হরতাল নতুন কিছু নয়, বহু দিনের প্রতিবাদী তৎপরতা। যেমন অবিভক্ত ভারতে, তেমনি পাকিস্তানি আমলের পূর্ববঙ্গে, পরে পূর্ব পাকিস্তানে। টক শোতে বা আলোচনায় বা বিবৃতি-বক্তৃতায় একটি কথা সজোরে উচ্চারিত হয়ে থাকে, 'হরতাল আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার, আমাদের প্রতিবাদের ভাষা।' ভালো কথা। হরতাল একদা আমরাও করেছি। কিন্তু হরতালের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি কি মানুষ মারা, গাড়ি পোড়ানো, গাড়ি ভাঙচুর, এমনকি হরতালের এক দিন আগেই ভাঙচুরের মহড়া শুরু? এমন তো নয় যে মানুষজন হরতাল অমান্য করে গাড়ি নিয়ে রাস্তায় বেরিয়েছে বা সিএনজি-অটোরিকশাতে হাসপাতালে যাচ্ছে জরুরি কাজে। এ দেশে অ্যাম্বুল্যান্স পাওয়া তো বিরাট ভাগ্যের ব্যাপার। তবু ভাঙচুর, তবু অগ্নিসংযোগ কোন যুক্তিতে? রাজনৈতিক নেতারা এসব প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারবেন, তাঁরা যে দলেরই হোন না কেন?
না, পারবেন না। কারণ এ জাতীয় একাধিক দুষ্কর্মের অপসংস্কৃতি রাজনীতির মাথায় চড়ে বসেছে। তাই অবৈধ ও অন্যায় ভাঙচুর, আগুন, হত্যা চোখের সামনে ঘটছে দেখেও চুপ করে থাকেন নেতারা। সংবাদ সম্মেলনে দুনিয়ার অভিযোগ আনেন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে, কিন্তু ভুলেও এ অপসংস্কৃতির কথা বলেন না। হরতালের পক্ষে যুক্তি দেখান, কিন্তু হরতালে সংঘটিত সহিংসতা ও মৃত্যুর কথা বলেন না।
যে সিএনজি-অটোরিকশাটি পুড়িয়ে দেওয়া হলো, সেটি হয়তো মালিকের আয়ের একমাত্র সম্বল- জনগণের নামে, জনগণের স্বার্থের কথা বলে তাদের কারো কারো স্বার্থ নষ্ট করা কোন গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে জায়েজ? তবু সব দলেরই ডাকা হরতালে ইদানীং এসব অপকর্ম ঘটছে, তাতে নেতাদের বিবেকে লাগে না, তাঁদের চেতনায় দাগ পড়ে না। বিনা অপরাধে যে মালিকের গাড়িটি পুড়ল, সেটা হয়তো তার একমাত্র বাহন ও সম্বল। এটা পোড়ানো কি সঠিক কাজ হলো? নাইবা হলো একমাত্র সম্বল, তবু তা পোড়ানোর অধিকার হরতালের নামে তৎপর দুর্বৃত্তদের কে দিয়েছে, মহান নেতৃবৃন্দ তা বলতে পারবেন?
হ্যাঁ, আমি আজ এ অনৈতিক কাজের প্রতিবাদ করতেই লিখতে বসেছি; যদিও লেখার কথা ছিল টক অব দ্য সিটি দুই নেত্রীর ফোনালাপের পরিণতি ও পরবর্তী রাজনীতি ও দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে। তবু অনালোচিত একটি বিষয় নিয়েই আজ বলতে চাচ্ছি ও লিখছি, যা নিয়ে টিভি টক শোর ধীমানদের কখনো বলতে শুনি না, পত্রিকার কলামেও তেমন লেখা চোখে পড়ে না। তাই রাজনীতিবিদদের প্রতি অনুরোধ, হরতালের সহিংসতা বন্ধ করুন, লাগামহীন উচ্ছৃঙ্খলতা বন্ধ করতে কর্মীদের রাশ টেনে ধরে শান্তিপূর্ণ হরতালের মতো হরতাল পালনে বাধ্য করুন। মানুষের জানমালের ওপর আঘাত যেন বন্ধ হয়। তেমন উদাহরণ এ দেশে কম নেই। পঞ্চাশের দশকের এত হরতালে হরতালকারীদের হাতে সহিংসতা ঘটেনি, ঘটেছে পুলিশের তরফে। প্রতিবাদী মারা গেছেন পুলিশের গুলিতে, প্রতিবাদীদের হাতে একজন পুলিশও নয়।
এবার মূল কথায় ফিরি। দেশের মানুষ গত দুই দিন মহা উদ্বেগে কাটিয়েছে। প্রথম দিন দুই নেত্রীর ফোনালাপ ও সম্ভাব্য ফোনালাপের শুভ সংবাদের আশায়। মহানগরের প্রায় সর্বত্র ও প্রতি বাড়িতে মানুষ টিভির সামনে বসা, কখন শুরু হবে ফোনালাপ। শেষ পর্যন্ত যদিও তা হলো, মূলত প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে, তবু তা নেতিতে শেষ হলো।
মানুষের প্রত্যাশা ছিল, ফোনালাপের শান্তিপূর্ণ পরিবেশের মধ্য দিয়ে ৬০ ঘণ্টার টানা হরতাল বন্ধ হয়ে মানুষের দুর্ভোগ কমবে। কিন্তু আমাদের মন্দ ভাগ্য- দুই নেত্রীর আলাপে মধুরেণ সমাপয়েৎ নয়, বরং ভিন্ন মতে। বিরোধীদলীয় নেত্রী আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন, তবে তা হরতালের হাঙ্গামা শেষ করে। বুঝতে চাইলেন না, সুযোগের যথাসময়ে সদ্ব্যবহার রাজনৈতিক অঙ্গনে বিচক্ষণতা হিসেবে বিবেচ্য। তিনি তাঁর পূর্বঘোষণায় অটল রইলেন। আমাদের প্রশ্ন, সংলাপ ও আন্দোলন কিভাবে একসঙ্গে চলে? এটা যুক্তিসংগত নয়।
হরতালের সহিংসতায় এই যে নিরীহ, নিরপরাধ পাঁচজন মানুষ মারা গেলেন, অর্ধশতাধিক গাড়ি ভাঙচুর করা হলো, পুলিশসহ অর্ধ সহস্রেরও অধিক মানুষ আহত, এর দায় অবস্থাদৃষ্টে হরতাল আহ্বানকারীদের। অনবরত ককটেল বিস্ফোরণের বিশৃঙ্খলা কি হরতালের নীতিধর্মে পড়ে? ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে, দলীয় কার্যালয়ে হামলা, ট্রেনে আগুন- এসব সহিংসতা কি হরতালের আওতায় পড়ে? তবু এসব ঘটছে এবং ঘটেছে। কী তাদের অপরাধ যে রাজনীতির টানাপড়েনে তাদের প্রাণ দিতে হবে? এই যদি হয় রাজনীতি, তাহলে ধিক সেই রাজনীতি!
আমরা স্বৈরাচার সরিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছি বলে গর্ব করি। কিন্তু গণতন্ত্রের আলামত কি সংঘাত, বাস, মাইক্রো, গাড়ি, অটো পোড়ানো? এবং সমস্যা সংকটে নিজ মতে অটল থাকা? সমাজের বিশিষ্টজন সবাই তারস্বরে চিৎকার করে চলেছেন টিভির টক শোতে (যদিও সেখানে দলমত অন্ধতা ও অসহিষ্ণুতা কম দেখি না), লেখা হচ্ছে পত্রপত্রিকাতে। কিন্তু গণতান্ত্রিক ঔদার্য, গণতান্ত্রিক নমনীয়তা চোখে পড়ছে না।
পরস্পরের প্রতি অন্তহীন অভিযোগ চলছেই। উভয় পক্ষের দ্বিতীয় পর্যায়ের নেতারা যেভাবে আঙুল উঁচিয়ে চিৎকার করে কথা বলছেন, তাতে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। যুক্তির প্রতি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা না রেখে 'অবৈধ সরকার' নিয়ে কথা ও 'সরকার পতনের' আহ্বান জানানো হচ্ছে; আবার সংলাপের কথাও বলা হচ্ছে। সরকার যদি অবৈধই হয়, তাহলে সংলাপের অবকাশ কোথায়? কম-বেশি উভয় ক্ষেত্রে নেতাদের মুখে যত স্ববিরোধী উচ্চারণ!
তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মধ্যপন্থী বা নিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবী বা আইনজীবীদের অভিমত, বিরোধীদলীয় নেত্রীর পক্ষে সংলাপে না বসা ও হরতাল প্রত্যাহারের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করা যুক্তিসংগত হয়নি। বরং নেতা-কর্মীদের মুক্তির দাবিতে সংলাপে বসার কথকতা চলতে পারত। এ কথা বলার কারণ বিএনপির প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রশ্নটি বড় করে তোলা হয়েছে। কিন্তু সে জন্য তাঁরা অপেক্ষা করেননি। হরতাল ঠিকই চালু রেখেছেন, যে হরতালে আমরা দেখেছি সহিংসতাই বড় হয়ে ওঠে। ককটেল, আগুন, বোমাবাজি, ডাণ্ডাবাজি চলে, আর পুলিশের পক্ষে চলে পাল্টা তৎপরতা।
কেন জানি মনে হচ্ছে, সংলাপে বিরোধী দলের আগ্রহ কম, বিশেষ করে তাদের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ও দু-একজন নেতার কথায় তেমনই মনে হচ্ছে। প্রেস ব্রিফিংয়ে ক্রমাগত অভিযোগ, ইতিবাচক দিকগুলো অনুচ্চারিত থেকে যাচ্ছে। এর কারণ কি দলে জামায়াতের প্রভাব? কারণ জামায়াতের এখন একমাত্র লক্ষ্য সহিংসতা, বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য, রক্ত, হত্যা, আগুন। তারা জানে, সংলাপে বসলে এসব অনাচারের সুযোগ থাকবে না। তাই আমাদের প্রত্যাশা, বিএনপি যদি সংলাপে সত্যি আগ্রহী থাকে, এবার তাদের পক্ষ থেকেই সংলাপের দিনক্ষণ ঠিক করে সরকারকে জানানো দরকার। হয়তো তাদের দলে একাধিক মতামত রয়েছে। সে ক্ষেত্রে উদারপন্থী তথা সংলাপপন্থীদের নড়েচড়ে বসা দরকার। দরকার জনমত লক্ষ করে সাহসের সঙ্গে দলের অভ্যন্তরে শান্তিপূর্ণ সমাধানের পক্ষে অভিমত প্রকাশ করা। 'বাজপাখি রাজনীতি' সব সময় কাজে আসে না। কখনো বুমেরাং হয়ে দাঁড়ায়। ভাবা দরকার, সংলাপ ও সমঝোতার বিকল্প নেই। বিষয়টা বহু আলোচিত। তাই গণতন্ত্রকে বুড়িগঙ্গায় ভাসানো ঠিক নয়। দরকার আলোচনা।
আলোচনা চলতে পারে দুই প্রস্তাবের সারাৎসার বা সংবিধানের আওতায়, কিন্তু নতুন কোনো প্রস্তাব নিয়ে আলেচনা চালানো। ইতিমধ্যে একাধিক প্রস্তাব এসেছে। সেগুলো থেকেও কিছু উপকরণ সংগ্রহ করা সম্ভব। আমরা সবাই জানি, এ ক্ষেত্রে বড় সমসা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান কে হবেন, তা নিয়ে। অনেকেরই অভিমত নির্দলীয় ব্যক্তির পক্ষে। ইতিমধ্যে কিছু নামও বিভিন্নজনের লেখায় উঠে এসেছে। এর বাইরেও নির্দলীয়, উদারপন্থী আইনজীবী ও পেশাজীবী আছেন (নাম না বলাই বোধ হয় সংগত) যাঁদের মধ্য থেকে একজনকে সরকারপ্রধান হিসেবে বাছাই করে নেওয়া সম্ভব।
বর্তমান নির্বাচনী সংকটে এ বিষয়টির সমাধান সবার আগে দরকার, বাকি কজন বাছাই তখন কঠিন হবে না। সময় দ্রুত বয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে ব্যবস্থা না নিলে প্রথমত, সাংবিধানিক সংকট দেখা দেবে, দ্বিতীয়ত, একতরফা নির্বাচনের সম্ভাবনা বা নামকাওয়াস্তে বহুদলীয় নির্বাচনের সম্ভাবনা দেখা দেবে, যা দেশ-বিদেশে, আন্তর্জাতিক মুরব্বি মহলে গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হবে না। মুরব্বি ছাড়া চলার রাজনীতি তো আমরা এখন পর্যন্ত তৈরি করিনি। করতে চাইনি বা পারিনি।
তাই আর দেরি নয়, মোটেই দেরি নয়। দরকার দ্রুত আলোচনায় বসা এবং প্রথমেই অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান সম্পর্কে ঐকমত্যে পৌঁছানো। সেই সঙ্গে সরকারের কম্পোজিশন নিয়ে একমত হওয়া। সদিচ্ছা থাকলে কাজ কঠিন নয়। সম্ভাব্য বাধার জায়গা দুটোও কারো অজানা নয়। সে দুই বাধা যেকোনো মূল্যে হোক অতিক্রম করতে হবে। ব্যর্থ করতে হবে জামায়াতের ষড়যন্ত্র। সে জন্য প্রয়োজনবোধে সরকারকে পূর্ব উদাহরণ মনে রেখে এক পা বাড়াতে হতে পারে। তাতে অমর্যাদার কিছু নেই। কারণ সেটা গণতন্ত্র রক্ষার স্বার্থে। উল্লেখ্য, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে প্রধানমন্ত্রীর ফোন জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত প্রশংসা কুড়িয়েছে। বিনয় তার প্রাপ্য আদায়ে পিছু হটে না।
লেখক : গবেষক ও ভাষাসৈনিক
(কালের কন্ঠ, ৩১/১০/২০১৩)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন