সহিংসতার মধ্য দিয়ে জানুয়ারির (৫ তারিখে) সংসদ নির্বাচন শেষ, ২১ জনের প্রাণের বিনিময়ে। অবশ্য মৃত্যুর আসল পরিসংখ্যান শত সংখ্যারও ওপরে। কারণ নির্বাচন নিয়ে দুই প্রধান দলের মতভেদ, জেদ ও অনড় অবস্থানের কারণে সহিংসতার সূচনা তো গত মাস দুয়েকের। এ ঘোলাটে পরিস্থিতিতে হিংস্রতা ও সাম্প্রদায়িকতার প্রকাশ জামায়াতি তৎপরতায়। তাদের লক্ষ্য যত না নির্বাচন, তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি তাদের ঘাতক নেতাদের বিচার বন্ধ করা। বলতে গেলে মূলত এটাই তাদের প্রধান ইস্যু, যা তাদের কিছুটা হলেও অস্তিত্বের লড়াই।
তাই বিশ্লেষকদের প্রায় সবাই একমত যে গত কয়েক মাসের সহিংসতা, বোমা হামলা, নাশকতা, পুলিশ হত্যা, থানা ও অফিস পোড়ানোর মূল হোতা জামায়াতের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ক্যাডার বাহিনী। এদের হাতেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পোড়ানোর ধ্বংসযজ্ঞ শুরু। ভোটকেন্দ্র হিসেবে নির্বাচিত কয়েক শ বিদ্যালয় ও মাদ্রাসায় বোমা হামলা, পেট্রল ঢেলে আগুন, পুড়ে ছাই শিক্ষায়তন। এ ঘটনা অন্তত ৩৪টি জেলায়।
সহিংসতার ঘটনা যেখানে এতটা ব্যাপক, সেখানে কোথায় আইনশৃঙ্খলার রক্ষক যৌথবাহিনী ও সেনাবাহিনী? নির্বাচন কমিশন কী জবাব দেবে এমন ধ্বংসযজ্ঞের? সেই সঙ্গে বিভিন্ন জেলায় ব্যালট পেপার ও ভোট বাক্স ছিনতাই করে আগুনে পোড়ানোর ঘটনাও দেখা গেছে। অথচ সেনাবাহিনীকে মাঠে নামিয়ে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল নির্বাচন কমিশন (সিইসি) ও সরকার। কার্যত তা ভণ্ডুল হয়েছে, যেমনটা আশঙ্কা ছিল মানুষের।
অন্যদিকে লন্ডন থেকে তারেক রহমানের ভিডিও বার্তা : 'নির্বাচন প্রতিহত করতে দলের নেতা-কর্মীসহ সবাই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ুন।' এ আহ্বানে জনগণ সাড়া না দিলেও, তাদের দল ততটা তৎপর না হলেও জামায়াত-শিবির তাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। তুলেছে অনেক প্রাণ হরণ করে, নতুন বই হাতে শিশুদের আনন্দ নষ্ট করে এবং জাতীয় সম্পদের ব্যাপক ধ্বংসের মাধ্যমে। বৈনাশিকতা থেকে বাদ পড়েননি নির্বাচনী কর্মকর্তা। দায়িত্ব পালনের দায়ে মৃত্যু কর্মতৎপরতার মাশুল হিসেবে রাজনৈতিক ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে রইল।
বিরোধী দলের, বিশেষত জামায়াত-শিবিরের হিংস্র উন্মত্ততার আলামত লক্ষ করে দেশের সুধীসমাজ অগ্রিম সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিল তাদের বক্তব্য-বিবৃতি, আলোচনা ও লেখায়। কিন্তু তাতে কান দেয়নি কর্তৃপক্ষ। যেকোনো মূল্যে হোক, একতরফা হলেও হোক, নির্বাচন করতেই হবে। ঠিক যেমন দেখা গিয়েছিল ১৯৯৬ সালের একতরফা নির্বাচনে অনমনীয় জেদ ও স্বার্থবুদ্ধির প্রকাশ। সে নির্বাচন টেকেনি। সে ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নেওয়ার কারণ সংবিধান সংশোধনের জেরে সাংবিধানিক সংগতি।
কিন্তু সংগতি সব সময় বাস্তবতার পক্ষে যায় না। যায়নি এবার, প্রধান বিরোধী দলকে না নিতে পেরেও নির্বাচন অনুষ্ঠিত। কিন্তু এ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিপক্ষে গেছে বিদেশি মতামত। তাদের চেষ্টায়ও কঠিন দ্বন্দ্বের বরফ গলেনি। দুই দল যে যার অবস্থানে অনড় পাথুরে দৃঢ়তা নিয়ে। যে দৃঢ়তা যুক্তিতর্ক মানে না। আপন স্বার্থের বিষয়টাই বোঝে। এ বিষয়ে রয়েছে দুই দলেরই দায়, কম আর বেশি। তাই নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগেই সহিংসতার প্রকাশ। মানুষ, রাস্তা-ঘাট, যানবাহন, বৃক্ষরাজি সে সহিংসতার শিকার। কথিত নিরাপত্তা অনেকটা কথায়ই সীমাবদ্ধ।
যেখানে জামায়াত-শিবিরের হুমকিতে ভোটকেন্দ্র প্রায় ভোটারশূন্য, কোথাও কোথাও নির্বাচনসংশ্লিষ্ট নেতা-কর্মীদেরও যেখানে দেখতে পাওয়া যায়নি, যেমন সাতক্ষীরা, এমন নিরাপত্তাহীন পরিস্থিতিতে কি প্রধান বিরোধী দলবিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠান যুক্তিসংগত? বিশেষ করে যখন সেনাবাহিনীর উপস্থিতি সত্ত্বেও আতঙ্কিত মানুষ, সেই সঙ্গে ভোটার? অথচ অনেকেরই ধারণা ছিল, সেনাবাহিনী মাঠে থাকলে 'সব ঠিক হয়ে যাবে'- টিভি সিরিয়ালের ডায়ালগের মতো বক্তব্য!
কিন্তু সব ঠিক হয়নি। প্রমাণ নির্বাচনকালীন ঘটনা- মৃত্যু, আগুন, ধ্বংসযজ্ঞ, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, এমনকি অসহায় মালোদের ওপর হামলা (এদের বিতাড়ন হয়তো জামায়াতিদের উদ্দেশ্য, কিন্তু কী উপকার তাতে?)। মানুষ, মনুষ্যত্বের প্রাণী, এমনকি উদ্ভিদও সহিংসতার হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অপারগ আইনি কর্তৃপক্ষ। সেখানে একতরফা নির্বাচন বাতিল করে সমঝোতার পথ ধরাই তো সঠিক ছিল। সেই পথে সর্বদলীয় নির্বাচন। তবে এ ক্ষেত্রে বিরোধী দলের অনড় অবস্থানও বিবেচ্য। তারা কি জামায়াত-নিরপেক্ষ সমঝোতায় আগ্রহী? বিদেশি কূটনীতিকদের চতুর কূটনীতি এই বিশেষ দিকটিতে মনোযোগ দিলে ভালো হতো। কিন্তু কোন স্বার্থের টানে তাদের এ বিষয়ে অনীহা?
যা-ই হোক, মৃত্যু রক্ত আগুন ধ্বংসযজ্ঞ নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন সবেমাত্র শেষ হয়েছে। এবার সংসদীয় পদ্ধতিমাফিক মন্ত্রিসভা গঠনের পালা। কিন্তু এ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য যৌক্তিক নির্বাচন হিসেবে মানতে নারাজ বিরোধী দলগুলো, নারাজ ইউরো-ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র। তেমনি বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী ও নাগরিক সমাজের বৃহৎ অংশ, এমনকি ক্ষমতাসীন দলের কিছুসংখ্যক বুদ্ধিজীবীও। 'বাঙালিদের নাকি ঝোপ বুঝে কোপ ফেলতে' অসুবিধা হয় না, মন্তব্য হুতোম প্যাঁচার লেখক কালিপ্রসন্ন সিংহের। সেই উনিশ শতকে। আমরা কি সে ঐতিহ্য এখনো বহন করছি?
কিন্তু সময় এখন ভিন্ন, সমাজ, রাজনীতি ও সংস্কৃতিও তাই। বিশেষ করে বিশ্বরাজনীতি এখন বড় বেশি সক্রিয় ও সজাগ, প্রধানত তাদের রাজনৈতিক স্বার্থের বিবেচনায়। তারা গোড়া থেকেই সর্বদলীয় নির্বাচনের পক্ষে অনেক দৌড়ঝাঁপ, অনেক দেনদরবার করে হতাশ, তবু চেষ্টার বিরাম নেই। কারণ যে নির্বাচনের ১৫৩টি আসনে প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত এবং বাকি ১৪৭ আসনের নির্বাচন ভোটার উপস্থিতি নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ, সে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
তুলনামূলক বিচারে নিরপেক্ষ হিসেবে পরিচিত বিশিষ্ট নাগরিক কেউ কেউ 'একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের' মধ্য দিয়ে সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব বলে মতামত প্রকাশ করেছেন। অবশ্য এ বক্তব্য নির্বাচন শুরুর আগেই বিভিন্ন কণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছিল। এখন নির্বাচন শেষ হওয়া সত্ত্বেও দেশে সহিংসতা বন্ধ হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। বরং ধারণা, জানমালের নিরাপত্তার অভাব ও সামাজিক-অর্থনৈতিক অস্থিরতা-অস্থিতিশীলতা সামনের দিনগুলোতে বাড়বে বৈ কমবে না। সেনাবাহিনীর উপস্থিতি সত্ত্বেও সহিংস তৎপরতার ব্যাপকতা তেমন আভাসই দেয়।
বিশেষ করে ১৮ দলীয় জোট যখন প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছে যে তারা একতরফা নির্বাচনের ফলাফল ও শাসনব্যবস্থা বানচাল করতে লাগাতার কর্মসূচি দিতে থাকবে, তখন এ ক্ষেত্রে বিকল্প বা দ্বিতীয় ভাবনার অবকাশ রয়েছে। কারণ এ সুযোগ জামায়াত-শিবির পুরোপুরিই নেবে, অতীতে নিয়েছে এবং অনেক অঘটন ঘটিয়েছে। রেললাইন উপড়ানো, ট্রেন-বাসে পেট্রলবোমা ছুড়ে মানুষ পোড়ানো, হাজার হাজার গাছ কাটার ঘটনা এর আগে কেউ দেখেছে? এমনকি ১৯৯৬ সালের অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের বিরুদ্ধেও এ জাতীয় ভয়াবহ নাশকতা ও সহিংসতার ঘটনা দেখা যায়নি। এর অর্থ বর্তমান প্রতিপক্ষ অনেক বেশি বৈনাশিক ক্ষমতার অধিকারী, যা পুরোপুরি বন্ধ করতে কর্তৃপক্ষ অপারগ সশস্ত্রবাহিনীর সহায়তা সত্ত্বেও।
