Image description

শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড এবং তাকে ভারতে হস্তান্তরের প্রশ্নটি শুধু একটি বিচারের ঘটনা নয়; এটি দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতি, ঐতিহাসিক সম্পর্ক, আঞ্চলিক ক্ষমতার ভারসাম্য এবং রাষ্ট্র পরিচালনার নৈতিকতার ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে বাংলাদেশজুড়ে যে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান সৃষ্টি হয়েছিল, তা মূলত সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটার পুনঃপ্রবর্তনের সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে। কিন্তু খুব দ্রুতই এই আন্দোলন দেশের দীর্ঘদিনের দমননীতি, দুঃশাসন, ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির বিরুদ্ধে একটি সর্বাত্মক বিদ্রোহে রূপ নেয়। সরকারি বাহিনী আন্দোলন দমনে কঠোর ও প্রাণঘাতী শক্তি প্রয়োগ করে, যার ফলে ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটে। আন্তর্জাতিক মহলসহ মানবাধিকার সংস্থাগুলোর পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী প্রায় দেড় হাজার মানুষ নিহত হয় এবং আরো কয়েক হাজার আহত হয়ে দেশজুড়ে অসন্তোষ আরো তীব্র আকার ধারণ করে। দেশের ইতিহাসে এত বৃহৎ ও রক্তাক্ত অভ্যুত্থান খুব কমই দেখা গেছে।

 

এই প্রেক্ষাপটে, ২০২৫ সালের নভেম্বর মাসে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনাকে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে। অভিযোগ ছিল, একজন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে ব্যর্থ হন, বরং বহুক্ষেত্রে সহিংসতা উসকে দেন এবং হত্যাযজ্ঞ ঠেকাতে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেননি। বিচারিক প্রক্রিয়া ঘিরে অনেক বিতর্ক থাকলেও বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার একে রাষ্ট্রের কাছে সত্য উদঘাটনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে উল্লেখ করেছে। তাদের বক্তব্য—এই রায় প্রমাণ করেছে যে রাষ্ট্রক্ষমতা যাদের হাতে থাকুক না কেন, তারা আইনের ঊর্ধ্বে নন। অন্যদিকে শেখ হাসিনা দিল্লি থেকে তার প্রতিক্রিয়ায় রায়টিকে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বলে দাবি করেন। তিনি উল্লেখ করেন, ট্রাইব্যুনাল তার প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট ছিল এবং তাকে আইনজীবী নিয়োগ বা আত্মপক্ষ সমর্থনের যথাযথ সুযোগ দেওয়া হয়নি। একই সঙ্গে তিনি আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার চেয়ে নিজের নির্দোষিতার দাবি পুনর্ব্যক্ত করেন। তার রাজনৈতিক অনুসারীরা এই রায়কে ‘প্রতিশোধমূলক বিচার’ বলে আখ্যা দেয় এবং দাবি করে—২০২৪ সালের পরিবর্তন ছিল একটি ‘বেআইনি ক্ষমতা দখল’; তাই নতুন সরকারের অধীনে হওয়া বিচারকে নিরপেক্ষ বলা যায় না।

রায় ঘোষণার পরপরই ঢাকা আনুষ্ঠানিকভাবে দিল্লির কাছে শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর দাবি জানায়। ২০১৩ সালে স্বাক্ষরিত প্রত্যর্পণ চুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ যুক্তি দেয় যে দণ্ডিত আসামিকে আশ্রয় দেওয়া বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের পরিপন্থী। বিশেষ করে ২০২৪ সালের আগস্টে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে শেখ হাসিনা যখন আতঙ্কিত অবস্থায় ভারতের সুরক্ষায় আশ্রয় নেন, তখন থেকেই তার অবস্থান দুই দেশের সম্পর্কে নতুন জটিলতার সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার পরিষ্কারভাবে জানিয়েছে—বিচার সম্পন্ন করতে ভারতের ভূমিকা অপরিহার্য; অন্যথায় দিল্লির অবস্থানকে অমিত্র আচরণ হিসেবে দেখা হবে। ভারতের প্রতিক্রিয়া এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্ক ও কৌশলগত। দিল্লি প্রকাশ্যে খুব সংযত ভাষায় বলেছে যে তারা রায় ‘নজরে নিয়েছে’ এবং পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। কিন্তু এর বাইরে তারা কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি। ভারতীয় কূটনীতিক, আইনজ্ঞ এবং নীতিনির্ধারকদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী প্রত্যর্পণ চুক্তির ধারা ভারতকে পর্যাপ্ত স্বাধীনতা দেয় অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করার জন্য। বিশেষত—যদি কোনো মামলাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনে হয় অথবা অভিযুক্তের প্রাণহানির ঝুঁকি থাকে, কিংবা বিচার প্রক্রিয়াকে ন্যায্য মনে না হয়, তবে ভারত তাকে ফেরত পাঠাতে বাধ্য নয়। শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে এই তিনটি উদ্বেগই বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রযোজ্য।

২০১৩ সালের বাংলাদেশ-ভারত প্রত্যর্পণ চুক্তিতে একটি বড় দুর্বলতা ছিল—যদি মামলা ‘রাজনৈতিক’ প্রকৃতির হয়, তবে আসামিকে ফেরত না দেওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু পরে এই চুক্তি সংশোধন করে স্পষ্ট করা হয়-কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে যদি নির্দিষ্ট অপরাধের অভিযোগ ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকে, তবে তাকে ফেরত দেওয়া বাধ্যতামূলক। এই সংশোধনই দেখায় যে অপরাধকে রাজনৈতিক আড়ালে লুকানোর সুযোগ নেই। অতএব, ভারতে আশ্রয় নেওয়া শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করা দিল্লির জন্য আন্তর্জাতিক আইন, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং সুসম্পর্ক রক্ষার স্বার্থে জরুরি। একজন ব্যক্তিকে রক্ষা করার জন্য ভারত-বাংলাদেশের ঐতিহাসিক বন্ধুত্ব, কৌশলগত সহযোগিতা এবং আঞ্চলিক সমন্বয়কে ঝুঁকির মুখে ফেলা উচিত নয়। দুই দেশের স্থায়ী সম্পর্ক রক্ষাই এখন ভারতের দায়িত্ব ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও ইতিহাসও এই সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করছে। শেখ হাসিনা ভারতের অন্যতম ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিলেন। উগ্রপন্থি গোষ্ঠীর দমন, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদ মোকাবিলায় সহযোগিতা, আঞ্চলিক সংযোগ প্রকল্পে সমর্থন, পানি ও সীমান্ত-সম্পর্কিত সমঝোতা—এসব বিষয়েই তিনি দিল্লির জন্য দীর্ঘ মেয়াদে নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন। ভারতের অনেক নীতিনির্ধারক মনে করেন—এমন একজন নেতা, যিনি বহু বছর ভারতের স্বার্থরক্ষায় ভূমিকা রেখেছেন, তাকে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের জন্য ফেরত পাঠানো ভারতের নৈতিক ও কৌশলগত অবস্থানকে দুর্বল করবে। তাছাড়া ভারতের ভাবমূর্তি—বিশেষত মিত্রদের প্রতি আনুগত্যের প্রশ্নে—ক্ষুণ্ণ হতে পারে।

বর্তমান বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কও খুব উষ্ণ নয়। নতুন সরকার ভারতের বলা মতো নয়; বরং তারা ভারতের আগের প্রভাবশালী ভূমিকার সমালোচনা করেছে বেশ কয়েকবার। দিল্লি ধরে নিচ্ছে, ২০২৬ সালের জাতীয় নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলতেই পারে। এমন অবস্থায় ভারতের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ কৌশল হলো—প্রত্যর্পণের বিষয়ে সময়ক্ষেপণ করা এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা।

বাংলাদেশের জনগণের বড় একটি অংশের চোখে শেখ হাসিনার বিচার ও দণ্ডায়ন ছাত্র-জনতার রক্তের প্রতিশোধের প্রশ্নে এক নৈতিক বিজয়। তারা মনে করে, হাজারো নিরপরাধ মানুষের প্রাণহানির জন্য দায়ী নেত্রীকে বিচারাধীন রাখা এবং দণ্ড কার্যকর করাই ন্যায়বিচারের পূর্ণতা। তাই তারা ভারতের কাছে শেখ হাসিনাকে হস্তান্তরের দাবি জোরালোভাবে তুলে ধরছে। অন্যদিকে ভারতের কাছে শেখ হাসিনাকে রক্ষা করা কৌশলগত আনুগত্যের পাশাপাশি মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক বিচারমানদণ্ডের প্রশ্নে এক ধরনের ভারসাম্য রক্ষা। এই দুদেশের ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থই বর্তমানে সম্পর্ককে নতুন উত্তেজনার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

ইতিহাসও এই প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ বহু বছর ধরে শেখ মুজিবুর রহমানের খুনিদের প্রত্যর্পণ চেয়ে আন্তর্জাতিক মহলে আবেদন জানিয়ে এসেছে, কিন্তু কানাডা, যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনার কারণে ওই অনুরোধ ফিরিয়ে দিয়েছে। তাদের সঙ্গে কোনো প্রত্যর্পণ চুক্তি ছিল না। এবার সেই অভিজ্ঞতার বিপরীত স্রোত বইছে—বাংলাদেশই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে চায়, আর ভারত সেই দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে আশ্রয় দিয়ে রেখেছে। তাই বাংলাদেশের কিছু মহল মনে করছে—ভারত যদি মুজিবের খুনিদের বিষয়ে নৈতিক অবস্থানকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে, তবে শেখ হাসিনার ক্ষেত্রেও একই নীতি অনুসরণ করা উচিত। শেখ হাসিনা বিশ্বের ইতিহাসে দ্বিতীয় রাষ্ট্রপ্রধান যিনি ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হলেন—প্রথমজন ছিলেন ফ্রান্সের রাজা লুই ষোড়শের পত্নী মেরি অঁতোয়ানেত। তবে ইতিহাসে এমন আরো বহু রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধান আছেন—ফ্রান্স, ইরান, তুরস্ক, হাঙ্গেরি, রোমানিয়া, পাকিস্তান—যারা ক্ষমতার অপব্যবহার, রাষ্ট্রদ্রোহ বা গণহত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি পেয়েছিলেন। সেই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের আদালত শেখ হাসিনাকে ন্যায়বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে।

পরিস্থিতি যেদিকে এগোচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে শেখ হাসিনা হয়তো দীর্ঘ মেয়াদে ভারতে নির্বাসনেই থাকবেন। ঢাকার তরফ থেকে কূটনৈতিক চাপ বাড়তে পারে, আন্তর্জাতিক মহলেও তারা ভারতের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু দিল্লি সম্ভবত প্রত্যর্পণের সিদ্ধান্তে তাড়াহুড়ো করবে না। কারণ তারা চাইবে-যেকোনো সিদ্ধান্ত ভারতের দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত স্বার্থ এবং আঞ্চলিক প্রভাব বজায় রাখার নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হোক। শেষ পর্যন্ত এ ঘটনা শুধু একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিচার নয়; এটি দক্ষিণ এশিয়ার কূটনীতি, মিত্রতার মূল্য, রাজনৈতিক নৈতিকতা এবং রাষ্ট্রের প্রতি জনগণের আস্থার পরীক্ষা। একদিকে বাংলাদেশের জনগণের ন্যায়বিচারের তীব্র আকুতি, অন্যদিকে ভারতের কৌশলগত দ্বিধা—এই দুইয়ের সংঘর্ষই আগামীর আঞ্চলিক সম্পর্কের গতিপথ নির্ধারণ করবে। বর্তমানে যে উত্তেজনা দেখা যাচ্ছে, তা শুধু একটি বিচারের ফল নয়; বরং দুই দেশের ইতিহাস, রাজনীতি, পারস্পরিক নির্ভরতা ও কূটনীতির জটিলতার ফল।

লেখক: নিরাপত্তা বিশ্লেষক, গবেষক ও লেখক