Image description

মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মাদক প্রবাহ দীর্ঘদিন ধরেই সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা এবং জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে ইয়াবা, আইস, ফেন্সিডিলসহ ভয়াবহ সব মাদক সীমান্ত পেরিয়ে বিভিন্ন রুট দিয়ে দেশে ঢুকছে প্রতিনিয়ত। নতুন নতুন রুট যুক্ত হওয়ায় এবং চোরাকারবারি চক্রের কৌশল পরিবর্তনের ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো—এই মাদক ব্যবসার বড় একটি অংশ রোহিঙ্গা দুষ্কৃতিকারী গোষ্ঠী, সীমান্তের চোরাকারবারি, এমনকি কিছু স্থানীয় দালালচক্রের সমন্বয়ে পরিচালিত হচ্ছে।

কখনো কখনো বাংলাদেশি বিভিন্ন পণ্য বা দৈনন্দিন সামগ্রীর বিনিময়েও মাদক চোরাচালান হচ্ছে, যা একটি অস্বাভাবিক ও বিপজ্জনক বাণিজ্যিক চক্রের রূপ নিয়েছে। 

মাদকের সহজলভ্যতা দেশের যুবসমাজকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তরুণদের নেশায় জড়িয়ে পড়া শুধু তাদের জীবন ধ্বংস করছে না—এটি সমাজের উৎপাদনশীল শক্তিকে নিস্তেজ করে দিচ্ছে, বাড়াচ্ছে অপরাধ, সহিংসতা ও পারিবারিক অস্থিরতা। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে এই পরিস্থিতি অগ্রহণযোগ্য এবং অত্যন্ত ভয়াবহ।

তাই মাদক প্রবেশের উৎস রোধে সরকার, প্রশাসন ও সমাজের সকল স্তরের সম্মিলিত উদ্যোগ এখন সময়ের দাবি।

সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদার ও আধুনিকায়ন এখন সবচেয়ে প্রয়োজনীয়। টেকনাফ, বান্দরবান, কক্সবাজার ও অন্যান্য সীমান্ত অঞ্চলে বিজিবির উপস্থিতি বাড়ানোর পাশাপাশি প্রযুক্তিভিত্তিক নজরদারি—ড্রোন, মোবাইল টাওয়ার মনিটরিং, সেন্সর প্রযুক্তি এবং রাত্রিকালীন ক্যামেরা—অত্যন্ত জরুরি। চোরাকারবারিরা যে নতুন রুট তৈরি করছে, সে বিষয়ে গোয়েন্দা নজরদারি আরও বিস্তৃত ও সক্রিয় হওয়া উচিত।

পাশাপাশি জলসীমা দিয়ে যেসব মাদক ঢুকছে, সেখানে কোস্টগার্ডের সমন্বিত অভিযান নিয়মিত করা প্রয়োজন।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পভিত্তিক অপরাধ দমন এখন একটি বড় জাতীয় নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে চিহ্নিত দুষ্কৃতিকারী গোষ্ঠী বারবার মাদক পাচারের নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত হচ্ছে। ক্যাম্প এলাকায় কড়া নজরদারি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর উপস্থিতি, বায়োমেট্রিক ব্যবস্থার কঠোর প্রয়োগ এবং অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার ব্যবস্থা নিতে হবে। একইসঙ্গে মানবিক সহায়তা গ্রহণের নামে কেউ যাতে মাদক পাচারে জড়াতে না পারে, তার নিশ্চয়তা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকেও নিশ্চিত করতে হবে।

দেশের ভেতরে মাদক ব্যবসার স্থানীয় দালালচক্র ও প্রভাবশালী পৃষ্ঠপোষকদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়ন জরুরি। অনেক সময় রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ের কারণে বা প্রশাসনের দুর্বলতার সুযোগে মাদক ব্যবসার শিকড় গ্রামে-গঞ্জে বিস্তার লাভ করছে। তাই কাউকে ছাড় না দেওয়ার নীতি বাস্তব ও দৃশ্যমানভাবে প্রয়োগ করতে হবে। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে মাদক ব্যবসায়ীদের শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে একটি শক্ত বার্তা সমাজে পৌঁছাবে।

যুবসমাজকে রক্ষায় প্রতিরোধমূলক সামাজিক উদ্যোগ অপরিহার্য। শুধু আইন প্রয়োগ করলেই মাদক নির্মূল হবে না, বরং এর চাহিদা কমানোই দীর্ঘমেয়াদি সমাধান। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পরিবার ও স্থানীয় সমাজের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি ক্রীড়া, সংস্কৃতি ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের প্রসার ঘটাতে হবে। যুবকদের কর্মসংস্থান বাড়ানো, বেকারত্ব কমানো এবং মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করা গেলে তারা ভুল পথে পা বাড়াবে না।

আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ সরকারকে মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্ত নিরাপত্তা সহযোগিতা, মাদকবিরোধী তথ্য বিনিময় এবং যৌথ অভিযানের বিষয়ে আরও জোরালো উদ্যোগ নিতে হবে। আন্তর্জাতিক মাদক কারবার চক্র অনেক বড় এবং শক্তিশালী; তাই আঞ্চলিক রাষ্ট্রগুলোর সম্মিলিত পদক্ষেপ ছাড়া পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব নয়।

অবশেষে, মাদককে শুধু নিরাপত্তা ইস্যু হিসেবে নয়, বরং জাতীয় অস্তিত্বের সংকট হিসেবে বিবেচনা করা প্রয়োজন। এটি আর শুধু সীমান্তের সমস্যা নয়—এটি দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, অর্থনীতি, সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতার উপর সরাসরি আঘাত। তাই মাদক প্রতিরোধকে দেশের অন্যতম অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করে রাষ্ট্রীয় নীতি, প্রশাসনিক উদ্যোগ ও সামাজিক আন্দোলনকে সমন্বিত কাঠামোর মধ্যে আনতে হবে।

মাদক প্রবাহ রোধে সরকারের শক্ত অবস্থান, প্রশাসনের আধুনিক ব্যবস্থা, সমাজের নৈতিক ভূমিকা এবং যুবসমাজের সচেতনতা—এই চারটির সমন্বয়েই বাংলাদেশকে একটি মাদকমুক্ত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। রাষ্ট্র যদি এখনই প্রয়োজনীয় কঠোরতা ও দূরদৃষ্টি না দেখায়, তাহলে মাদকের বিষবৃক্ষ আরো গভীরভাবে আমাদের সমাজে বিস্তার লাভ করবে। তাই এখনই সময়—অবিলম্বে, শক্ত হাতে এবং সমন্বিত উদ্যোগে মাদক প্রবাহ বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের।  

এম রায়হানুল ইসলাম

লেখক : সংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক