Image description

আলফাজ আনাম

 

হাসিনার দুঃশাসনের গুম, খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যার স্মৃতিগুলো যেন ফিকে হয়ে আসছে। এর মধ্যে গুমের ওপর প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে সম্প্রতি এক ঘণ্টার একটি ডকুমেন্টারি প্রকাশ করা হয়েছে। এই ডকুমেন্টারিটি সারা দেশ কাঁপিয়ে দিয়েছে। গুম করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মানুষ হত্যা ও নির্যাতনের যে নৃশংস বর্ণনা উঠে এসেছে তা যেকোনো সুস্থ মানুষকেও মানসিকভাবে অসুস্থ করে ফেলতে পারে।

ডকুমেন্টারির একেবারে শেষদিকে সেনা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আকবর হোসেন স্বীকার করেছেন, এসব গুমের ঘটনা শেখ হাসিনার অজানা ছিল না। তিনি নিজে গুম হওয়া একজনকে ছেড়ে দেওয়ার কথা বললেও হাসিনা তাতে রাজি হননি। জেনারেল আকবর এখন ভারতে পালিয়ে আছেনা।

 

২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সময়কালে গোয়েন্দা সংস্থার মহাপরিচালক ছিলেন মেজর জেনারেল (অব.) আকবর হোসেন। তার বিরুদ্ধেও বিরোধী নেতাকর্মীদের গুমের অভিযোগ রয়েছে। ২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে একতরফাভাবে জয়লাভ ও বাংলাদেশে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠায় তিনি ভূমিকা রাখেন।

 

মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের তথ্য অনুযায়ী, তার মেয়াদকালে অন্তত আড়াই শতাধিক ব্যক্তি গুম হয়েছেন। শেখ হাসিনা তার দেড় দশকের শাসনামলে বিরোধী দল ও মতকে দমনের জন্য গুমকে রাষ্ট্র পরিচালনার অংশে পরিণত করেছিলেন। শুধু তাই নয়, হাসিনার প্রতিটি অন্যায় কর্মকাণ্ডে ভারতের অংশগ্রহণ খুঁজে পাওয়া যায়। গুমের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম ছিল না। বাংলাদেশ থেকে গুম করে ভারতে পাচার করা হতো। ভারতের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তাদের গ্রহণ করত। ভারত থেকে অনেক মানুষকে বাংলাদেশের হাতে তুলে দেওয়া হতো। এরপর দুপক্ষ মিষ্টি বিনিময় করত। এ ধরনের গুমের সঙ্গে জড়িত একজন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য গুম কমিশনে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে বলেছেন, ভারত থেকে একজনকে হস্তান্তরের পর তাকে রাস্তায় ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়। গুমের সঙ্গে ভারতের সরাসরি সম্পৃক্ততার বড় প্রমাণ হচ্ছে, মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সাক্ষী সুখরঞ্জন বালিকে ভারতে পাঠানো।

 

শুধু সুখরঞ্জন বালি নয়, আরো অনেককে গুম করে ভারতের হাতে তুলে দেওয়া হয়, যাদের কথা গণমাধ্যমে সেভাবে আসেনি। র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) গুম করার পর বেদম নির্যাতন চালায় রহমতুল্লাহ নামে এক ব্যক্তির ওপর। এরপর ভারতের পুলিশের কাছে তুলে দিলে পাসপোর্ট ছাড়াই কলকাতায় নিয়ে জেলে রাখা হয়। সেখানেও চলে দফায় দফায় নির্যাতন। সাড়ে তিন মাস রেখে দেওয়া হয় কলকাতা কারাগারে। ভারতের আরেকটি জেলখানায় নিয়েও চালানো হতো নির্যাতন। পরে পুশ ইনের মাধ্যমে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

 

তিনি জানান, “২০২৩ সালে র‌্যাবের একটি দল তাকে তুলে নিয়ে যায়। এরপর জম টুপি পরিয়ে হাত বেঁধে একটি ছোট রুমে তাকে ৯ মাস আটকে রাখে। তখন তারা বলে, ‘তোকে একদল মেরে ফেলতে চায়। আমরা চাই তুই বেঁচে থাক।’ পরে আমাকে ভারত পাঠিয়ে দেয়।” অনেককে এভাবে সীমান্তের ওপারে রেখে আসা হতো। এরপর সেখানে বছরের পর বছর কারাগারে আটক থাকতে হতো। এগুলো হতো ভারত সরকারের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগের অংশ হিসেবে।

 

গুম কমিশনের সদস্য নাবিলা ইদ্রিস, সাজ্জাদ হোসেন ও নুর খান গুম করা মানুষগুলোর সাক্ষ্য নিয়ে নির্যাতন ও হত্যার যে হৃদয়বিদারক বীভৎস বর্ণনা দিয়েছেন, তাতে তাদেরও যে এক ধরনের মানসিক ট্রমার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে, তা বর্ণনা থেকে বোঝা যায়। হয়তো এই ডকুমেন্টারিতে আরো অনেক অজানা অধ্যায় উঠে আসেনি।

 

ডকুমেন্টারিতে মানুষ হত্যার ক্ষেত্রে নানা উপায়ের কথা তুলে ধরা হয়েছে। যেমন বিষাক্ত ইনজেকশন দিয়ে হত্যা; এরপর লাশ রেললাইনের ওপর ফেলে রাখা, যাতে ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছে বলে মনে হয়। নদীর মাঝখানে নিয়ে মাথায় গুলি করে হত্যার পর পেট চিরে ইট ও সিমেন্টের বস্তা দিয়ে লাশ ডুবিয়ে দেওয়া—নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের লাশ এভাবে পাওয়া গিয়েছিল। গভীর রাতে চলন্ত ট্রাকের নিচে ফেলে দিয়ে হত্যা করার মতো কৌশলও প্রয়োগ করা হয়েছে।

 

অত্যাচারের বীভৎস বর্ণনা উঠে এসেছে গুম হওয়া ব্যক্তিদের মুখ থেকে। অনেকে এখনো ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না। গুম করা ব্যক্তিদের ওপর এতটাই নির্যাতন করা হতো যে অনেক সময় দায়িত্বরত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মধ্যেও অপরাধ বোধ তৈরি হতো। এ ধরনের কিছু ঘটনার কথা গুম কমিশনের সদস্য নাবিলা ইদ্রিস সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুলে ধরেছেন।

 

তিনি লিখেছেন, আমরা রেগুলারলি ভিকটিমদের কাছ থেকে গোপন ডিটেনশন সেলে ভয়াবহ নির্যাতনের ঘটনা শুনি। এসব নির্যাতন প্রায়ই এতটা নিষ্ঠুর হয় যে, তাদের শরীর ও মনে স্থায়ী ক্ষত রেখে যায়। কিন্তু মাঝে মাঝে কিছু ভিকটিম এমন ঘটনার বর্ণনাও দেন, যেখানে আচমকা এক ধরনের অস্বাভাবিক মানবতার ঝলক দেখা যায়—কখনো কোনো প্রহরীর কাছ থেকে, কখনো কোনো অফিসারের কাছ থেকে। ভুক্তভোগীরা এসব মুহূর্ত ভোলেন না এবং তাদের মাধ্যমে আমরা এখন এমন অনেক স্মৃতির রিপজেটরি হয়ে গিয়েছি, যা আমাদের যথেষ্ট ভাবায়।

 

এরপর তিনি এ ধরনের বেশ কয়েকটি ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন। নাবিলা ইদ্রিস লিখেছেন—একজন তরুণ ছাত্র, যিনি টর্চারের চোটে আজ স্থায়ীভাবে অসুস্থ, আমাকে বলেছিলেন, টর্চারিং অফিসার মারতে মারতে দুটো ইন্সট্রুমেন্ট ভেঙে ফেলেন এবং পরে তৃতীয়টি দিয়ে টর্চার চালিয়ে যান। নির্যাতন এতটাই নৃশংস ছিল যে, সেই ঘরে থাকা দুই নারী অফিসার কান্নায় ভেঙে পড়ে ঘর ছেড়ে চলে যান। যদিও তিনি অর্ধচেতন ছিলেন, কিন্তু সেই দুজনের কান্নার দৃশ্যটি তার আজও মনে গেঁথে আছে।

 

আরেকজন বন্দি আমাকে বলেছিলেন, এক রাতে তিনি তাহাজ্জুদ পড়ছিলেন। তার সুরেলা তিলাওয়াত শুনে এক প্রহরী খুব কাঁদতে থাকেন। অতঃপর ক্ষমা চাইতে চাইতে বলেন, ‘আমি জানি আপনারা নির্দোষ, কিন্তু আমি কিছুই করতে পারছি না।’ পরে যখন বন্দিকে কিছু সময়ের জন্য সেল থেকে সরিয়ে নিয়ে আবার ফেরত আনা হয়, তখন সেই প্রহরী আবেগাপ্লুত হয়ে গিয়ে বলেন, ‘আপনি বেঁচে আছেন! আমি ভেবেছি আপনাকে মেরে ফেলতে নিয়ে গেছে। তাই আমি বাড়ি ফিরে নামাজে দাঁড়িয়ে আপনার জন্য অনেক কেঁদেছি।’

 

একজন অফিসারকে বলা হয়েছিল, তার দায়িত্বপূর্ণ এলাকার অ্যাকটিভ রাজনৈতিক কর্মীদের তালিকা জমা দিতে। পরে যখন তিনি জানতে পারেন, সেই তালিকার প্রতিটি মানুষকে এলিমিনেট করা হয়, তখন তিনি মানসিক ও শারীরিক দিক থেকে প্রচণ্ডভাবে ভেঙে পড়েন, ইন ফ্যাক্ট সুইসাইডাল হয়ে যান।

 

২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে শুরু হয় গুমের সংস্কৃতি। আওয়ামী লীগের ক্ষমতা গ্রহণের পর এক মাসের মধ্যে ফেব্রুয়ারিতে বিডিআর বিদ্রোহের নামে ৪৭ সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করা হয়। এই ঘটনার পর চট্টগ্রাম থেকে প্রথম একজন বিডিআর সদস্যকে গুম করে পরে হত্যা করা হয়। এই গুমের ধারাবাহিকতা চলছে হাসিনার পতন ও পলায়নের আগ পর্যন্ত। ২০০৯ সালে যেখানে মাত্র তিনজন গুম হয়েছিলেন, এক বছরের ব্যবধানে ২০১০ সালে এসে তা দাঁড়ায় ২০ জনে।

 

হাসিনার নিয়ন্ত্রণে থাকা গুম বাহিনীর সদস্যদের প্রধান টার্গেট ছিলেন রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা। বিএনপি নেতা চৌধুরী আলম গুম হয়েছিলেন ২০১০ সালের ২৫ জুন। তখন বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর জোরালো কোনো আন্দোলন ছিল না। বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী গুম হয়েছিলেন ২০১২ সালের এপ্রিল মাসে। এ সময় থেকে সরকারবিরোধী আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। বিশেষ করে ভারতে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। টিপাই মুখ বাঁধ নির্মাণ নিয়ে সিলেট অঞ্চলে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। এই আন্দোলনে ইলিয়াস আলী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ইলিয়াস আলীর মতো জাতীয়তাবাদী নেতার গুমের সঙ্গে ভারতের সম্পৃক্ততার বিষয়টি উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

 

গুম কমিশনের সদ্যসরাও জানিয়েছেন, বিরোধী দলের আন্দোলন যখন জোরদার হয়েছে, তখন নেতাকর্মীদের গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার সংখ্যা বেড়েছে। ২০১২ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াত নেতাদের বিচারকে কেন্দ্র করে সারা দেশে আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। এ সময় জামায়াত ও শিবিরের বহু নেতাকর্মীকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়। এর সঙ্গে ছিল গুমের ঘটনা। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইসলামী ছাত্রশিবিরের দুজন নেতা ওয়ালিউল্লাহ ও আল মুকাদ্দাসকে গুম করা হয়। এখনো এই দুজনের গুমের ব্যাপারে পুরো বিবরণ পাওয়া যায়নি।

 

২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকে গুমের ঘটনা আরো বেড়ে যায়। কারণ ভারতের সমর্থন নিয়ে একতরফা নির্বাচনের পর হাসিনা গুম-খুনের মাধ্যমে ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার নীতি গ্রহণ করেন। তিনি বুঝে যান, জনসমর্থনের ভিত্তিতে ভোটের মাধ্যমে তিনি আর ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না। তার সামনে একটি পথ—নিপীড়ন চালানো। মানবাধিকার সংগঠন অধিকার-এর তথ্য থেকে আমরা দেখতে পাই, ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর গুমের ঘটনা আরো বেড়েছে। ২০১৫ সালে গুম হয়েছে ৭১ জন। পরের বছর ২০১৬ সালে এ সংখ্যা সর্বোচ্চ বেড়ে দাঁড়ায় ১০৬ জনে।

 

হাসিনার দুঃশাসনে গুমের পর হত্যার শিকার মানুষগুলোকে আর কখনো ফিরে পাওয়া যাবে না। গুম অবস্থায় যারা নির্যাতিত হয়েছেন, সারা জীবন সেই দুঃসহ স্মৃতি তাদের তাড়া করবে। যেকোনো বিবেকবান মানুষের চাওয়া হলো, আর যেন কখনো এই গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার সংস্কৃতি ফিরে না আসে। এজন্য যারা গুমের শিকার হয়েছেন, তাদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে।

 

সম্প্রতি গুমের ঘটনায় করা দুটি মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ২৮ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। এর মধ্যে ২৫ জনই সেনাবাহিনীর সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা। এর মধ্যে লেফটেন্যান্ট জেনারেল ও মেজর জেনারেল পদের ৯ কর্মকর্তা রয়েছেন। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামরিক উপদেষ্টাসহ সেনা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইয়ের সাবেক পাঁচ প্রধান রয়েছেন।

 

সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল মেজর জেনারেল মো. হাকিমুজ্জামান বলেছেন, গুম কমিশন করা হয়েছে। সেনাবাহিনী বিচারের পক্ষে। ইনসাফের সঙ্গে কোনো কমপ্রোমাইজ করা হবে না। দেশের মানুষও আশা করে ন্যায়বিচারের সঙ্গে সেনাবাহিনী কোনো আপস করবে না। কারণ ব্যক্তির দায় পুরো সেনাবাহিনীর নয়। ভবিষ্যতে যাতে কোনো সরকার সেনা গোয়েন্দা সংস্থাসহ রাষ্ট্রীয় কোনো বাহিনী বা কোনো পর্যায়ের সেনা কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতে না পারে, তার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। অপরাধীদের বিচারে সেনাবাহিনীর পূর্ণ সহযোগিতার মাধ্যমে কেবল তা করা সম্ভব।

 

লেখক: সহযোগী সম্পাদক, আমার দেশ