লক্ষ করার বিষয় যে নির্বাচন উপলক্ষে এবং এর আগেও প্রকাশ্য ও চোরাগোপ্তা হামলায় যেমন প্রাণ হারিয়েছে সাধারণ মানুষ, বাসযাত্রী ও পথচারী, তেমনি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের আক্রমণে খুন হয়েছেন জেলা ও থানা পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতা, ইউনিয়ন ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। এ হামলা বর্তমানে ও নিকট-ভবিষ্যতে শাসনযন্ত্র ও শাসনব্যবস্থা অচল করতে আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কাই বেশি।
জামায়াত-শিবিরসহ ইসলামপন্থী মৌলবাদীদের সংঘবদ্ধ হওয়ার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা যথেষ্ট। কারণ তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহক দলগুলোকে ভারতপন্থী বলে মনে করে, বিশেষ করে জাতীয়তাবাদীদের। তারা নিজেরা যে পাকিস্তানপন্থী এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ কম। তারা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপরও হামলা চালিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা করছে এবং আরো করবে। নয়া সরকারের পক্ষে কি সম্ভব হবে সে চেষ্টা ও দেশব্যাপী নাশকতার মোকাবিলা করা? বিগত অভিজ্ঞতাও অবস্থাদৃষ্টে তেমন সম্ভাব্যতার ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না সাধারণ মানুষ। তাদের কথাবার্তায় তেমন প্রমাণই মিলছে।
স্বভাবতই জননিরাপত্তার অভাব, মানুষের জীবিকার অনিশ্চয়তা, বিশেষ করে নিম্নবর্গীয়দের এবং সম্ভাব্য অর্থনৈতিক সংকট, বহির্বিশ্বের প্রতিকূল মনোভাব, ক্ষেত্রবিশেষে বিরূপতা, সর্বোপরি চলমান সহিংসতার মুখে নতুন ক্ষমতাসীনরা পরিস্থিতির যথাযথ মোকাবিলা করতে কি সক্ষম হবে? এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ সবাইকে ভিন্নমত পোষণ করতে দেখছি। তাঁদের মতে, সেটা সম্ভব হবে না। দেশ অবাঞ্ছিত পরিণামের দিকে এগিয়ে যাবে।
তাই এ মুহূর্তে সংখ্যাগরিষ্ঠ অভিমত, যা হয়েছে তার তো আর চারা নেই। এখন নয়া ক্ষমতাসীনদের পক্ষে দরকার সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে যত দ্রুত সম্ভব একাদশ সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নতুন নির্বাচনের পক্ষে ঐকমত্যে পৌঁছানো। এবং তেমন ভিত্তিতে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা নেওয়া।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, পরামর্শ দেওয়া সহজ, এমনকি যুক্তিসংগত পরামর্শও। তা গ্রহণ করানো বড় কঠিন বাস্তবতা। সে কঠিন বাস্তবতা দীর্ঘ সময় ধরে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিরাজমান। সেখান থেকে বেরিয়ে আসা যুযুধান দুই প্রধান দলের পক্ষে কি আদৌ সম্ভব, তাদের অহংবোধ, অনমনীয় জেদ পরিহার করে, সর্বোপরি রাজনৈতিক স্বার্থবোধ থেকে মুক্ত হয়ে? বর্তমান সাংঘর্ষিক রাজনীতি তেমন ইঙ্গিত দেয় না। কিন্তু সংঘাতের পরিণাম যে অশুভ বার্তা বহন করছে, সে সত্য অনুধাবন না করলে দেশের স্বার্থ, সবার স্বার্থই বিপন্ন হবে।
লেখক : গবেষক ও ভাষাসৈনিক
(কালের কণ্ঠ, ০৯/০১/২০১৪)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন