Image description

সম্প্রতি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের চারটি ছবি ছড়িয়ে পড়েছে। একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে—খাকি রঙের প্যান্ট, আকাশি রঙের শার্ট, পায়ে কেডস। ক্যাজুয়াল ভঙ্গিতে লণ্ডনের অদূরে একটি ছোট্ট শহরের বাসস্টপেজে দাঁড়িয়ে মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে আছেন তারেক রহমান। দ্বিতীয় ছবিতে—বাসে উঠছেন তারেক রহমান। তৃতীয় ছবিতে—বাসের ভেতরে প্রবেশের জন্য কার্ড পাঞ্চ করছেন তারেক রহমান। চতুর্থ ছবিতে—বাস থেকে নামছেন তারেক রহমান।

সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া তারেক রহমানের এই ছবিগুলো নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা চলছে। ছবিগুলো নিয়ে সংবাদও প্রকাশিত হয়েছে। এসব ছবির নিচে প্রচুর প্রশংসা যেমন রয়েছ, তেমনি আছে তীর্যক মন্তব্য। অনেকেই মনে করেন, লন্ডনে তারেক রহমান কীভাবে একজন সাধারণ মানুষের মতো জীবন-যাপন করছেন, এই ছবিগুলো তার প্রমাণ। অনেকে মনে করেন, এগুলো 'পলিটিক্যাল স্টান্টবাজি'। যারা এটাকে 'স্টান্টবাজি' মনে করেন তাদের যুক্তি হলো, ছবিগুলো কেউ একজন স্বতঃস্ফূর্তভাবে তোলেননি। বরং ছবির যে ধারাবাহিকতা; বাসের জন্য তারেক রহমানের অপেক্ষা, বাস ওঠা এবং তারপর নির্দিষ্ট স্টপেজে নেমে যাওয়ার যে ছবিগুলো দেখা যাচ্ছে, তা পরিকল্পনা করেই তোলা হয়েছে।

প্রশ্ন হলো, হঠাৎ করে তারেক রহমানের এই ছবিগুলো কেন ভাইরাল হলো বা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হলো? লন্ডনে তিনি যে অতি সাধারণ জীবন-যাপন করেন, এত বছর পরে এটি বোঝাতে হচ্ছে কেন? তিনি বাংলাদেশের একজন সাবেক রাষ্ট্রপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ছেলে। উপরন্তু দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দলের দ্বিতীয় শীর্ষ ব্যক্তি, কার্যত প্রধান। কিন্তু তিনি পাবলিক বাসে চড়ছেন, এই ঘটনার সংবাদমূল্য যতই থাকুক না কেন, লন্ডনের মতো শহরে এটি খুব অস্বাভাবাবিক দৃশ্য নয়। কেননা উন্নত বিশ্বের শহরে অনেক বড় রাজনীতিবিদ বা খ্যাতিমান মানুষেরাও পাবলিক বাসে চড়েন। তাতে তাদের জাত যায় না। কেননা, এসব দেশের পাবলিক পরিবহন অনেক উন্নত। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে এসব বেশ খায়। অর্থাৎ মানুষ যদি দেখে যে কোনো নেতা অতি সাধারণ পোশাক পরছেন, তাতে অনেকেই বিস্মিত হয়। অথচ একজন খ্যাতিমান বা সম্পদশালী ব্যক্তিও সাধারণ পোশাক পরতে পারেন। স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে রাস্তায় বেরোতে পারেন। এটা নির্ভর করে জীবন সম্পর্কে তার বোধ, তার দর্শন, রুচি এবং সর্বোপরি তার স্টাইলের ওপর।

খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ ও অ্যাক্টিভিস্ট অধ্যাপক আনু মুহাম্মদকেও দেখেছি বাসের জন্য রাজধানীর মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছেন। অথচ তার মতো একজন মানুষের ব্যক্তিগত গাড়ি থাকা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু তিনি হয়তো মনে করেছেন যে তার ব্যক্তিগত গাড়ির প্রয়োজন নেই অথবা গাড়ি কেনার মতো সক্ষমতা তার নেই। কিংবা তিনি সচেতনভাবেই সাধারণ জীবন-যাপনে অভ্যস্ত। এমনকি তার পোশাকেও জমকালো ভাব নেই। এই সিম্পলিসিটিই তার স্টাইল। সুতরাং অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের পাবলিক বাসে চড়া নিয়ে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।

তবে জনমনস্তত্ত্বই এমন যে, তারা বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাধারণ জীবন-যাপন দেখে বিস্মিত হয়। বাংলাদেশের খ্যাতিমান রাজনীতিবিদদের মধ্যে সাবেক রাষ্ট্রপতি ও স্পিকার আব্দুল হামিদের সাধারণ পোশাক-আশাক এবং কথাবার্তায় আঞ্চলিকতা মানুষকে আনন্দ দিতো। স্পিকার থেকে রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরে সংসদ ভবন এলাকায় তার একটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রয়াত সংসদ সদস্য মঈনুদ্দীন খান বাদল তার বক্তৃতায় রসিকতা করে বলেছিলেন,  আব্দুল হামিদ সম্ভবত পৃথিবীর প্রথম স্যুট টাইয়ের সঙ্গে স্যান্ডেল পরা প্রেসিডেন্ট!

রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে থাকা অবস্থায়ও তিনি নিজের বাড়ি কিশোরগঞ্জের মিঠামইনে গিয়ে লুঙ্গি আর স্যান্ডেল পরে ছোটবেলার বন্ধুদের সাথে ঘুরেছেন—এমন খবরও মানুষ জানে। রাজনৈতিক পরিচয় যাই হোক না কেন, ব্যক্তি আব্দুল হামিদের এই সরলতা ও সাধারণ জীবন-যাপন খুব সহজেই তাকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করেছে।

তার মানে কোনো একজন ক্ষমতাবান বা বিত্তশালী মানুষও যখন অতি সাধারণ মানুষের মতো জীবন-যাপন করেন, তখন সাধারণ মানুষ তার সঙ্গে নিজেদের মিল খুঁজে পায়। মানুষ মনে করে 'তিনি আমাদেরই মতো' এবং 'তিনি আমাদের লোক'। যে কারণে সাধারণ মানুষের সঙ্গে খুব সহজে মিশে যেতে পারা রাজনীতিবিদরা দ্রুত জনপ্রিয় হন।

ঝালকাঠি-২ আসনের প্রয়াত সংসদ সদস্য জুলফিকার আলী ভূট্টোকেও আমরা ছোটবেলায় দেখেছি মানুষের বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকে যেতেন। গ্রামের বাড়িতে সাধারণত রান্নাঘর থাকে বাড়ির পেছনে। তিনি সালাম দিয়ে সরাসরি রান্নাঘরে ঢুকে যেতেন এবং হাঁড়ির ঢাকনা খুলে দেখতেন কী রান্না হয়েছে। নিজের হাতে তুলে খাবার খেতেন। অনেকে তার এই সরলতা বা মানুষের সঙ্গে দ্রুত মিশে যেতে পারার এই গুণকে 'ভোট পাওয়ার কৌশল' বললেও ঝালকাঠির রাজনীতিতে মানুষ এখনও ভূট্টোকে স্মরণ করে।

এই জনমনস্তত্ত্বের কারণেই লন্ডন শহরের রাস্তায় তারেক রহমানের পাবলিক বাসে চড়ার ছবিটি প্রশংসিত হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যম বাসস তারেক রহমানের ভাইরাল হওয়া ছবিগুলো নিয়ে শনিবার (২ আগস্ট) একটি সংবাদ প্রকাশ করেছে। 'লন্ডনে আটপৌরে জীবনযাপন করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান' শিরোনামের খবরে বলা হয়, 'তারেক রহমানকে প্রায়ই পাবলিক পরিবহনে চলাফেরা করতে দেখা যায়। পরিবারের জন্য নিজে বাজার করেন। সাক্ষাৎ প্রার্থীদের সঙ্গে দেখা করেন লন্ডন শহরের অদূরে কিংস্টনের সাদামাটা কোন রেস্তোরাঁ বা কফি শপের অলিন্দে। শুক্রবার দেখা গেছে কিংস্টন টাউন সেন্টারে যাওয়ার জন্য তারেক রহমান সাধারণ যাত্রীদের সঙ্গে বাস স্টপে অপেক্ষা করছেন। অতপর সর্বসাধারণের সঙ্গে পাবলিক বাসে উঠে কার্ডের মাধ্যমে ভাড়া মিটিয়ে সিটে গিয়ে বসেন। আপন গন্তব্যে পৌঁছে আবার নেমে যাচ্ছেন।'

বিএনপির মিডিয়া সেল থেকে ছবিগুলো শেয়ার করে লেখা হয়, 'আগামী দিনের রাষ্ট্রনায়ক, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যুক্তরাজ্যে বসবাসকালীন সময়ে কোনো ভিআইপি সুবিধা গ্রহণ না করে সাধারণ মানুষের মতো লোকাল বাসে চলাচল করেন। যা তার বিনয়, সাধারণ জীবনযাপন এবং জনগণের সঙ্গে আত্মিক সংযোগের প্রকৃত প্রতিফলন।'

প্রশ্ন হলো, হঠাৎ করে তারেক রহমানের এই সাধারণ জীবন-যাপনের বিষয়টি সামনে আনতে হলো কেন? সম্প্রতি কয়েকটি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে তারেক রহমানের 'বিলাসী জীবন' এবং তার কাছে দলীয় নেতাকর্মীরা 'চাঁদার টাকা পাঠান'—এরকম অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এই ছবিগুলো দিয়ে তার সাধারণ জীবন-যাপনের বিষয়টি সামনে আনা হলো? যদি তাই হয়, তাহলে বুঝতে হবে এটিও পুরোনো রাজনীতি। বরং একজন খ্যাতিমান বা প্রভাবশালী মানুষ যদি সাধারণ জীবন-যাপন করেন, সেটি মানুষ এমনিতেই জেনে যায়। এটা ঘটা করে বলা বা জানানোর বিষয় নয়।

এটা ঠিক যে, তারেক রহমান যে ব্যক্তির সন্তান, সেই জিয়াউর রহমানের দেশপ্রেম, সততা এবং সাধারণ জীবন-যাপন বাংলাদেশের রাজনীতিতে জনশ্রুতি হয়ে আছে। কৈশোরে বিটিভিকে দেওয়া একটি সাক্ষাৱকারে তারেক রহমানকে বলতে শোনা যায়, তার বাবার প্যান্ট শার্ট কেটে ছোট করে তাদের দুই ভাইকে পরানো হতো। সুতরাং এরকম একজন রাষ্ট্রনায়কের সন্তান লন্ডনের রাস্তায় পাবলিক বাসে চড়বেন এবং সাধারণ জীবন-যাপন করবেন, তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। বরং এটিই স্বাভাবিক। উপরন্তু, তিনি ব্যক্তিজীবনে যত সাদাসিধে কিংবা সরল থাকুন না কেন, ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সরকার প্রধান হলে তিনি যদি দেশকে সামনে এগিয়ে নিতে পারেন; রাজনীতিতে গণতন্ত্র, সহনশীলতা ও মানবিকতার বিকাশ ঘটাতে পারেন—সেটিই হবে সার্থকতা।

কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়ার পরে যদি পুরোনো ধারার প্রতিহিংসা ও বিরোধী নির্মূলের রাজনীতি করেন, মানুষের জীবনমান উন্নয়নের বদলে ব্যক্তিগত এবং দলীয় নেতাকর্মীদের উন্নয়নে মনোযোগী হন, তাহলে সাদামাটা পোশাকে পাবলিক বাসে চড়ার এই সিম্পলিসিটি কোনো গুরুত্ব বহন করবে না। সুতরাং, তারেক রহমানের যে ছবিগুলো ভাইরাল হয়েছে, তার পেছনে কোনো রাজনীতি বা রাজনীতির কোনো কৌশল থাকুক বা না থাকুক, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে তিনি তার বাবার দেশপ্রেম ও সরলতার প্রতিচ্ছবি হবেন—এই প্রত্যাশা।

আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক