Image description

দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

 

ঊনবিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত জার্মান সমাজবিজ্ঞানী, দার্শনিক ও রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ ম্যাক্সিমিলিয়ান কার্ল এমিল ওয়েবার। তার চিন্তা আধুনিক রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠানের ধরন, আমলাতন্ত্রের ভূমিকা, নীতিনির্ধারণে পেশাজীবীদের গুরুত্ব এবং নাগরিক অধিকার ও দায়বদ্ধতার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তুলে ধরে। যা আধুনিক রাষ্ট্র, প্রশাসন ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন বিশ্লেষণে আজও প্রাসঙ্গিক। ওয়েবার তার ‘ইকোনমি অ্যান্ড সোসাইটি’তে আমলাতান্ত্রিক তত্ত্বে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ছয়টি মৌলিক নীতি উল্লেখ করেন। যেগুলো হলো ব্যক্তিনিরপেক্ষতার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, স্পষ্ট পদানুক্রমে কর্তৃত্ব বণ্টন, নিয়মকানুন অনুসরণ, কর্ম বিশেষীকরণের মাধ্যমে দক্ষতা অর্জন, যোগ্যতাভিত্তিক কর্মজীবন উন্নয়ন এবং মেধা ও দক্ষতার ভিত্তিতে প্রাতিষ্ঠানিক নির্বাচন। তার মতে, এসব নীতি প্রতিষ্ঠানে দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে। অন্যদিকে যখন নিয়োগ-নির্দেশনা ব্যক্তিগত অনুকম্পা, পৃষ্ঠপোষকতা বা শাসকের আদেশে নির্ধারিত হয়, তখন প্রতিষ্ঠান পিতৃতান্ত্রিক বা ব্যক্তিতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ফলে নিয়মের অনুশাসন ক্ষুণ্ন হয়, পক্ষপাত ও অনিয়ম বাড়ে। সংকটময় সময়ে সিদ্ধান্তগ্রহণ ব্যক্তিনির্ভর ও হঠকারী হয়ে ওঠে। রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়।

ব্যুরোক্রেসিকে নিরপেক্ষ নীতিগত স্পেস দেয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ জোর দিয়েছেন ওয়েবার। এতে কল্যাণ ও আইনের শাসন বজায় থাকে, রাষ্ট্রকে আধুনিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সক্ষম করে। ওয়েবারের মতে, প্রাতিষ্ঠানিক রূপরেখা পরিবর্তিত হলে সামরিক আচরণও বদলে যেতে পারে। তার তত্ত্ব অনুযায়ী সামরিক প্রতিষ্ঠানকে সাধারণত দুটি আদর্শের ভিত্তিতে দেখা হয়। ওয়েবারিয়ান মিলিটারি ও প্যাট্রিমোনিয়াল মিলিটারি। ‘ওয়েবারিয়ান মিলিটারি’ বলতে বোঝায় এমন একটি সামরিক বাহিনী, যা রাষ্ট্র ও নাগরিকের প্রতি নিষ্ঠাবান, পেশাগত যোগ্যতাভিত্তিক এবং শাসক বা ব্যক্তির প্রতি অনুগত নয়। এর বিপরীতে ‘প্যাট্রিমোনিয়াল মিলিটারি’ হলো নেতৃত্ব বা ব্যক্তি ও তার আশপাশে বলয়ের আনুগত্যকেন্দ্রিক। এ কাঠামোয় বাহিনীর সদস্যরা রাষ্ট্রের নয়, শাসক বা নেতৃত্বের আদেশে চালিত হয়। আনুগত্য সেখানে নাগরিক বা আইনের প্রতি নয়, বরং ব্যক্তি ও তার আশপাশের বলয়কেন্দ্রিক। গত একশ বছরে আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এ দুই ধরনের প্রবণতাই দেখা যায়।

