Image description

সংবিধান বিষয়ক সংস্কার কমিশন রিপোর্ট জমা দিয়েছে, ১৫ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখে। সেই রিপোর্টের বরাত দিয়ে দৈনিকগুলোর রিপোর্ট সূত্রে কিছু ধারণা পাওয়া গেলো। ইউটিউব টকশো ‘কনক সারোয়ার নিউজ’-এর শিরোনামে ‘রাষ্ট্রের সাংবিধানিক নাম বদল’ লেখা হয়েছে। ঢাকার আরো কিছু দৈনিক এমন ধারণা দিয়েছে। উল্লিখিত টকশোতে আমার দেশ সম্পাদক ড. মাহমুদুর রহমান সংশ্লিষ্ট পরিবর্তন প্রস্তাবটিকে অপ্রয়োজনীয় বলে মন্তব্য করেছেন।

বাংলাদেশের সাংবিধানিক নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে? প্রাথমিকভাবে জবাব দু’দিকেই যেতে পারে। বাংলাদেশের বিদ্যমান সংবিধানের ১৫৩(২)  অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এ সংবিধানের অনুমোদিত দুটো ভাষ্য আছে, বাংলা ও ইংলিশে। এ দুই ভাষ্যে ‘বিরোধ’ (কনফ্লিক্ট') হলে বাংলা ভাষ্য অগ্রাধিকার পাবে বলা হয়েছে ১৫৩(৩) অনুচ্ছেদে।সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১ ও ১৫৩ অনুযায়ী এ দেশের নাম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ এবং ইংলিশে লেখা People’s Republic of Bangladesh. 

এ দেশের ‘ইংলিশ নাম’ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য আপত্তি বা ভিন্নমত দেখা যায়নি। আপত্তি এসেছে ‘বাংলা নাম’ নিয়ে। যেহেতু এ দেশের ‘বাংলা নাম’-এর জন্য ‘ভিন্ন শব্দ’ প্রস্তাব করা হয়েছে। তাই বলা চলে ‘দেশের নাম বদলে দেয়ার প্রস্তাব’। বাস্তবে এটি ‘কাঙ্ক্ষিত পরিভাষা’ স্থাপনের প্রস্তাব, মূল নাম-এর ‘মর্ম’ ঠিক বা অক্ষত রেখে। এ বিবেচনায় সংশ্লিষ্ট প্রস্তাবটি দেশের নাম বদলে দেয়ার নয়, ‘উপযুক্ত পরিভাষা স্থাপনের বা ব্যবহারের’ প্রস্তাব।  

সম্ভবত এ বিষয়ে আমি অন্যতম অথবা প্রথম ও সোচ্চার ব্যক্তি সেই আপত্তি উপস্থাপনে। বলেছি, ইংলিশ ‘রিপাবলিক’-এর বাংলা ‘প্রজাতন্ত্র’ হওয়া ‘উচিৎ’ নয় এবং শুদ্ধও নয়। অন্য লেখায় জানিয়েছি, এই রিপাবলিক পরিভাষাটি রাষ্ট্রের নাম হিসেবে গ্রহণের ধারাবাহিকতা। অনাকাঙ্ক্ষিত রাজতন্ত্র (ষোড়শ লুই) উচ্ছেদের জন্য পুরোদস্তুর একটি বিপ্লব ঘটায় ফরাসি জনগণ। উচ্ছেদকৃত রাজতন্ত্রের জায়গায় তারা স্থাপন করে ‘রিপাবলিক’। সঙ্গত কারণেই সেই ‘রিপাবলিক’-এর মর্ম (স্পিরিট) ‘রাজা-প্রজা’র সম্পর্কের ঊর্ধ্বে ভিন্ন কিছু হওয়ার কথা। বাংলায় আমরা যখন রিপাবলিককে প্রজাতন্ত্র বলি, সেখানে স্পষ্ট করেই ‘রাজা-প্রজা’র ‘সুর-তাল-লয়’ ‘বেজে’ ওঠে। আমি যুক্তি দিয়েছি, বাংলা ‘প্রজাতন্ত্র’-এর মধ্যে ‘রিপাবলিক’-এর দ্যোতনা থাকে না, থাকে ‘রাজা’র ‘অঘোষিত’ অস্তিত্ব। তাই ‘প্রজাতন্ত্র’ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হয় না।

রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করে ফরাসি জনগণ নিজেদের প্রত্যেককে একেকজন পৃথক ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে। তারা তাই দেশের নাম দিয়েছে ‘রিপাবলিক’। বাংলায় আমি এর প্রতিশব্দ হিসেবে প্রস্তাব করেছি ‘জনতন্ত্র’। এই পরিভাষাটিকে জনপ্রিয় করার জন্য আমার ছাত্র-ছাত্রীদের উৎসাহিত করেছি। তাতে কিছু ফলও মিলেছে বটে। অল্প কিছু মানুষের কাছে শব্দটি পরিচিত হয়েছে।

রিপাবলিক-এর বাংলা জনতন্ত্র মানা গেলে পরের প্রশ্ন আসে ‘পিপল’স রিপাবলিক’-এর একসাথে বাংলা কী হতে পারে। পিপল’স-এর বাংলা ‘জনগণ’ হিসেবে মোটামুটি গ্রাহ্য। রিপাবলিক-এর বাংলা ‘জনতন্ত্র’ নেয়া হলে ‘পিপল'স রিপাবলিক’-এর বাংলা একসাথে হতে পারে ‘গণজনতন্ত্র’ বা ‘গণজনতন্ত্রী’।

‘সংবিধান কমিশন’ দেখছি বা পড়ছি, প্রস্তাব করেছে ‘পিপল'স রিপাবলিক’ হবে ‘জনগণতন্ত্রী’ এবং ‘রিপাবলিক’-এর বাংলা হবে ‘নাগরিকতন্ত্র’। নিজের দায়িত্বে সংশ্লিষ্ট রিপোর্টটি না দেখে এবং দৈনিকের রিপোর্টের ভিত্তিতে আমার এ বিষয়ক পর্যবেক্ষণ জানাই।

‘রিপাবলিক’-এর বাংলা ‘নাগরিকতন্ত্র’ আর ‘পিপল'স রিপাবলিক’-এর বাংলা ‘জনগণতন্ত্রী’ প্রস্তাব করে থাকলে তা যে ‘যথেষ্ট বিবেচনাপ্রসূত’ নয়, শুরুতেই তা বলতে পারি। বলতে পারি, একই ‘রিপাবলিক’ শব্দ/পরিভাষার বাংলা তারা কেনো ভিন্ন করলেন, তা স্পষ্টতই ব্যাখ্যাযোগ্য হয়ে থাকলো। কমিশন রিপাবলিক -এর বাংলা নাগরিকতন্ত্র প্রস্তাব করে নতুন কিছু প্রশ্নের সুযোগ তৈরি করেছে। আমার প্রস্তাবিত ‘জনতন্ত্র’ এবং ‘গণজনতন্ত্রী’ গ্রহণ করার মাধ্যমে একটা সহজ ও যৌক্তিক বাংলা উপস্থাপনের সুযোগ উন্মুক্ত রয়েছে।

কমিশনের অন্য প্রস্তাবাদি বিষয়ে কিছু বলার দরকার আছে। আপাতত বলে রাখি, প্রস্তাবিত আইনসভার ‘মূল নাম’ কী হবে, দৈনিকগুলোর রিপোর্টে তা পাইনি। পেয়েছি নিম্ন কক্ষ ‘ন্যাশনাল এসেম্বলি’ উচ্চ কক্ষ সিনেট। নিম্ন কক্ষের আবার একটি ‘অনূদিত নাম’ আছে ‘জাতীয় সংসদ’। অনেকবার লিখেছি, কোনো ‘নাম’-এর ‘অনুবাদ’ হয় না। এখানে তেমন প্রস্তাবের কথা রিপোর্টে পাচ্ছি। এটা অগ্রহণযোগ্য।

যথেষ্ট ব্যয়সাপেক্ষ ‘পৃথক কক্ষ’ না বানিয়ে কথিত বিশেষজ্ঞ ও অভিজ্ঞদের দ্বারা জাতি কিভাবে কথিত উপকৃত হতে পারে, আমি তা প্রস্তাব করেছি। প্রস্তাব করেছি আরো কিছু বিষয়ও। মনোযোগ দেয়ার ‘মনের অভাব’ আছে। বিদেশি শব্দ/পরিভাষার 'বাংলায়ন' বিষয়ে বিবেচনায় রাখা উচিৎ শব্দের দ্যোতনা, মর্ম ও উচ্চারণগত সুবিধা। সংশ্লিষ্ট সবাই বিষয়টি মনে রাখতে পারেন।

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি বিজ্ঞানের শিক্ষক।

ড. তারেক ফজল