নাগরিক হওয়ার অধিকার অর্জন করেছেন। এ অভিবাসীরা সেখানকার জনজীবনে নতুন প্রাণের সঞ্চার করেন। অর্থনীতিরও চালিকাশক্তি হয়ে ওঠেন। তারা ব্রহ্মপুত্রের অবাসযোগ্য জলাভূমি আবাদ করেছেন রোগ-শোক, ম্যালেরিয়া-কালাজ্বরের মহামারী উপেক্ষা করে। অমানুষিক পরিশ্রমে বাসযোগ্য করেছেন অবাসযোগ্য বনভূমি। এখন তাদের শুধু মুসলমান হওয়ার ‘অপরাধে’ বহিরাগত আখ্যায়িত করা একেবারেই অযৌক্তিক ও অমানবিক। ভারত সরকারের একাধিক কমিশন এ বিষয়ে অনুসন্ধান করে এমন মন্তব্য করেছে। পাকিস্তান হওয়ার পর, বা বাংলাদেশ হওয়ার পর এদিক থেকে দলে দলে মুসলমান সেখানে গিয়ে জমি-জিরাত দখল করছে এ বক্তব্য যথার্থ নয়। বরং পাকিস্তান হওয়ার পর সেখান থেকেই হাজার হাজার মুসলমান এ দেশে চলে এসেছেন। পরে কিছু মুসলমান যদি সেখানে গিয়েও থাকেন সেটা অস্বাভাবিক সংখ্যায় নয়। সীমান্ত এলাকায় এরকম যাতায়াত সর্বত্রই ঘটে থাকে। বিশেষ করে কোনো সুসংবদ্ধ জনপদ রাজনৈতিক কারণে দু’দেশে বিভক্ত হয়ে গেলে সেখানকার সাধারণ মানুষ তাদের ঐতিহ্যগত যোগাযোগ, আÍীয়তা, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদির সুবাদে এপার-ওপার করে থাকে। তারা কাঁটাতারের বেড়া মানে না। আসাম-বাংলাদেশ সীমান্তে তা-ই ঘটছে এবং সম্ভবত ঘটতেই থাকবে।
আসাম অঞ্চলের বাঙালি জনগোষ্ঠীতে হিন্দু ও মুসলমান উভয় ধর্মাবলম্বী রয়েছেন। ’৪৭-এর আগে সমগ্র সিলেট (আমাদের সিলেট বিভাগ ও বর্তমান আসামের করিমগঞ্জ জেলা) তখনকার বৃহত্তর আসাম প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সেই সুবাদেও অনেক বাঙালি হিন্দু-মুসলমান তখন আসামের অন্যান্য এলাকায় অভিবাসী হয়েছেন। সেখানকার বাঙালি হিন্দুদের বড় অংশ অবশ্য ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির পর দেশান্তরী হয়ে সেখানে গেছেন। বিভাজনের শর্তাধীনে তাদের আয়ত্তবহির্ভূত রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে নিতান্ত বাধ্য হয়ে পিতৃপুরুষের ভিটামাটি ছেড়ে তারা সেখানে গেছেন। সে জন্য তাদের দোষারোপ করার কোনো সুযোগ বা অধিকার কারও নেই।
উগ্রপন্থী সাম্প্রদায়িক শক্তি বহিরাগত অপবাদ দিলেও এ কথিত ‘বহিরাগত’রা এখন উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজ জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সেই সঙ্গে ভারতের মূল ভূখণ্ড ও বাংলাদেশের সঙ্গে তারাই মেলবন্ধনের সূত্র হয়ে আছেন। অসমীয়া ও বাংলা ভাষা খুবই কাছাকাছি। বলা যায় একই ভাষার দুই রূপ। বর্ণমালাও অভিন্ন। এ সাদৃশ্য ঐতিহ্যগত ও নৃতাত্ত্বিক আÍীয়তার দ্যোতক।
পারস্পরিক স্বার্থের বিবেচনায় বাংলাদেশ ও ‘সাত বোন’ রাজ্যগুলো পরস্পরের সম্পূরক হতে পারে। আঞ্চলিক পর্যায়ে যোগাযোগব্যবস্থা, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সুসম্পর্ক উভয়ের জন্য বহুমুখী কল্যাণ বয়ে আনতে পারে। সেই সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে উভয় পক্ষে সাধারণ মানুষের জীবনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটানো যেতে পারে। এ কারণেই ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্কের পাশাপাশি বাংলাদেশের দিক থেকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছা এবং আশা-আকাক্সক্ষাকেও যথাযথ মূল্য দিতে হবে। তাদের ক্ষোভ-দুঃখের কারণগুলো উপলব্ধি করে তা দূর করার জন্য সচেষ্ট হতে ভারতের প্রতি আহ্বান জানানো অন্যায় হতে পারে না। সুসম্পর্ক অটুট রেখেই তা করা সম্ভব।
সেটা অবশ্য নির্ভর করছে আমাদের শাসকশ্রেণীর উপলব্ধি এবং যোগ্যতা-দক্ষতার ওপর। ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কে নানা টানাপোড়েন রয়েছে। সেটা কম-বেশি থাকবেই। সেটা তো কূটনীতির আদি গুরু চাণক্য বহু আগেই স্থির করে রেখে গেছেন : ‘নিকটতম প্রতিবেশীর সঙ্গে স্বার্থের সংঘাত অবধারিত থাকবে’।
‘সাত বোন’ রাজ্যগুলোর প্রশ্নে বাংলাদেশ ও ভারতের দৃষ্টিভঙ্গির দ্বান্দ্বিক বাস্তবতাকে সেভাবেই দেখতে হবে এবং দীর্ঘমেয়াদে তিন পক্ষের (ভারত, বাংলাদেশ ও ‘সাত বোন’) জনগণের সর্বোচ কল্যাণের লক্ষ্য নিয়ে প্রকৃতি প্রদত্ত সব সম্পদ ও সম্ভাবনার সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার বিষয়টিকে সব কিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দিতে হবে। পারস্পরিক সহযোগিতার মধ্য দিয়েই তা সম্ভব।
বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় অবস্থান
ভারতের মূল ভূখণ্ড এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মধ্যস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। এ দ্বন্দ্বমুখর এলাকার রাজনীতি, অর্থনীতি ও জনবিন্যাসে বাংলাদেশের প্রকৃতি-নির্ধারিত কেন্দ্রীয় অবস্থান বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। বাংলাদেশকে বাদ দিয়ে, কিংবা তাকে অশান্ত, অস্থিতিশীল রেখে এ অঞ্চলের আঞ্চলিক ভারসাম্য রক্ষা করা কিছুতেই সম্ভব নয়। অশান্ত বাংলাদেশ চারপাশেই অশান্তি ছড়াবে, যা ভারতের জন্য কোনোভাবেই সুখকর হতে পারে না। ভারত নিশ্চিতরূপেই তা উপলব্ধি করে।
এখন এ অঞ্চলের সাত রাজ্যের প্রতিটিতে বিচ্ছিন্নতা বা স্বাধীনতাকামী বিভিন্ন গোষ্ঠী তৎপর। তাদের মোকাবেলা করতে এবং শান্তি ও স্থিতি রক্ষার প্রয়োজনে ভারতকে সেখানে প্রায় ৭ লাখ নিয়মিত সৈন্য বিপুল সমরাস্ত্র ও গোলাবারুদসহ সার্বক্ষণিকভাবে প্রায়-যুদ্ধাবস্থায় রাখতে হচ্ছে। বিদ্রোহীরা মিয়ানমার ও চীনে তাদের নৃতাত্ত্বিক স্বগোত্রীয়দের সঙ্গে মিশে গিয়ে নিরাপদ অবস্থানে থাকতে পারে। মাঝে মধ্যে তাদের দু’-চারজন বাংলাদেশেও ঢুকে পড়ে এবং আশ্রয় নেয়। ভাষা, চেহারা, খাদ্যাভ্যাসে মিল থাকায় তারা এখানে বেমালুম মিশে থাকতে পারে। বাংলাদেশ সরকারের দৃষ্টি এড়িয়েই তা হতে পারে।
সে কারণেই উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহকবলিত এলাকার ওপর স্বীয় কর্তৃত্ব বজায় রাখতে বাংলাদেশের সহায়তা ভারতের একান্ত প্রয়োজন। প্রয়োজন বাংলাদেশের ওপর দিয়ে সেখানে যাওয়ার ট্রানজিট ও করিডোর। এ একটি জায়গাতেই ভারত বাংলাদেশের ওপর ভীষণভাবে নির্ভরশীল।
বাংলাদেশের জনগণকে এবং বাংলাদেশের শাসক শ্রেণীকে নিজ দেশের ভৌগোলিক অবস্থানের এ কেন্দ্রিকতা উপলব্ধিতে নিয়ে তার ইতিবাচক ব্যবহারের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে এবং সে অনুযায়ী এ দেশের ভবিষ্যতের রূপরেখা বিনির্মাণ করতে হবে।
‘দশ ট্রাক অস্ত্র’ মামলা
এই নিরিখেই ‘দশ ট্রাক অস্ত্র’ মামলার বিষয়টির বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা হওয়া আবশ্যক।
এ মামলার ১৪ জনকে ফাঁসির দণ্ড দেয়া হয়েছে। আদালত একে ধ্বংসকর ও বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী কাজ বিবেচনায় কঠোরতম সাজা যুক্তিযুক্ত মনে করেছেন। আদালতের এ পর্যবেক্ষণে আসামিপক্ষ নিশ্চিতরূপেই আপত্তি জানাবে।
কিছু ভারতীয় নাগরিক যদি বাংলাদেশের ওপর দিয়ে কিছু পণ্য (তা অস্ত্রও হতে পারে) চোরাচালান করে, তাহলে বাংলাদেশ তার প্রাপ্য শুল্কাদি থেকে বঞ্চিত হয়। আবার সেই পণ্য যদি বেআইনি অস্ত্র হয়, তাহলে দেশের ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে তা এপার-ওপার করাটাও গুরুতর অপরাধ। দুটি কাজই দণ্ডনীয় সন্দেহ নেই। তবে চোরাচালানের জন্য একসঙ্গে ১৪ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া অনেকের কাছেই লঘু পাপে গুরুদণ্ড মনে হতে পারে।
তাছাড়া এ মামলায় আমাদের দুটি প্রধান রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার দু’জন সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তাকেও মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। তাদের অপরাধ, তাদের জ্ঞাতসারে এটা ঘটেছে। এ বিষয়টিতে বিএনপির কথিত ‘হাওয়া ভবন’ এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সম্পৃক্ততা রয়েছে বলেও আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে। এখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সে ব্যাপারেও তদন্ত হবে এবং প্রয়োজনে তারও বিচার হবে।
এমনিতেই এ বিচার প্রক্রিয়া আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পৃক্ত বহু গোপনীয়তা বাইরে নিয়ে এসেছে। সংশ্লিষ্টরা যদি অর্থের বিনিময়ে বা বিশেষ কোনো স্বার্থে এতে সম্পৃক্ত হয়ে থাকেন, তাহলে তাদের অবশ্যই বিচার হওয়া উচিত। কিন্তু যদি তারা তৎকালীন সরকারের অনুসৃত নীতি অনুযায়ী কিংবা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনায় কাজ করে থাকেন, তাহলে সে জন্য তাদের গুরুদণ্ড প্রদান করা গোটা রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের মৌল ভিত্তিতে আঘাত করার শামিল। হতে পারে ওই সময় যারা দেশের কর্তৃত্বে ছিলেন তারা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহীদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন (এ দেশে লাখ লাখ মানুষের তেমন সহানুভূতি আছে)। হতে পারে তখনকার সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি সেরকম ছিল। একটি স্বাধীন দেশের সরকার তার জাতীয় স্বার্থের বিবেচনাতেই তেমন দৃষ্টিভঙ্গি নিতে পারে। এক সরকারের আমলে অনুসৃত নীতি বা দৃষ্টিভঙ্গি পরবর্তী সরকারের আমলে পাল্টে যেতে পারে। তখন যদি পূর্ববর্তী সরকারের নির্দেশ মান্য করার জন্য কোনো রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাকে শাস্তি দেয়া হয়, তাহলে কোনো সরকারি কর্মকর্তার পক্ষেই রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা মেনে কাজ করা সম্ভব নয়।
