
গত ১৬ বছরে, একদলীয় কর্তৃত্ববাদী ও পরাধীন সরকারের ছত্রছায়ায়, বাংলাদেশ এমন এক সুসংগঠিত এবং বিপজ্জনক বিদেশি গোয়েন্দা প্রভাবের শিকার হয়েছে, যা আমাদের স্বাধীনতা-পরবর্তী ইতিহাসে নজিরবিহীন। এই অনুপ্রবেশ ও প্রভাব বিস্তারের প্রধান কারিগর হচ্ছে ভারতের বহিঃগোয়েন্দা সংস্থা—রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং । প্রাথমিকভাবে ‘মৈত্রী’ ও ‘আঞ্চলিক সহযোগিতা’র মোড়কে শুরু হওয়া এই সম্পর্ক পরে রূপ নিয়েছে এক গভীর গোয়েন্দা নেটওয়ার্কে, যা বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা, অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা ও কৌশলগত স্বনির্ভরতাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। এটি নিছক রাজনৈতিক মতানৈক্য নয়, বরং একটি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্ন। এখন সময় এসেছে বাস্তব ও নির্ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার।
‘র’-এর বাংলাদেশে উপস্থিতি শুধু রাজনৈতিক পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকেনি; বরং এটি সামরিক, অর্থনৈতিক, তথ্যপ্রযুক্তি, গোয়েন্দা ও বেসামরিক খাতের বহু গুরুত্বপূর্ণ স্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। নিম্নোক্ত কিছু বিষয়ে এ অনুপ্রবেশ স্পষ্ট—
প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বাহিনীতে অনুপ্রবেশ
বাংলাদেশের সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি এবং কোস্টগার্ডসহ অন্যান্য নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর তথ্যপ্রযুক্তি অবকাঠামো গঠনের সময় ভারতীয় কোম্পানিগুলোকে সরবরাহকারী ও প্রযুক্তিগত পরামর্শক হিসেবে যুক্ত করা হয়। কিছু ক্ষেত্রে এই অংশগ্রহণ কৌশলগত চুক্তির নামে বৈধভাবে করা হলেও বাস্তবে সেগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ কনফিগারেশন, সফটওয়্যার কোড এবং হার্ডওয়্যারে সম্ভাব্য ব্যাকডোর ও নজরদারি ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়েছে বলে গোয়েন্দা সূত্রে সন্দেহ প্রকাশ পেয়েছে। বিশেষভাবে উদ্বেগজনক হলো—সামরিক যোগাযোগব্যবস্থা, ডিজিটাল ম্যাপিং, জিপিএস ট্র্যাকিং সিস্টেম এবং নজরদারি ড্রোন প্রোগ্রামের মতো অতিসংবেদনশীল খাতে ভারতীয় সফটওয়্যার ও সার্ভার ইনস্টলেশন। এর মাধ্যমে তারা বাংলাদেশের সেনা চলাচল, অপারেশন পরিকল্পনা, সীমান্ত নজরদারি, এমনকি কমান্ড-চেইনের নির্ভরযোগ্যতা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহের সক্ষমতা অর্জন করে। এছাড়া যেসব বাহিনীতে ভারতীয় প্রশিক্ষণ বা প্রযুক্তি সহায়তা ছিল—তাদের কিছু সদস্য পরে ‘র’-এর প্ররোচনায় গোয়েন্দাকাজে ব্যবহৃত হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এই অনুপ্রবেশ শুধু তথ্যজ্ঞানিক নয়, এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক নিয়ন্ত্রণ কৌশলও বটে, যেখানে বাহিনীর চিন্তাধারাও প্রভাবিত করার চেষ্টা করা হয়েছে।
টেলিকম ও সাইবার পরিকাঠামোতে প্রভাব বিস্তার
বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ খাত ও ডিজিটাল অবকাঠামো—যেমন : সরকারি ওয়েবসাইট, নাগরিক সেবা পোর্টাল, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আইটি নেটওয়ার্ক, জাতীয় পরিচয়পত্র সার্ভার, এমনকি নির্বাচন কমিশনের তথ্যভাণ্ডার—এসব জায়গায় ভারতীয় সফটওয়্যার ফার্ম এবং প্রযুক্তি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সক্রিয়ভাবে কাজ করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই প্রতিষ্ঠানের অনেকগুলো ‘র’-এর সামনের সারির ব্যবসায়িক মুখ। যেমন—ভারতের কয়েকটি বহুজাতিক আইটি কোম্পানি, যাদের সাব-কন্ট্রাক্টে বাংলাদেশে প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে—তাদের প্রকৃত মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণের লিংক ‘র’-এর সঙ্গে প্রমাণিত না হলেও সন্দেহজনক। এখানে তারা যেসব কাজের সুযোগ পেয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে।
নাগরিক ডেটা অ্যাক্সেস : যেমন মোবাইল লোকেশন, কল রেকর্ড, ভোটার তথ্য, জন্মসনদ ও জাতীয় পরিচয় ডেটা।
সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণ বিশ্লেষণ : অভ্যন্তরীণ মেইল, নথিপত্র, বার্তা আদান-প্রদান পর্যবেক্ষণ।
মনিটরিং সিস্টেমে হস্তক্ষেপ : পুলিশের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ, সিসিটিভি মনিটরিং এবং ক্রাইম ডেটাবেস ব্যবস্থাপনায় সমন্বয়ের মাধ্যমে নজরদারি।
এই অনুপ্রবেশ শুধু প্রযুক্তিগত নিরাপত্তা নয়, বরং একটি সার্বিক সাইবার সার্ভেইলেন্স মডেল, যার মাধ্যমে দেশ পরিচালনার প্রতিটি স্তর নিয়ন্ত্রণের পথে পা বাড়ানো হয়।
অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক গোয়েন্দাবৃত্তি
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বহু চুক্তি হয়েছে, যেগুলো ‘বাণিজ্য সহযোগিতা’ বা ‘অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব’ শিরোনামে প্রচার করা হলেও বাস্তবে সেগুলো ছিল একতরফা ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্বার্থের পরিপন্থী। বহু ক্ষেত্রে ভারতীয় কোম্পানিগুলো বিশেষ ছাড় পেয়েছে, শুল্ক অব্যাহতি, জমি বরাদ্দ, ট্যাক্স হ্রাস, এমনকি রাজনৈতিক আশীর্বাদ পেয়েছে, যার মাধ্যমে তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে অনুপ্রবেশ করে অলিগোপলি বা মনোপলি বাজার কৌশল গড়ে তোলে। ‘র’ এই অর্থনৈতিক অনুপ্রবেশকে একটি ‘ইকোনমিক ইনটেলিজেন্স’ অপারেশন হিসেবে ব্যবহার করে।
রাজনৈতিক দল বা মিডিয়া হাউসগুলোর অর্থায়নে প্রভাব বিস্তার করে, যাতে ভারতবান্ধব অবস্থান তৈরি হয়। এসব চুক্তি ও কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব হ্রাস করে এবং আমাদের পরিকল্পিত উন্নয়নকে দীর্ঘ মেয়াদে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে।
দেশীয় গোয়েন্দা সংস্থায় অনুপ্রবেশ
এটি পুরো চিত্রের সবচেয়ে উদ্বেগজনক ও বিপজ্জনক দিক। দীর্ঘদিন ধরে নানা চ্যানেলে, ‘র’- এর লোকজন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা—ডিজিএফআই, এনএসআই এবং পুলিশ গোয়েন্দা শাখায় নানাভাবে অনুপ্রবেশ করে। এর মধ্যে রয়েছে—
স্থানীয় এজেন্ট নিয়োগ : প্রশাসনের মধ্যেই এমন কিছু ব্যক্তি ছিল, যারা আর্থিক সুবিধা, রাজনৈতিক প্রভাব বা আদর্শিক কারণে ভারতের পক্ষে কাজ করেছে।
ক্যাম্পে অংশগ্রহণের ছুতোয় সংযোগ : প্রশিক্ষণ, সাংস্কৃতিক বা ব্যবসায়িক সম্মেলনের নামে গোয়েন্দা সদস্যদের সঙ্গে নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয়েছে।
সহযোগিতার নামে তথ্য চুরি : যৌথ সন্ত্রাসবিরোধী চুক্তির আড়ালে গোপনে নিরাপত্তা বিশ্লেষণ, সরকারি রিপোর্ট, সেনা চলাচল বা ইন্টারনাল পলিসি লিক করা হয়েছে।
ফলে, বাংলাদেশ সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত ভারতের কাছে আগাম পৌঁছে যেত, যার ফলে কৌশলগত সুবিধা একতরফাভাবে ভারতের হাতে চলে যেত।
এই চারটি খাতে ‘র’-এর কার্যক্রমকে উপেক্ষা করা হলে বাংলাদেশ শুধু তার বাহ্যিক নিরাপত্তা হারাবে না—বরং অভ্যন্তরীণভাবে একটি নির্বিকল্প নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর শিকার হবে, যার পরিণতি হবে রাষ্ট্রীয় অধীনতা ও জাতীয় পরিচয়ের বিলুপ্তি। এখন সময় এসেছে এই অনুপ্রবেশ চিহ্নিত করে, রাজনৈতিক সংকল্পের মাধ্যমে পরিষ্কার শুদ্ধি অভিযান চালানো।
কূটনীতি নয়, প্রতিকূল কার্যকলাপ
ভারতের আচরণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তারা যে দেশেই প্রভাব বিস্তার করেছে, সেখানে রাজনৈতিক অবরোধ, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কৌশল গ্রহণ করেছে। নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ—সবার অভিজ্ঞতাই এক। বাংলাদেশে তাদের প্রভাব বিস্তারের মাত্রা ও গভীরতা আরো বেশি, কারণ পুরোনো শাসকগোষ্ঠী তাদের কাছে নিজেকে সমর্পণ করেছিল। ‘র’-এর মূল উদ্দেশ্য হলো—বাংলাদেশকে রাজনৈতিকভাবে নির্ভরশীল ও সামরিকভাবে দুর্বল রাখা। চীন, তুরস্ক, পাকিস্তান বা মুসলিম বিশ্বে বাংলাদেশের সম্ভাব্য কৌশলগত সংযোগ রুদ্ধ করা। অর্থনৈতিক দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করা। ইসলামপন্থি ও জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে নিঃশেষ করার কৌশল বাস্তবায়ন।
এই গভীর সংকট থেকে উত্তরণের জন্য কিছু জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে—
১. নিরাপত্তা অডিট ও তথ্য অবকাঠামোর পর্যালোচনা
বর্তমানে দেশের বহু সরকারি দপ্তর, সামরিক সদর দপ্তর, নিরাপত্তা বাহিনীর যোগাযোগব্যবস্থা, এমনকি তথ্য ও প্রযুক্তিনির্ভর গোয়েন্দা ইউনিটে ভারতীয় সফটওয়্যার, হার্ডওয়্যার ও প্রযুক্তিগত পরিকাঠামো ব্যবহৃত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই এসব প্রযুক্তি ভারতের সঙ্গে করা চুক্তির মাধ্যমে বা তাদের ব্যবসায়িক অংশীদারদের মাধ্যমে ইনস্টল করা হয়েছে।
এ কারণে এখন জরুরি হয়ে পড়েছে একটি সম্পূর্ণ ও স্বাধীন নিরাপত্তা অডিট পরিচালনা করা। সমস্ত রাষ্ট্রীয় ও সামরিক তথ্যপ্রযুক্তি নেটওয়ার্ক পরীক্ষা করে সন্দেহজনক উপাদান বা সম্ভাব্য ‘ব্যাকডোর’ শনাক্ত করবে।
সরকারি সার্ভার, ডেটা সেন্টার, সামরিক কমিউনিকেশন চ্যানেল ইত্যাদির মধ্যে স্পাইওয়্যার, ট্র্যাকিং ডিভাইস বা গোপন নজরদারি ব্যবস্থা খুঁজে বের করবে। ভারতীয় বা বিদেশি কোম্পানির দেওয়া সফটওয়্যার ও আইটি সেবা পুনর্মূল্যায়ন করে তা বাতিল করে নিরাপদ, দেশীয় বা বন্ধুপ্রতিম উৎস থেকে প্রাপ্ত প্রযুক্তির স্থাপন নিশ্চিত করবে। এই অডিট শুধুই প্রযুক্তিগত নয়, বরং একটি জাতীয় নিরাপত্তা জরিপ, যা রাষ্ট্রের কৌশলগত সক্ষমতা পুনর্নির্মাণের ভিত্তি তৈরি করবে।
অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থায় শুদ্ধি অভিযান
গোয়েন্দা সংস্থার নিরপেক্ষতা ও গোপনীয়তা হচ্ছে জাতীয় নিরাপত্তার মেরুদণ্ড। অথচ বিগত সরকারের সময় ডিজিএফআই, এনএসআই, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন প্রভৃতি সংস্থায় রাজনৈতিক আনুগত্যের ভিত্তিতে নিয়োগ ও পদোন্নতি দেওয়া হয়, যার সুযোগে নেয় বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা।
একটি শক্তিশালী কাউন্টার-ইন্টেলিজেন্স অপারেশন পরিচালনা করা জরুরি, যার মাধ্যমে সমস্ত গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের ব্যাকগ্রাউন্ড স্ক্রিনিং, বিদেশ ভ্রমণ ইতিহাস, পারিবারিক সংযোগ এবং অর্থনৈতিক লেনদেন যাচাই করা হবে। সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ, নজরদারি ও প্রয়োজনে অপসারণ এবং বিচার প্রক্রিয়ায় আনা হবে। একটি নতুন নিরাপত্তা প্রটোকল চালু করা হবে, যা বিদেশি সংযোগ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ এবং পেশাগত অনৈতিকতার বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি বাস্তবায়ন করবে। এই অভিযান পরিচালনার জন্য সরকারের উচিত একটি উচ্চপর্যায়ের ‘ন্যাশনাল কাউন্টার ইনটেলিজেন্স টাস্কফোর্স’ গঠন করা।
জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠন
বাংলাদেশে এখনো পর্যন্ত জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ে নীতিনির্ধারণে কোনো কৌশলগত ও কেন্দ্রীয় সংস্থা কার্যকরভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ফলে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা, দ্বন্দ্ব ও তথ্যবিভ্রাট পরিলক্ষিত হয়। এর ফলে জাতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই একটি জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠন করা এখন সময়ের দাবি।
এটি প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত হবে এবং তাতে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী প্রধান, ডিজিএফআই, এনএসআই, পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্রসচিব এবং সাইবার সিকিউরিটি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা অন্তর্ভুক্ত থাকবেন। সংস্থাটি গোয়েন্দা তথ্য বিশ্লেষণ করবে, কৌশল নির্ধারণ করবে এবং জাতীয় নিরাপত্তা নীতিমালার খসড়া তৈরি করবে।
কৌশলগত মিত্রপক্ষ পুনর্গঠন
বর্তমানে ভারতের ওপর একচেটিয়া নির্ভরতা আমাদের কৌশলগত নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে আমাদের প্রতিরক্ষা, প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক সহায়তার বিকল্প উৎস খুঁজে বের করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমরা বন্ধুদেশের সহযোগিতা নিতে পারি।
চীনের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম, ইলেকট্রনিক যুদ্ধপ্রযুক্তি এবং সীমান্ত ব্যবস্থাপনা বিষয়ে সহযোগিতা বৃদ্ধি করা।
তুরস্কের সঙ্গে সামরিক প্রশিক্ষণ, ড্রোন প্রযুক্তি এবং কৌশলগত গোয়েন্দা সহায়তার আদান-প্রদান।
মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ ইসলামি ও আঞ্চলিক সংহতি গড়ে তোলা এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও সাইবার সহযোগিতা। এই মিত্রপক্ষগুলো শুধু প্রতিরক্ষা নয়, বরং কৌশলগত স্বাধীনতার জন্য এক নতুন ভারসাম্য সৃষ্টি করবে।
জাতীয় সুরক্ষা সংস্কৃতি গড়ে তোলা
বিদেশি গোয়েন্দা তৎপরতা ও প্রভাব মোকাবিলা করতে হলে শুধু সরকার বা সেনাবাহিনী যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন গণমানুষের অংশগ্রহণ এবং সচেতনতা। এ জন্য জাতীয় পর্যায়ে একটি সুরক্ষা-সচেতনতা আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
এই কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাতীয় নিরাপত্তা ও দেশপ্রেমবিষয়ক সচেতনতামূলক পাঠ্যক্রম চালু করা। গণমাধ্যমে নিয়মিত জনসচেতনতামূলক প্রচার, যেখানে স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হবে বিদেশি হস্তক্ষেপের ধরন ও তা থেকে দেশকে রক্ষা করার উপায়। সাইবার সচেতনতা ক্যাম্পেইন, যাতে মানুষ ফেক নিউজ, মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চালানো বিদেশি প্রভাবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে।
‘র’-এর অনুপ্রবেশ ও বাংলাদেশে তাদের প্রভাব বিস্তার কোনো রাজনৈতিক প্রচার বা কল্পিত ষড়যন্ত্রতত্ত্ব নয়—এটি একটি বাস্তবতা, যা দীর্ঘ সময় ধরে পরিকল্পিতভাবে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এটি আজ আমাদের ইতিহাসের এক তিক্ত অধ্যায়, যেখানে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের ভেতরে অন্য একটি দেশের গোয়েন্দা সংস্থা নির্ভয়ে নাক গলিয়েছে, আমাদের তথ্য, নীতিনির্ধারণ এবং নিরাপত্তার ওপর অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। এ এক ভয়াবহ ‘ছায়া শাসন’, যা দৃশ্যমান সরকারের আড়ালে থেকেও পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকে দিকনির্দেশনা দেওয়ার চেষ্টা করেছে।
এই প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছিল বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার ছদ্মবেশে—বাণিজ্য, প্রযুক্তি, যৌথ প্রশিক্ষণ, সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান ইত্যাদির নামে। ধীরে ধীরে সেই ‘সহযোগিতা’ রূপ নেয় এক ধরনের নিয়ন্ত্রিত প্রভাব বিস্তারে, যার কেন্দ্রে ছিল বাংলাদেশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে ভারতের কৌশলগত স্বার্থে ব্যবহার করা। এর পরিণতি ছিল ভয়াবহ—দেশের বাহিনীগুলোকে রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করা, নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ এবং এমনকি জাতীয় নেতৃত্ব ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকেও নিয়ন্ত্রণে আনা। বিদেশি হস্তক্ষেপের এই ছায়া শুধু রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার পরিপন্থী নয়, এটি জাতির আত্মমর্যাদা ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বপ্নের প্রতিও আঘাত হানে। তাই আজ প্রয়োজন প্রতিশোধ নয়—প্রয়োজন জাতীয় শুদ্ধি ও পুনর্গঠন।
এই পুনর্গঠনের প্রথম ধাপ হচ্ছে সত্যকে স্বীকার করা—আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন স্তরে বিদেশি প্রভাব অনুপ্রবেশ করেছে এবং আমরা তা অনেক সময় জেনে-শুনেই উপেক্ষা করেছি। দ্বিতীয় ধাপ হলো সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ—রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে, প্রতিটি বিভাগে, প্রতিটি সংস্থায় একটি কাঠামোগত শুদ্ধি অভিযান চালানো, যাতে শুধু দক্ষ, সৎ ও দেশপ্রেমিক নাগরিকরা নেতৃত্ব দিতে পারেন। এ কাজে নেতৃত্ব দিতে হবে নতুন প্রজন্মকে—যারা শৃঙ্খল ভাঙার স্বপ্ন দেখে, যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে, যারা মনে করে বাংলাদেশ কারো করুণা নয়, বরং লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এক অবিনাশী চেতনার নাম।
লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক, গবেষক ও লেখক