Image description

ইতিহাসে কিছু মানুষ আসেন, তারা দীর্ঘদিন বাঁচেন না; কিন্তু যুগের দিকচিহ্ন হয়ে থাকেন। তারা কেবল বক্তা নন, কেবল কর্মী নন, কেবল শহীদও নন; তারা একেকটি যুগের মুয়াজ্জিন। তারা সময়কে জাগিয়ে তোলেন, ঘুমন্ত বিবেককে আজান শোনান। শহীদ ওসমান হাদি ছিলেন ঠিক তেমনই এক নয়া জমানার মুয়াজ্জিন।

এক স্মরণীয় দিন, দুই মঞ্চ, এক চরিত্র : ২৮ অক্টোবর, ২০২৪। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোজাফফর আহমদ চৌধুরী অডিটোরিয়ামে ‘From Uprising to Revolution: Roads Ahead for Bangladesh’ শিরোনামে আয়োজিত এক সেমিনারে আমি প্রধান বক্তা ছিলাম। পলিটিকাল সায়েন্স ডিপার্টমেন্টের ইতিহাসে এটি ছিল ইসলামের পক্ষে এবং ভারতের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রথম সেমিনার। সেই দিনই আমি বলেছিলাম, শেখ হাসিনা বাংলার তিন হাজার বছরের লিখিত ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ফ্যাসিস্ট শাসক। কথাটা সহ্য করতে না পেরে কয়েকজন ফ্যাসিস্ট শিক্ষক সেমিনার কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। ইতিহাসের সত্য উচ্চারণ এমনই—কারো কাছে আগুন, কারো কাছে আলো।

সেদিন বিকালেই জাতীয় প্রেস ক্লাবে ইনকিলাব মঞ্চ আয়োজিত সংবিধান সংশোধন-বিষয়ক আরেকটি অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করার সুযোগ পাই। প্রধান অতিথি ছিলেন ড. মাহমুদুর রহমান। আর সেই অনুষ্ঠানের আয়োজক ও পরিচালক ছিলেন শরীফ ওসমান হাদি। সেখানেই খুব কাছ থেকে হাদিকে দেখার সুযোগ হলো। আমি আবিষ্কার করলাম তার সাতটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য।

এক. অসাধারণ বাগ্মিতা : তার বক্তৃতা ছিল deeply captivating—মনে হতো শব্দ নয়, বজ্রপাত নেমে আসছে। অনেক সময় mind-boggling; কারণ সে শুধু কথা বলত না, চিন্তার খোল ভেঙে দিত।

দুই. বাংলাদেশের সমস্যার গভীর বোঝাপড়া : বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সংকট, ক্ষমতার কাঠামো, জনমানুষের ক্ষোভ—এসব নিয়ে তার যে বোঝাপড়া, তা বহু উচ্চশিক্ষিত মানুষের মধ্যেও আমি পাইনি।

তিন. ফ্যাসিবাদের উৎস নিয়ে চরম পেরেশানি : বিশেষ করে কালচারাল ফ্যাসিবাদ, যা ভাষা, ইতিহাস, মিডিয়া ও শিক্ষার ভেতর ঢুকে সমাজকে নিঃশব্দে বন্দি করে; এটা মোকাবিলায় সে ছিল নিরলস।

চার. দেশপ্রেমের সীমাহীন আবেগ : বাংলাদেশ, এদেশের মানুষ, এদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব—এসব ছিল হাদির শ্বাস-প্রশ্বাস।

পাঁচ. ইনসাফভিত্তিক সমাজ গঠনের অনন্ত প্রয়াস : ইনসাফ ছিল তার রাজনৈতিক দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু—ক্ষমতা নয়, ন্যায়।

ছয়. দুর্নীতি ও বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশের সংগ্রাম : সে জানত, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই মানে একা দাঁড়ানো। তবু সে পিছিয়ে যায়নি।

সাত. আধিপত্যবাদ ও বিদেশি দাসত্বের বিরুদ্ধে অবস্থান : কলোনিয়ালিজম, ইম্পেরিয়ালিজম, হেজেমনি, আগ্রাসনসহ সব ধরনের আধিপত্য থেকে স্বদেশকে মুক্ত করার স্বপ্নই ছিল তার রাজনীতি।

এই সাতটি বৈশিষ্ট্য দেখে আমি গভীরভাবে আশাবাদী হয়েছিলাম। মনে হয়েছিল, এই হাদিরা থাকলে বাংলাদেশ পথ হারাবে না।

হাদি কীভাবে ‘হাদি’ হয়ে উঠলেন : ওই প্রোগ্রামের পর আমি তাকে ফলো করতাম পত্রিকার পাতায়, ফেসবুকের রিলে ও হোয়াটসঅ্যাপ আলোচনায়। বিস্মিত হতাম তার সততা, নিষ্ঠা, কমিটমেন্ট, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা দেখে। তার মিশনে ছিলেন পাগলপারা। শিকল ভাঙার ঝড় তুলতেন। যেকোনো প্রশ্ন, যেকোনো শক্তি, যেকোনো ব্যক্তিকে তিনি ফেস করতেন তুখড় যুক্তি, ঐতিহাসিক তথ্য, অসাধারণ শব্দবাণ, দরাজ কণ্ঠ, আর হৃদয়কাড়া অঙ্গভঙ্গিতে। তার আবেদন ছিল সব দল-মতের ঊর্ধ্বে। যা সত্য, তা তিনি বলতেন দ্বিধাহীন চিত্তে। আর যা বলতেন, তা হৃদয়ে ধারণ করতেন প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসে। জুলাই নিয়ে যখন জাতি দ্বিধাবিভক্ত, হাদি বলেছিল, ‘জীবন দেব, কিন্তু জুলাই দেব না।’ তিনি কথা শুধু বলেননি, বাস্তবে করে দেখিয়েছেন।

জীবন, মৃত্যু ও শাহাদাত—এসব নিয়ে পরিষ্কার বোঝাপড়া ছিল তার।

হাদির মনে শাহাদাতের তামান্না ছিল প্রবল। তার কাছে জীবনের চেয়ে ইনসাফের পথে শহীদ হওয়াই ছিল প্রিয়। তিনি বলেও গেছেন কীভাবে শহীদ হতে চান—মিছিলের সামনে থেকে, গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে, পরম সন্তুষ্টচিত্তে আল্লাহর কাছে পৌঁছাতে। হাদি বলতেন, ‘৫০ বছর বেঁচে লাভ নেই যদি কোনো ইমপ্যাক্ট না থাকে। আর পাঁচ বছর বেঁচে যদি ইমপ্যাক্ট তৈরি করা যায়, তাহলে পাঁচ বছরই যথেষ্ট।’

হাদি দেখিয়ে দিয়েছেন, সিংহের এক দিনের জীবন, শূকরের ১০০ বছরের জীবনের চেয়েও উত্তম। বিপ্লবীরা বেশি দিন বাঁচে না। তারা পথ দেখিয়ে চলে যান। আমাদের হাদি ঠিক সেটাই করেছেন।

হাদির ইমপ্যাক্ট—ব্যক্তি থেকে ইতিহাস : হাদি তার মিশন বাস্তবায়নে এমপি হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আল্লাহ তাকে বানালেন কোটি মানুষের হৃদয়ের বাদশাহ, ইতিহাসের এক অনবদ্য অধ্যায়, আর দান করলেন শাহাদাতের সুমহান মর্যাদা। ইনশাআল্লাহ, পরজীবনে আমরা তাকে দেখব, জান্নাতের উঁচু মাকামে, নূরের তাজ পরিহিত অবস্থায়, যার একটা মণি এই বিশ্বজাহানের সবকিছু অপেক্ষাও মূল্যবান।

মিকদাম ইবন মাদিয়াকরাব (রা.) বর্ণনা করেন, রসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘আল্লাহর কাছে শহীদের জন্য ছয়টি বিশেষ বিষয় রয়েছে—১. খুনের পয়লা কাতরা প্রবাহিত হতে না হতেই তার সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়; ২. জান্নাতে তাকে তার অবস্থান দেখানো হয়; ৩. তার কবরের আজাব মাফ করে দেওয়া হয় এবং কিয়ামতের দিনের ভয়াবহতা (ফাজাউল-আকবর) থেকে তাকে নিরাপদ রাখা হয়; ৪. তার মাথায় মর্যাদার তাজ পরানো হয়, যার মধ্যকার এক একটা মণি-মুক্তা গোটা দুনিয়া ও এর মাঝে যা আছে তার চেয়ে উত্তম; ৫. জান্নাতের আয়তলোচনা হুরদের মধ্য থেকে ৭২ জনের সঙ্গে তার বিয়ে দেয়া হয় এবং ৬. তাকে তার নিকটাত্মীয়দের মধ্য থেকে ৭০ জনের জন্য সুপারিশ করার সুযোগ দেয়া হয়।’ জামি আত-তিরমিজী; হাদিস নং ১৬৬৩ (sunnah.com)।

আজ সারা দেশ, সারা সোশ্যাল মিডিয়া যেন হাদিময়। কেঁদেছে সারা বিশ্ব, যারা তাকে দেখেনি তারাও। রাষ্ট্রীয়ভাবে তার চিকিৎসা, তদারকি ও জানাজার আয়োজন হয়েছে। বিশ্ব মিডিয়ায় খবর এসেছে। জাতিসংঘ থেকে তদন্তের দাবি উঠেছে। তরুণ সমাজকে করেছে সীমাহীন উজ্জীবিত। আজ মায়েরা হাদির মতো সন্তান চায়।

বাংলাদেশের তিন হাজার বছরের লিখিত ইতিহাসে, মাত্র ৩৩ বছর বয়সে, এত বড় ইমপ্যাক্ট আর কেউ তৈরি করতে পারেনি। তিতুমীর, হাজী শরিয়াতুল্লাহ, শহীদ মালেক, আল্লামা সাঈদীসহ এই বাংলার সেরা মানুষদের কাতারেই থাকবে ওসমান হাদি। শত বছর পরে জন্ম নেওয়া শিশুটিও জানবে—‘আমাদের একজন ওসমান হাদি ছিলেন।’

বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত দায়ী ইলাল্লাহ লিখেছেন, ‘দ্রোহের প্রতীক শহীদ ওসমান হাদির রাজকীয় বিদায়। ধূমকেতুর মতো এলেন। ন্যায় ও ইনসাফের বলিষ্ঠ কণ্ঠ হিসেবে গোটা জনপদে বিপ্লবের দাবানল ছড়িয়ে হঠাৎ রবের সান্নিধ্যে চলে গেলেন। নিশ্চয়ই আসমানে আমার ভাইকে এর চাইতেও বড় রাজকীয় অভ্যর্থনা জানানোর আয়োজন চলছে।

জুমার নামাজের পরপরই গুলিবিদ্ধ, আবার পরের জুমার রাতেই শাহাদাত বরণ! পেয়েছেন কোটি মানুষের কান্নামিশ্রিত দোয়া। সুবহানাল্লাহ! এ এক পরম সৌভাগ্য!

হাদির মতো এমন দেশপ্রেমিক, আধিপত্যবাদবিরোধী ও ধর্মীয় মূল্যবোধসম্পন্ন তরুণরাই আগামীর বাংলাদেশ। শহীদের রক্ত কখনো বৃথা যায় না। ইনশাআল্লাহ ওসমান হাদি বেঁচে থাকবেন সহস্র মুক্তিকামী মানুষের ভালোবাসায়। অনুপ্রেরণা জোগাবেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম। সাহসের বাতিঘর হয়ে থাকবেন অগণন মানুষের হৃদয়ে।’

অস্ট্রেলিয়ার একজন প্রফেসর লিখেছেন, ‘শহীদ হাদি সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন। আগামীর সহস্র বছরেও কোনো বাংলাদেশি সন্তান হাদির উচ্চতাকে অতিক্রম করতে পারবে না। তিনি আদর্শ, সাহস ও নৈতিকতার যে মানদণ্ড স্থাপন করে গেছেন, তা বাংলাদেশের রাজনীতিকে আমূলভাবে বদলে দিয়েছে। আদি ও প্রচলিত রাজনৈতিক চর্চার জন্য তিনি রাজনীতিকে কঠিন করে তুলেছেন; কিন্তু সেই কাঠিন্য ইতিবাচক। এটি ভবিষ্যৎ রাজনীতিবিদদের জন্য একটি নৈতিক চ্যালেঞ্জ, যেখানে আপস নয়, প্রাধান্য পাবে আদর্শ, জবাবদিহিতা ও জনস্বার্থ। আমি আশাবাদী—এই আত্মত্যাগ বৃথা যাবে না; পরিবর্তন হবেই, হতে বাধ্য। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সত্য ও ত্যাগের ওপর দাঁড়ানো সংগ্রাম কখনো পরাজিত হয় না।’

তার জানাজা নিয়ে একজন লিখেছেন, ‘দীর্ঘ অপেক্ষার পর মেট্রোতে উঠতে পেরেছি মতিঝিল থেকে। উদ্দেশ্য জানাজা। প্রচণ্ড ভিড়ের সবার লক্ষ্য যেন আমার মতোই। সমুদ্রগভীর জনতার মুখে মুখে ‘হাদি, হাদি’ মাতম আর বিপ্লবের স্ফুরণ—যেন জুলাইয়ের সৌরভে আধিপত্যবাদের কবর খুঁড়তে দীর্ঘ লড়াইয়ে নেমেছে সবাই। আল্লাহু আকবর!’

হাদির জানাজা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সম্ভবত সবচেয়ে বড় জানাজা। এর আগে শহীদ জিয়া, শহীদ গোলাম আযম এবং শহীদ সাঈদীর জানাজা ছিল সবচেয়ে বড়। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর স্বল্পপরিচিত হাদি হয়ে উঠলেন কোটি মানুষের আইকন, লিজেন্ডারি ফিগার। তার ইনকিলাবের স্বপ্ন হয়ে গেল কোটি কোটি মানুষের স্বপ্ন।

জানাজায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মাদ ইউনূস বলেন, ‘প্রিয় ওসমান হাদি, তোমাকে আমরা বিদায় দিতে আসিনি এখানে। তুমি আমাদের বুকের ভেতরে আছ এবং চিরদিন, বাংলাদেশ যতদিন আছে, তুমি সকল বাংলাদেশির বুকের মধ্যে থাকবে। এটা কেউ সরাতে পারবে না। সেই ওয়াদা শুধু আমরা নয়, পুরুষানুক্রমে বাংলাদেশের সব মানুষ পূরণ করবে। সেই ওয়াদা করার জন্যই আমরা তোমার কাছে আজকে এসেছি। সবাই মিলে, যে যেখানেই আছি, আমরা তোমার যে মানবপ্রেম, তোমার যে ভঙ্গি, মানুষের সঙ্গে ওঠাবসা, তোমার যে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি—সবাই প্রশংসা করছে, সেটা আমরা মনেপ্রাণে গ্রহণ করছি। সেটা যেন আমাদের মনে সবসময় জাগ্রত থাকে, আমরা সেটা অনুসরণ করতে পারি।’

লেখক : অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নানইয়াং টেকনোলোজিক্যাল ইউনিভার্সিটি সিঙ্গাপুর