বিশেষ করে এতে যদি কোনো জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা বা সশস্ত্র বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে হাতকড়া পরিয়ে ঘোরানো হয় এবং মৃত্যুদণ্ডের মতো সাজা দেয়া হয়, তাহলে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের সদস্যদের মনোবল ভেঙে পড়াই স্বাভাবিক। কোনো কারণে যদি এ ধরনের ঘটনার বিচার করতেও হয়, তার প্রয়োজনীয় গোপনীয়তা রক্ষা করা অত্যাবশ্যক। দশ ট্রাক অস্ত্র মামলাটি যেভাবে পরিচালিত হয়েছে তাতে আমাদের স্পর্শকাতর রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তার কিছুই আর গোপন থাকেনি। যা বর্তমান রাষ্ট্রনেতাদের জন্যও আগামীতে বিব্রতকর হতে পারে।
‘চোরাচালানে’র ঘটনার এত গুরুত্ব কেন?
এ চোরাচালানের ঘটনাটি এত গুরুত্ব পেয়েছে কেন? দেশের চারপাশেই তো প্রতিনিয়ত কত চোরাচালানের ঘটনা ঘটছে। জাতীয় অর্থনীতিতে ধস নামার মতো ঘটনা ঘটছে। বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশীর প্রতি আমাদের দায়-দায়িত্ব রয়েছে, সেই দেশে রক্তারক্তি ঘটানোর কাজে সহায়তা করা বন্ধুসুলভ আচরণ নয়। সেজন্য যথাযথ শাস্তি হোক। কিন্তু তাকে ভয়ংকর জাতিদ্রোহী কাজ মনে করতে হবে কেন? এ রকম ঘটনা কি পৃথিবীতে আর কোথাও ঘটেনি, বা ঘটছে না?
সারা পৃথিবীতে এ ধরনের অনেক পরিস্থিতির নজির আমাদের সামনে রয়েছে। তার দীর্ঘ তালিকা তৈরির প্রয়োজন নেই। শ্রীলংকার তামিল বিদ্রোহে ভারতের ভূমিকার কথাই ধরা যাক। এটা সর্বজনবিদিত যে এ বিদ্রোহ ছিল ভারতের কর্তাব্যক্তিদের একাংশের মস্তিষ্ক-প্রসূত। তারা নিশ্চয়ই একে ভারতের জন্য লাভজনক মনে করেছেন। ভারতের প্রত্যক্ষ মদদেই এ বিদ্রোহের সূচনা। কিন্তু অল্পদিনেই তা বুমেরাং হতে থাকে। সিংহলি তামিলদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ভারতীয় তামিলরাও স্বাধীন তামিলনাড়– রাষ্ট্র গড়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করলে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। তারা তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে নেন। ততদিনে বিষয়টি বহুদূর গড়িয়েছে। বিদ্রোহীরা তাতে ক্ষেপে যায়। শেষতক একজন জনপ্রিয় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে প্রাণ দিয়ে তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়েছে।
কিন্তু সে জন্য কি ভারতের সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারক বা গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের কাউকে প্রকাশ্য বিচারে প্রাণদণ্ড দেয়া হয়েছে?
ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী : রাজনীতিবিদ, ভূরাজনীতি ও উন্নয়ন গবেষক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন