Image description

কাকন রেজা

যে আশা নিয়ে লিখতে শুরু করেছিলাম, তাকি পূরণ হচ্ছে? জান-জবানের স্বাধীনতার জন্য লড়ে আসছিলাম গত সতেরো বছর ধরে। সতেরো বছরের মাঝে দু’বছরের জন্য আমার সাথে যুক্ত হয়েছিল ফাগুন।

ইহসান ইবনে রেজা ফাগুন। ফাগুন রেজা নামে যাকে সবাই চিনতেন গণমাধ্যমের জগতে। কিন্তু জান-জবানের স্বাধীনতা নিশ্চিতের লড়াইয়ে ফাগুনকে জীবন দিতে হয়েছে। আজ আটষট্টি মাস ফাগুন নেই। ফ্যাসিস্ট রেজিমের বরকন্দাজরা তাকে শহীদ করেছে। একজন গণমাধ্যমকর্মী, প্রতিশ্রুতিশীল, প্রতিভাবান।

যে যুক্ত ছিল সাব-এডিটর হিসেবে একটি উল্লেখযোগ্য গণমাধ্যমের ইংরেজি বিভাগে। ২০১৯ সালের ২১ মে, ফাগুনকে গুমের পর হত্যা করা হয়। ফাগুনের দেহ রাখা হয় রেললাইনে পাশে, যাতে সহজেই অপমৃত্যু প্রমাণ করা যায়। কিন্তু যায়নি। শেষ পর্যন্ত তাকে খুন করা হয়েছে, সেই সত্যটা উঠে আসে। বিপরীতে খুনের মাস্টার-মাইন্ড খুঁজতে গিয়েই বিপত্তি। কেউ সে পর্যন্ত যেতে চায়নি ফ্যাসিস্ট রেজিমের পতন পর্যন্ত। কিন্তু তারপর.. প্রশ্নটার উত্তর খুঁজছি। মামলাটি রয়েছে জামালপুরের পিবিআইয়ে। কিন্তু সেখান থেকে কোনো এক অদৃশ্য কারণে নির্দিষ্ট একটি জায়গায় মামলাটি আটকে আছে। একজন অভিযুক্ত খুনি স্বীকারোক্তি দিয়েছে হত্যাকাণ্ডে যুক্ত পাঁচজনের বিষয়ে। কিন্তু বাকি চারজনকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। পরিষ্কার ভাবে বলতে পারি গ্রেপ্তারের চেষ্টাও করা হয়নি।

উপরন্তু চেষ্টা হয়েছে, বিষয়টিকে ছিনতাই ঘটনার মধ্যে দিয়ে শেষ করে দিতে। ফাগুনের সাথে থাকা ল্যাপটপে ছিল বেশ কিছু তথ্য, যা বর্তমান সরকারের জন্যও প্রয়োজনীয় বিবেচিত হতে পারতো। সেই ল্যাপটপটিই উদ্ধার করা যায়নি। সব মিলিয়ে ফাগুন হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি ছিনতাই ঘটনার সাথে কোনো প্রকারেই যায় না। এটা তদন্ত কর্মকর্তারাও মুখে বলেন, কিন্তু কাজে লবডঙ্কা। একজন অভিযুক্ত খুনি স্বীকারোক্তি দিলো, বললো, তাদের প্রধানের কথা। সেই প্রধানকে গ্রেপ্তার করা গেলো না। পিবিআইয়ের বর্তমান প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোস্তফা কামাল সাহেব নিজে বলে দিলেন জামালপুরের পিবিআিইয়ে, বিষয়টির খুঁটিনাটি দেখার জন্য এবং আমি তার সামনে বসা অবস্থায় বললেন।

তার বলায় কোনো ত্রুটি ছিল না। তারপরও জামালপুর পিবিআইয়ের এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি নেই। কেন নেই... একজন গণমাধ্যমকর্মী গুমের পর খুন হলেন। তার খুন হওয়ার পেছনে রয়েছে অনেকগুলো সম্ভাব্য কারণ। ‘ডয়চে ভেলে’ থেকে ‘এনটিভি’র ক্রাইম ওয়াচ তাদের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে কারণগুলো উল্লেখ করেছে। অন্যান্য গণমাধ্যমও বলেছে প্রায় একই রকম ভাষায়। সমস্ত ক্লু নির্দেশ করে একটা বিশেষায়িত এজেন্সি ছাড়া এমন হত্যাকাণ্ড ঘটানো সম্ভব নয়। অথচ এসব ক্লু উদ্‌ঘাটনে তদন্ত কর্মকর্তাদের কোথাও একটা ছন্দপতন পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাদের শারীরিক ভাষা বলছে, তারা সব জানে, তবে জানাতে পারবে না, এমনটাই। তাহলে এই দীর্ঘদিন ভয় এবং মৃত্যুকে জেনে-মেনে জান-জবানের জন্য লড়ে লাভ কী হলো? আমাদের প্রাপ্তির জায়গাটা কি? বিগত দেড় দশক ছিলাম নানান শঙ্কার মধ্যে। মাঝেমধ্যে ফ্যাসিজম তার উপস্থিতি জানান দিতো। কেন লিখলাম, কার জন্য লিখলাম, কার লাভ হচ্ছে আমার লিখা থেকে, এসব জবাব প্রায়ই দিতো হতো। থাকতো হাসিমুখের হুমকি। কখনো সেই স্বর হতো রূঢ়। ভয় পেতাম না যে তা নয়। তারপরও কিছু বন্ধু-বান্ধব ছিলেন, যারা সহযোগিতা করেছে, কখনো রক্ষাও করেছে। কিন্তু সেই ভয় ও শঙ্কার চরম রূপ দেখলাম ফাগুন হত্যাকাণ্ডে। একজন বাবা হিসেবে সবচেয়ে ভারী বোঝা কাঁধে নিতে হলো আমার। সাংবাদিকতার বংশপরম্পরা থেমে গেলো ফাগুনের শহীদ হওয়ার মধ্যে দিয়ে। ফ্যাসিজম পরবর্তী সময়ে সেই হত্যার বিচারটা অন্তত পাবো তেমন আশা ছিল। আশার বদলে এখন আশঙ্কা হচ্ছে। ন্যায় বিচারের জন্য লিখেছি, লড়েছি অথচ বিচার এখনো যদি সিলেক্টিভ থাকে তবে তো আশঙ্কারই কথা। গুম কমিশন জানিয়েছে, গুমের পর হত্যা করে রেললাইনে লাশ রাখার কথা। এ থেকে এবং ফাগুন হত্যার প্রাপ্ত নিদর্শনে পরিষ্কার হয় হত্যাকাণ্ডের মোটিভ। এতসবের পরেও কেন নির্দিষ্ট একটা জায়গায় আটকে থাকবে তদন্ত, কেন? জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্যই ছিল আমাদের দীর্ঘ লড়াই। যার পরিণতি জুলাই বিপ্লব। এই বিপ্লব কি তবে বৃথা যাবে? আমরা কি ‘কেন’র উত্তর পাবো না? তবে কি সত্যিই বিপ্লব বেহাত হয়ে যাবে?