বাংলাদেশে মিলিটারি ও ব্যুরোক্রেসির আত্মপ্রকাশ ঘটে মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল থেকেই। মুক্তিযুদ্ধে বীরোচিত ভূমিকা, পরবর্তী রাজনৈতিক প্রভাব এবং বাহিনীর ভেতরের সংকট—সব মিলিয়ে একাত্তর-পরবর্তী সময়ে এক ধরনের ট্রানজিশনাল সামরিক কাঠামো দেখা যায়। যেখানে উভয় বৈশিষ্ট্যই বিদ্যমান। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্ম কোনো স্বাভাবিক সময়ের প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় নয়, বরং এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধ ওই সামরিক রূপান্তরের সূচনা করেছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেসব বাঙালি সেনাসদস্য মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন, তারা যুদ্ধের সময় গড়ে তোলেন নতুন নেতৃত্ব কাঠামো। পরে সদ্য স্বাধীন দেশে রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানের মতো সেনাবাহিনীর আনুগত্য কেন্দ্রীভূত ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত নেতৃত্বের প্রতি। প্রাতিষ্ঠানিক আলোচনা ছাড়াই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নেয়া হতো শীর্ষ রাজনৈতিক পর্যায় থেকে। প্যাট্রিমোনিয়াল মিলিটারি বা পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোয় বাহিনী একপ্রকার ‘ব্যক্তিকেন্দ্রিক আমলাতন্ত্রে’ পরিণত হয়। বাহাত্তর-পরবর্তী সময়ে শুধু সামরিক বাহিনী নয়; প্রশাসন, পুলিশ, বিচার ব্যবস্থা ও সরকারি নিয়োগ প্রক্রিয়াগুলো হয়ে পড়ে পুরো ব্যক্তি ও তার আশপাশের বলয়কেন্দ্রিক। উচ্চপদে নিয়োগ, পদোন্নতি এবং গুরুত্বপূর্ণ পদায়নের সিদ্ধান্ত প্রাতিষ্ঠানিক মেকানিজমের বদলে পারিবারিক ও রাজনৈতিক বিবেচনা এবং আস্থা ও আনুগত্যভিত্তিক হওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়। সব ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়া ব্যক্তিকেন্দ্রিক নির্দেশনায় পরিচালিত হতো, যা প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বকীয় নীতি ও পদ্ধতি বিকাশের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করেছিল। ফলে সদ্যস্বাধীন রাষ্ট্রে পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোর কারণে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের স্বাধীন পরিচালনা কাঠামো ও পেশাদারত্ব বজায় রাখতে পারেনি।

এ সময় সেনাবাহিনীর মধ্যেও ছিল নানা রকম বিভক্তি। একদিকে ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া অফিসার ও সৈনিকরা। গেরিলা কৌশল, রাজনৈতিক চেতনা ও জনগণের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ততার মধ্য দিয়ে যাদের মধ্যে বিপ্লবী মনোভাব গড়ে উঠেছিল।

অন্যদিকে ছিলেন পাকিস্তানে অবস্থানরত বাঙালি অফিসাররা, যারা দেশে ফিরে পুনর্গঠিত সেনাবাহিনীতে যুক্ত হন। তারা পেশাদার সামরিক শৃঙ্খলা, পদানুক্রম ও কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণে বিশ্বাসী ছিলেন। দুই ধারার মধ্যে মতাদর্শিক দূরত্ব ছিল। যে দ্বন্দ্ব কমান্ড কাঠামোকে দুর্বল করে, আনুগত্যকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক করে তোলে এবং অভ্যুত্থান ও পাল্টা-অভ্যুত্থানের সংস্কৃতিকে উসকে দেয়। তবে দুই পক্ষের মধ্যে একটা জায়গায় মিল ছিল—উভয় পক্ষই তৎকালীন সরকারের প্রতি বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল, বিশেষ করে রক্ষীবাহিনীর কারণে।

যার ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যরা হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। যদিও এটা কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং সেনাবাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তার ব্যক্তিগত পরিকল্পনা ছিল। হত্যাকাণ্ড-পরবর্তী দিনগুলোয় সেনানিয়ন্ত্রণ দ্রুত ভেঙে পড়ে। সেনাবাহিনীর ভেতরে গোষ্ঠীগত বিভাজন তীব্র আকার ধারণ করে। লেফটেন্যান্ট, মেজর ও কর্নেল পর্যায়ের কর্মকর্তারা বিভিন্ন আনুগত্যের শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েন। এর থেকে উদ্ভূত ভাঙন এবং রাজনৈতিক-তাত্ত্বিক মতাদর্শের প্রভাব মিলিয়ে একাধিক ব্যক্তি, নেতৃত্বনির্ভর ও মতাদর্শনিষ্ঠ অভ্যুত্থানের জন্ম নেয়।

এ অস্থিরতার মধ্যেই ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ অভ্যুত্থান ঘটান। তবে তার অবস্থান ছিল অত্যন্ত নড়বড়ে। মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের একাংশ তার পদক্ষেপকে ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা হিসেবে দেখেছিলেন। পাকিস্তানফেরত কর্মকর্তাদের মধ্যেও ছিল প্রবল বিরোধিতা। ফলে খালেদ মোশাররফের উদ্যোগ সফল হয়নি। মাত্র তিনদিন পর, ৭ নভেম্বর কর্নেল আবু তাহেরের নেতৃত্বে গণ-অভ্যুত্থান ঘটে। তাহেরের লক্ষ্য ছিল সেনাবাহিনীর মধ্যে ‘জনগণের সৈনিক’ তৈরি করা, পেশাদার বাহিনীর পরিবর্তে এক সমাজবিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলা। কর্নেল তাহেরের উদ্যোগে বন্দি মেজর জিয়াউর রহমান মুক্তি পান। এরপর দ্রুত ক্ষমতার ভারসাম্য বদলে যায়। জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন। সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলার অভিযোগে কর্নেল তাহেরকে ১৯৭৫ সালের ২৪ নভেম্বর গ্রেফতার করা হয়। ১৯৭৬ সালের ২১ জুলাই রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে সামরিক আদালতে তাকে ফাঁসি দেয়া হয়। কর্নেল তাহেরের বিচারে প্রায় ৪৬ জন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা টাইব্যুনালে অংশ নিয়েছিলেন।

জিয়াউর রহমানের আমলেই সেনাবাহিনী শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করে। তার সময়ে সেনাবাহিনী পুনর্গঠনের প্রয়াস ছিল বাংলাদেশের সামরিক ইতিহাসের সবচেয়ে জটিল ও রূপান্তরমূলক অধ্যায়। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সেনাবাহিনী তখন গভীরভাবে বিভক্ত। একদিকে মুক্তিযোদ্ধা অফিসার ও সৈন্যরা, অন্যদিকে পাকিস্তানফেরত কর্মকর্তারা। সঙ্গে ছিল দলীয় রাজনীতির প্রভাব ও ‘সৈনিক বিপ্লব’-পরবর্তী অবিশ্বাস। বাহিনীর ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং স্থিতিশীলতা ফেরাতে জিয়াউর রহমান কৌশলী, কঠোর ও বাস্তববাদী পদক্ষেপ নেন। প্রথমে তিনি সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠীগুলোর ভারসাম্যকে কৌশলে ব্যবহার করেন, মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তানফেরত কর্মকর্তাদের মধ্যকার বিরোধ নিষ্ক্রিয় করেন, কর্নেল তাহেরের গ্রেফতার ও মৃত্যুদণ্ডের পর সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহের চেষ্টা করা জাসদ সমর্থকদের কঠোরভাবে দমন করেন। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ সালের মধ্যে কয়েকটি বিদ্রোহ চেষ্টার ঘটনা ঘটে, যার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবরের ব্যর্থ অভ্যুত্থান, যখন সেনা ও বিমান বাহিনীর একটি অংশ ঢাকায় সমন্বিতভাবে জিয়াউর রহমানকে হত্যার চেষ্টা করে। বিদ্রোহে জড়িত অফিসার ও সৈন্যদের কঠোর শাস্তি দেয়া হয়।

সেনাবাহিনীর কাঠামো সম্প্রসারণ ও আধুনিকীকরণের পদক্ষেপ নেন জিয়াউর রহমান। নতুন পাঁচটি ডিভিশন গঠন, প্রশিক্ষণ ব্যবস্থায় সংবিধান ও প্রাতিষ্ঠানিক দায়বদ্ধতা অন্তর্ভুক্ত করা, ‘ব্যাটম্যান সিস্টেম’ বাতিল করা, বেতন-ভাতা বৃদ্ধি এবং অবসরপ্রাপ্ত অফিসারদের জন্য বেসরকারি খাতে সুযোগ সৃষ্টি করেন। এছাড়া জিয়া সেনানিবাসে বাসা ভাড়ার পুনর্মূল্যায়ন ও কল্যাণ সুবিধা বাড়িয়ে নিম্নপদের সৈন্যদের আর্থিক স্থিতি উন্নত করেন। ফলে সেনাবাহিনীতে নতুন নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে পেশাদার মানসিকতা বৃদ্ধি পায়। এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে তিনি ধীরে ধীরে এক বিশৃঙ্খল ও বিভক্ত সেনাবাহিনীকে সংগঠিত ও কার্যকর বাহিনীতে রূপ দেয়ার চেষ্টা করেন।

জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক মতাদর্শ থেকে দূরে রাখার এবং রাষ্ট্রের আইনি কাঠামোর অধীন রাখার চেষ্টা করেছিলেন। তবে পুরোপুরি সফল হননি। তার সময়েও বাহিনীর ভেতরে ‘নেতৃত্বনির্ভর আনুগত্য’ বজায় ছিল। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত সময়ে সেনাবাহিনীতে প্রায় ২০টিরও বেশি ছোট-বড় ষড়যন্ত্র, হত্যাচেষ্টা ও বিদ্রোহ ঘটে। যেখানে ব্যক্তিকেন্দ্রিক নেতৃত্ব কিংবা অনুগতদের র‍্যাশনাল সিদ্ধান্ত ছিল, বাহিনীর নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ছিল না। জিয়াউর রহমান সামরিক বাহিনীকে ওয়েবারিয়ান কাঠামোয় গড়ে তোলার চেষ্টা করলেও সামরিক কর্মকর্তাদের নেতৃত্বনির্ভর আনুগত্যের কারণে তা সফল হয়ে ওঠেনি। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে জিয়াউর রহমানকে হত্যা করে সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য ও কর্মকর্তা।

জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের এক বছরের মাথায় ১৯৮২ সালে আব্দুস সাত্তারকে ক্ষমতাচ্যুত করে লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করেন। ওই বছরের ২৪ মার্চ ভোরে সামরিক বাহিনীর ট্যাংক রাষ্ট্রপতি ভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের প্রবেশপথ ও গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ভবনগুলো ঘিরে ফেলে। রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে গৃহবন্দি করা হয়। সামরিক বাহিনী রেডিও-টেলিভিশনসহ সব যোগাযোগমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণ নেয়। সকাল ৮টার দিকে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জাতির উদ্দেশে একটি বেতার ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি সংবিধান স্থগিত করার, জাতীয় সংসদ ভেঙে দেয়ার এবং সামরিক আইন জারির ঘোষণা দেন। নিজেকে চিফ মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হিসেবে ঘোষণা দেন।

এরশাদ তার ক্ষমতা দখলকে ‘জাতীয় স্থিতি ও শৃঙ্খলা রক্ষার প্রয়াস’ বলে ঘোষণা করেন। কিন্তু এ ঘোষণার ভেতর ছিল দ্বৈত চরিত্র। একদিকে তিনি সেনাপ্রধান হিসেবে বাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবহার করেন, অন্যদিকে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে বৈধতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালান। এরশাদের শাসনামলে সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক শাসনের অংশ হিসেবে পুনর্গঠন করা হয়। প্রধান সিদ্ধান্তগুলো নেয়া হতো প্রেসিডেন্ট হাউজ থেকে, যেখানে সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতনদের পদোন্নতি, রোটেশন ও কৌশলগত নিয়োগ নির্ধারিত হতো রাজনৈতিক আনুগত্যের ভিত্তিতে। যা পিতৃতান্ত্রিক বা ব্যক্তিতান্ত্রিক ব্যুরোক্রেসির নিখুঁত প্রতিরূপ। যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো টিকে থাকে, কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণের কেন্দ্রবিন্দু হয় ব্যক্তিগত অনুগত্য।

এরশাদের শাসনামলে আনুগত্য ও পুরস্কারের বিনিময়ে সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়। এ সময় রাষ্ট্রযন্ত্রের কেন্দ্রীয়করণ অভূতপূর্ব মাত্রায় পৌঁছে যায়। প্রেসিডেন্সি হয়ে ওঠে ক্ষমতার একমাত্র কেন্দ্র, জেলা পর্যায়ে পুলিশ প্রশাসনেও সেনা কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়। তবে এ সামরিকীকরণের ভেতর দিয়েই গড়ে ওঠে ব্যক্তিতান্ত্রিক কাঠামো, যেখানে আনুগত্য, পদের বণ্টন ও আর্থিক সুবিধা শাসনের মূল ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়। মুক্তিযোদ্ধা অফিসাররা একে একে সেনা কাঠামো থেকে বাদ পড়েন। ১৯৮১ সালে ৫০ জন ব্রিগেডিয়ার ও মেজর জেনারেলের মধ্যে মাত্র তিনজন ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। নেতৃত্ব চলে যায় পাকিস্তানফেরত অফিসারদের হাতে। এরশাদ জেলা প্রশাসনে, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় এবং উন্নয়ন বোর্ডে সেনা কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেন। কিন্তু ১৯৮৭-৮৮ সালের পর গণ-আন্দোলন তীব্র হলে বেসামরিক প্রশাসন ও রাজনৈতিক বিরোধী দলগুলোর চাপের মুখে এ প্রক্রিয়া ব্যর্থ হয়।

এরশাদের শাসনামলে সামরিক বাহিনীতে সরাসরি অভ্যুত্থানের প্রবণতা কমে এলেও প্রতিষ্ঠানটি মূলত ব্যক্তিনির্ভর সুবিধাবাদ, পেশাগত স্বার্থসিদ্ধির ওপর ভিত্তি করে টিকে থাকে। সামরিক বাহিনীর এ চরিত্র ‘পিতৃতান্ত্রিক কাঠামো’র নিখুঁত উদাহরণ, যেখানে আনুগত্যের ভিত্তি রাষ্ট্রীয় আদর্শ বা পেশাগত নীতিবোধ নয়, বরং ব্যক্তিগত পৃষ্ঠপোষকতা ও সুযোগ-সুবিধার লেনদেন। এ ব্যবস্থায় সামরিক কর্মকর্তাদের আনুগত্য অর্জিত হতো পদোন্নতি, আর্থিক সুবিধা ও অন্যান্য বৈষয়িক প্রলোভনের মাধ্যমে। যা সামরিক বাহিনীর পেশাদারত্ব ও প্রাতিষ্ঠানিক স্বায়ত্তশাসনকে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির মুখে ফেলে।

১৯৯০ সালে যখন সর্বদলীয় গণ-আন্দোলন শুরু হয় তখন সেনাবাহিনী শাসকের আনুগত্য নয়, রাষ্ট্রের স্থিতি রক্ষার পক্ষে অবস্থান নেয়। ওই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সেনাপ্রধান ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) এম নুরুদ্দিন খান। আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা না চালানোর সিদ্ধান্ত নেন তিনি। পতনের ঠিক আগের দিন এরশাদ সেনাপ্রধানকে ফোনকলও দিয়েছেন। কিন্তু তিনি রিসিভ করেননি। সেনাবাহিনীর সমর্থন না পেয়ে এরশাদ পদত্যাগে বাধ্য হন। বলা যায়, বাহিনী নিজের প্রাতিষ্ঠানিক সত্তা রক্ষার জন্য পিতৃতান্ত্রিক কাঠামো থেকে সরে আসে।

সামরিক অভ্যুত্থানের আরেকটি চেষ্টা হয় হয় ১৯৯৬ সালের ২০ মে। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগাযোগ এবং রাজনৈতিক তৎপরতায় লিপ্ত হওয়ার অভিযোগে তৎকালীন মেজর জেনারেল হেলাল মোর্শেদ ও ব্রিগেডিয়ার মিলন হামিদুর রহমানকে বাধ্যতামূলক অবসর দেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুর রহমান বিশ্বাস। বহিষ্কৃত ব্যক্তিরা ছিলেন তৎকালীন সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল আবু সালেহ মো. নাসিমের ঘনিষ্ঠ। তাই লেফটেন্যান্ট জেনারেল নাসিম সে বহিষ্কারাদেশ মেনে নেননি। তিনি রাষ্ট্রপতিকে অবসর আদেশ প্রত্যাহারের অনুরোধ করেন। ডিজিএফআইয়ের তৎকালীন প্রধান মেজর জেনারেল এমএ মতিন ও সশস্ত্র বাহিনীর পিএসও (প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার) সুবিদ আলী ভূঁইয়া সে সময় রাষ্ট্রপতির অবস্থানের পক্ষে ছিলেন। তারা রাষ্ট্রপতিকে অবসর আদেশে অনড় থাকার অনুরোধ করেন।

রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের অংশ হিসেবে নাসিম প্রতিটি ডিভিশন থেকে সেনা পাঠানোর নির্দেশ দেন। ওই দিনই বেলা ৩টার দিকে রাষ্ট্রপতি সিদ্ধান্ত নেন আবু সালেহ মো. নাসিমকে বরখাস্ত করে লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাহবুবুর রহমানকে সেনাপ্রধান বানাবেন। সে সময়ে প্রতিরক্ষা সচিব বহিষ্কারাদেশ ও নতুন সেনাবাহিনী প্রধান নিয়োগের বিষয়টি রেডিও-টেলিভিশনে ঘোষণা করেন। একই সঙ্গে ডিজিএফআই অফিসারদের দিয়ে ঢাকায় আসতে বলা সেনাসদস্যদের বলা হয় এটি নাসিমের ব্যক্তিগত আদেশ, সরকারি নয়। ফলে সেনাসদস্যরাও আর ঢাকায় আসেননি। বলা যায়, ওই সময়ে যা হয়েছে তাতে সেনাবাহিনীর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত ছিল না, বরং লেফটেন্যান্ট জেনারেল নাসিমের ব্যক্তিগত জেদের বহিঃপ্রকাশ ছিল সেটা।

আবু সালেহ মো. নাসিমের ব্যর্থ অভ্যুত্থান চেষ্টার পরবর্তী ১০ বছরে দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে আর আগমন ঘটেনি সেনাবাহিনীর। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি দেশব্যাপী রাজনৈতিক গোলযোগ ও বিশৃঙ্খলার মধ্যে সেনাবাহিনীর সমর্থনে দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদ ও তার সহযোগীদের সম্মিলিত চাপে ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করেন। ১২ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেন ড. ফখরুদ্দীন আহমদ। নতুন তত্ত্বাবধায়ক প্রশাসন জরুরি আইন বহাল রাখে, দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের সূচনা করে। এ সময়কালে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্বকে অন্তরীণ রাখাসহ বিভিন্ন বিতর্কিত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, যা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে সামরিক বাহিনীর সম্পর্ক নিয়ে জটিল বিতর্কের সৃষ্টি করে। ওই দুই বছরে সেনাবাহিনীর কিছু কর্মকর্তা বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতিতেও জড়িয়ে পড়েন বলে অভিযোগ রয়েছে।

তবে এক-এগারোর শুরুতে সেনাবাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিক হস্তক্ষেপ ছিল না, বরং এটি ছিল নেতৃত্বনির্ভর উদ্যোগ। বাহিনীর শীর্ষ নেতৃত্ব রাষ্ট্রীয় স্থিতি রক্ষার নামে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু এ পদক্ষেপ বাহিনীর সম্মিলিত প্রাতিষ্ঠানিক পরামর্শ বা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত সিদ্ধান্ত ছিল না। সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা-সদস্যরা এটিকে ‘কমান্ড লেভেল ম্যানুভার’ হিসেবে দেখেছিলেন। অর্থাৎ এটি ছিল নেতৃত্বনির্ভর, প্রাতিষ্ঠানিক সর্বসম্মতির ভিত্তিতে গৃহীত নয়।

এক-এগারো-পরবর্তী সময়ে প্রত্যাশা ছিল পুরনো ভুল থেকে বেরিয়ে এসে সেনাবাহিনী একটি পেশাদার বাহিনী হিসেবে গড়ে উঠবে। যদিও পরবর্তী সময়ে বিডিআর হত্যাকাণ্ডে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তার প্রাণ হারানো এবং রাষ্ট্রে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় তা বাধাগ্রস্ত হয়। ২০০৯ সাল থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের টানা পনেরো বছরের শাসনামলে রাষ্ট্রে কার্যত একটি কর্তৃত্বপরায়ণ রাজনৈতিক কাঠামো প্রতিষ্ঠিত হয়। বাহ্যিকভাবে গণতান্ত্রিক ও প্রশাসনিক নিয়ম বজায় থাকলেও শাসন ব্যবস্থার কেন্দ্রে গড়ে ওঠে এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক নির্বাহী ক্ষমতা। এ সময় সেনাবাহিনীর কাঠামো আনুষ্ঠানিকভাবে পেশাদার থাকলেও পদোন্নতি, পদায়নসহ নানা ক্ষেত্রে কর্তৃত্ব ছিল নির্বাহী নেতৃত্বের। ক্রমে পদোন্নতি থেকে পদায়ন—সব ক্ষেত্রে রাজনৈতিক আনুগত্যকে অগ্রাধিকার দেয়ার প্রবণতা আরো স্পষ্ট হয়। বলা যায় বাহিনী প্রাতিষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রের অংশ হলেও রাজনৈতিক আনুগত্যের বিনিময়ে ব্যক্তি ও তার আশপাশের বলয়কেন্দ্রিক শাসনকাঠামো গড়ে তুলেছিল আওয়ামী সরকার। সেনাবাহিনী অনেকটাই শেখ হাসিনার কোম্পানিতে রূপান্তরিত হয়।

সেনাবাহিনীকে সুবিধা দিয়ে নিয়ন্ত্রণে রাখার যে নীতি এরশাদ নিয়েছিলেন সে কৌশল আরো এক ধাপ এগিয়ে নিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সামরিক বাহিনীকে সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ করে দেয়া হয়। শেখ হাসিনার দেড় দশকে সেনাবাহিনীকে অনেকগুলো অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পের সঙ্গেও যুক্ত করা হয়।

শেখ হাসিনার শাসনামলে পদোন্নতি ও পদায়নের ক্ষেত্রে বাহিনীতে অনেক ক্ষেত্রে নিয়ম মানা হয়নি। পেশাগত দক্ষতার ভিত্তিতে নয়, কর্মকর্তাদের রাজনৈতিকীকরণের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। বিশেষ করে জেনারেল আজিজ আহমেদের সময় ব্যাপক অনিয়মের তথ্য পাওয়া যায়। সাধারণত বোর্ডের মাধ্যমে সেনাবাহিনীতে পদোন্নতি হলেও তার সময়ে বোর্ডের বাইরেও প্রমোশন দেয়া হয়। নোট বানিয়ে শেখ হাসিনার স্বাক্ষর নিয়ে অনেককে প্রমোশন দেয়ার ঘটনাও ঘটে এ সময়। যেটিকে বলা হতো নোট শিট প্রমোশন। ২০১৬-১৭ সালের আগ পর্যন্ত এ ধরনের কোনো প্রমোশন হয়নি, যা জেনারেল আজিজ তার সময়ে করেছেন। সেনাবাহিনীতে পাসড স্টাফ কলেজ বা পিএসসি না করলে কেউ লেফটেন্যান্ট কর্নেল হতে পারবে না বলেও নিয়ম ছিল। কিন্তু জেনারেল আজিজের সময় অনেককে মেজর জেনারেল পর্যন্ত করা হয়েছে। এর আগে ২০১৮ সালে শীর্ষ আরেক কর্মকর্তাকে টপকে জেনারেল আজিজকে সেনাপ্রধান নিয়োগ দিয়েছেলেন শেখ হাসিনা। নির্বাচনকে সামনে রেখে আনুগত্য বিবেচনায় তখন জেনারেল আজিজকে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। তার সময়ে দেশে রাতের ভোটের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে সেনাবাহিনী নির্বিকার ভূমিকা পালন করেছিল। পরবর্তী সময় বিভিন্ন গুম, খুন, মানবাধিকার লঙ্ঘনে সামরিক কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততার তথ্য উঠে আসে।

২০১৮ সালের ডিসেম্বরে রাতের নির্বাচনের পর শেখ হাসিনা আরো প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকেন। এ সময় তার স্বৈরতন্ত্র আরো প্রকট আকার ধারণ করে। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি আরো একটি একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে টানা চতুর্থবার ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। এর প্রায় ছয় মাস পরই কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন দমন-পীড়ন ও হত্যাযজ্ঞের মুখে গণ-আন্দোলনে রূপ নেয়। আগস্টে ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। সেনাবাহিনীকে বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দেয় শেখ হাসিনা সরকার। শেখ হাসিনার পতনের দুদিন আগে ৩ আগস্ট সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে বসেন। বৈঠকটি বেলা দেড়টা থেকে শুরু হয়ে ১০ মিনিটের বিরতি নিয়ে দেড় ঘণ্টা চলে। শুরুতে সেনাপ্রধান প্রায় আধঘণ্টার উদ্বোধনী বক্তব্য দেন, যেখানে তিনি ব্যাখ্যা করেন কেন সেনাবাহিনীকে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী সিভিল প্রশাসনের সহায়তায় নিয়োগ করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘সংকটময় মুহূর্তে সরকার চাইলে আমরা মোতায়েন হতে বাধ্য।’ তবে তিনি স্পষ্ট করে যোগ করেন, সেনারা কাউকে হত্যা করেনি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনারা কোথায় কত রাউন্ড গুলি ও ফাঁকা গুলি ছুড়েছে তার পরিসংখ্যানও দেন তিনি। এছাড়া চাপে থাকার বিষয়টিও উল্লেখ করেন সেনাপ্রধান। বক্তব্য শেষে মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা জানতে অফিসারদের কথা বলার সুযোগ দেয়া হয়। ক্যাপ্টেন, মেজর ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল পর্যায়ের ছয়-সাতজন অফিসার সেদিন সরাসরি মতামত দেন। তারা দেশব্যাপী জনগণের ক্ষোভের কথা তুলে ধরেন। র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) কয়েকজন কর্মকর্তার অগ্রহণযোগ্য কর্মকাণ্ডের কথা তুলে ধরেন বেশ কয়েকজন। সাধারণ মানুষের ওপর গুলি না চালানোর পক্ষে মত দেন তারা। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান অফিসারদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে ‘জনগণের ওপর গুলি চলবে না’ জানিয়ে সভা শেষ করেন। সংকটকালীন মুহূর্তে সেনাপ্রধান এককভাবে কোনো নির্দেশ বা সিদ্ধান্ত আরোপ করেননি; বরং বাহিনীর বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের মতামত, পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতা শুনে একটি সম্মিলিত সিদ্ধান্তে উপনীত হন। যা সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ কাঠামোয় ‘কনসেনসাসভিত্তিক ইনস্টিটিউশনাল ডিসিশন’-এর উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের শুনানিতে পুলিশের তৎকালীন আইজি আব্দুল্লাহ আল মামুনের জবানবন্দিতে এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত তথ্য উঠে আসে। ওই জবানবন্দি সূত্রে জানা যায়, ৪ আগস্ট বাহিনীর প্রধানদের সঙ্গে বৈঠকে ছাত্র-জনতার ওপর বলপ্রয়োগের নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা। রাত ১২টা থেকে সোয়া ১২টার দিকে তিন বাহিনীর প্রধানদের সঙ্গে বৈঠকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের বিষয়টি তোলেন তৎকালীন প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক। এতে শেখ হাসিনা ক্ষুব্ধ হন এবং বলেন, যা হওয়ার হবে, তিনি ক্ষমতা ছাড়বেন না। তিনি সেনাপ্রধানকে কঠোর হয়ে বিক্ষোভ দমনের নির্দেশ দেন।

ওই জবানবন্দি সূত্রে আরো জানা যায়, ৫ আগস্ট সকাল ৯টায় বাহিনীর প্রধানরা আবারো গণভবনে আসেন। বৈঠকে শেখ হাসিনা পুলিশের আইজি আব্দুল্লাহ আল মামুনকে দেখিয়ে বলেন, ‘ওরা ভালো কাজ করছে, সেনাবাহিনী পারবে না কেন।’ সামরিক কর্মকর্তারা শেখ হাসিনাকে আবারো ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার পরামর্শ দেন। একপর্যায়ে তিনি রেগে গিয়ে বলেন, ‘তোমরা আমাকে গুলি করে মেরে ফেলো।’ পরে প্রবাসী পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের হস্তক্ষেপে তিনি পদত্যাগ করে চলে যেতে রাজি হন। শেখ হাসিনা টেলিভিশনে প্রচারের জন্য একটি ভাষণ রেকর্ড করার ইচ্ছা প্রকাশ করলে সামরিক কর্মকর্তারা অপারগতা প্রকাশ করেন।

সেনাবাহিনীর এ মনোভাব এবং সিদ্ধান্তের ফলে শেখ হাসিনার পতন ত্বরান্বিত হয়। সামরিক বাহিনীর এই এপিক সিদ্ধান্ত ছিল যুক্তিনিষ্ঠ ও আইনভিত্তিক। যেখানে প্রতিষ্ঠান ও নাগরিকদের নিরাপত্তা এবং তাদের প্রতি দায়বদ্ধতাকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। সামরিক বাহিনীর এ অবস্থানের কারণে পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টারও কম সময়ে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান। এখানে উল্লেখ্য যে সেনাবাহিনীর এ অবস্থান কেবল কোনো ব্যক্তিগত নৈতিক প্রতিক্রিয়া ছিল না; এটি ছিল একটি সম্মিলিত, প্রাতিষ্ঠানিক ও সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত। যেখানে জুনিয়র থেকে সিনিয়র কর্মকর্তারা একই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে জনগণের ওপর অস্ত্র প্রয়োগ করা যাবে না। যেটিকে বলা যায় পূর্ণাঙ্গ ওয়েবারিয়ান রূপান্তরের মুহূর্ত। সেখানে নির্বাহী আনুগত্যের কেন্দ্র স্থানান্তরিত হয় ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্রের দিকে, নৈতিকতার আলোকে।

৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর লক্ষ করা যায় সেনাবাহিনীর নীতিনির্ধারণ সম্পর্কিত একাধিক সিদ্ধান্ত, পদোন্নতি, পদায়ন ও কাঠামোগত পুনর্গঠন মেধার ভিত্তিতে নেয়ার চেষ্টা হয়েছে। অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যায়ন, অভিজ্ঞতা ও কর্মদক্ষতা প্রধান সূচক হিসেবে কাজ করেছে; এসব সিদ্ধান্তে বাহিনীর ‘সামরিক কনসেনসাস’ প্রতিফলিত হয়েছে। এ সময় অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে ঐকমত্য ও মেরিটভিত্তিক স্বতন্ত্র সিদ্ধান্তগুলো নিতে দেখা যায়নি।

গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশে যখন নতুন সূচনার প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল, তখন রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতের সংস্কারে একের পর এক কমিশন গঠিত হয়। পুলিশ, প্রশাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকার—প্রতিটি খাতে লক্ষ্য ছিল গণতান্ত্রিক মূল্যবোধভিত্তিক নীতি, জবাবদিহিমূলক শাসন ও নাগরিকমুখী সেবা নিশ্চিত করা। কিন্তু বাস্তব চিত্রে এ উদ্যোগগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কাগজে-কলমে সীমিত থেকেছে। অনেক ক্ষেত্রে স্বৈরাচারী আমলের কাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো এখনো অপরিবর্তিত রয়েছে। ফলে গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী প্রত্যাশিত গণতান্ত্রিক রূপান্তর বাস্তবে তেমন প্রতিফলিত হয়নি। যে রাষ্ট্রকাঠামো ভেঙে নতুনভাবে নির্মাণের প্রতিশ্রুতি ছিল, তা রয়ে গেছে পুরনো আমলের আমলাতান্ত্রিক ভারে জর্জরিত। তবে এর মধ্যেও সেনাবাহিনী একটি ব্যতিক্রমী উদাহরণ তৈরির চেষ্টা করছে। বাহিনীর ভেতরে পুরনো ‘পিতৃতান্ত্রিক’ বা ব্যক্তিনির্ভর কাঠামোর পরিবর্তে প্রাতিষ্ঠানিক ঐকমত্য বা ‘কনসেনসাস’ভিত্তিক সিদ্ধান্তগ্রহণ তথা নীতিগতভাবে ওয়েবারিয়ান মডেলের দিকে অগ্রসর হওয়ার প্রবণতা দেখা গেছে।

দীর্ঘদিনের কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের সময় যখন তরুণ প্রজন্ম রাস্তায় নেমে আসে, তখন রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রায় প্রতিটি অংশই জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। সেই মুহূর্তে সামরিক বাহিনীর ভূমিকা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী বা এপিক ঘটনা। চূড়ান্ত পর্যায়ে সেনাবাহিনী জনগণের পক্ষে অবস্থান নেয় এবং ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে অস্ত্র ব্যবহার থেকে বিরত থাকে। তবে ইতিহাসের বাঁকে এই এপিক ঘটনার বিপরীতে ট্র্যাজিকও কম নয়। অতীতে বিভিন্ন সময়, বিশেষ করে শেখ হাসিনার শাসনামলে সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতি ও গুমসহ বিভিন্ন মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ, রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ, নাগরিক বা আইনের প্রতি অনুগত না থেকে নানাবিধ সুবিধা নিয়ে কর্তৃত্ব ও দুর্নীতিপরায়ণ শাসনের পক্ষ নেয়াটা রাষ্ট্রের জন্য ট্র্যাজিকও বটে।

দেওয়ান হানিফ মাহমুদ: সম্পাদক, বণিক বার্তা

[অনুলিখন ও সহায়তায় মাহফুজ রাহমান]