
প্রকাশ্য জনসমক্ষে একজন মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করা হলো। এরপর যা ঘটেছে—তাকে 'নৃশংস', 'বর্বর', 'বিভৎস' কিংবা 'অমানবিক'—এই শব্দগুলো দিয়েও ব্যাখ্যা করা যায় না। ঘটনা যেন মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানায়।
স্থান রাজধানীর জনবহুল মিটফোর্ড হাসপাতালের ৩ নম্বর গেট। শত শত মানুষ দাঁড়িয়ে। পাশে হাসপাতালের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার ক্যাম্প। অনুমান করা যায়, আশপাশেই পুলিশের উপস্থিতি ছিল। তবু কেউ এগিয়ে এলো না। ভিডিওতে দেখা গেছে—খুনিরা হামলা চালানোর পাশাপাশি জনতাকেও হুমকি দিচ্ছে, হাত উঁচিয়ে 'আঙুল তুলছে', যেন এই জায়গাটা তাদের নিয়ন্ত্রণেই।
নিহত ব্যক্তি মো. সোহাগ। তিনি ভাঙারি ব্যবসায়ী। আগে বিএনপির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে জানা গেছে। সংসারী মানুষ, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে কঠিন পরিশ্রম করে দাঁড় করিয়েছিলেন ব্যবসা। অভিযোগ উঠেছে, স্থানীয় এক যুবদল নেতা তাঁর কাছে ব্যবসার অর্ধেক শেয়ার দাবি করেন। সোহাগ তাতে রাজি হননি—এটাই তাঁর ‘অপরাধ'।
তাঁকে কেবল মারধর করেই থেমে থাকেনি হামলাকারীরা। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পরও তারা তাঁর শরীরের ওপর উঠে ‘উল্লাস’ করেছে, মাথায় লাথি মেরেছে, ইট-পাথর দিয়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ করেছে। চারপাশের জনতা চুপ। কেউ প্রতিবাদ করেনি। কেউ প্রতিরোধ করেনি।
এটা কেবল একটি হত্যাকাণ্ড নয়। এটি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা কাঠামোর মুখে চপেটাঘাত। প্রশ্ন জাগে—আমরা কি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর রাজত্বে আছি, নাকি সন্ত্রাসের রাজত্বে?
দেশটা এখন যেন সাউথ ইন্ডিয়ান ম্যুভি, আপনি এখানে যা ইচ্ছা তা করতে পারবেন। আপনার শুধু কয়েকজন মানুষ লাগবে, আর লাগবে অস্ত্র। অস্ত্র পাওয়া তো সহজ। ৫ আগস্ট যে হাজার হাজার অস্ত্র গোলাবারুদ লুট হয়েছে, কয়েকশ আন্তর্জাতিক মাপের জঙ্গি যে জেল থেকে পালিয়েছে, এরপর যাদেরকে জামিন দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়েছে; তারা এখন নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেসব অস্ত্র উদ্ধারে সরকারের কোনো তৎপরতাও নাই! ওদিকে মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে অবাধে অস্ত্র ঢুকতেছে।
সব আয়োজন শেষ হলে আপনি যখন কাউকে মারবেন, তখন ওই ম্যুভির মতই, শত শত লোক দাঁড়িয়ে তামাশা দেখবে। মব এই লেভেলে গেছে যে, কারো কিছু বলার সাহস নাই। ও এইটাতো আবার মব না, প্রেশার গ্রুপ ”প্রেশার গ্রুপ” কতটা খুনি হয়ে উঠলে মানুষ অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে ভয় পায়, ভাবতে পারেন?
বিএনপি এখন একটা বিবৃতি দিয়ে এদেরকে দলে থেকে বহিস্কার করবে। ইতোমধ্যে হয়তো দিয়েছেও! এরপর তাদের দায়-দায়িত্ব শেষ। জিজ্ঞেস করলে বলবে, আমরা গত ১১ মাসে এত হাজার নেতা কর্মীকে বহিস্কার করছি! কিন্তু সারা দেশে বিএনপির লোকজন যে নারকীয় বর্বরতা চালাচ্ছে, সেটা কি তাদের হাইকমান্ড জানে? সুন্দর সুন্দর কথা বলতে থাকা জাতীয় নেতাদের কাছে কি সেই খবর পৌঁছায়? ওনারা কি জানেন যে, এইভাবে চলতে থাকলে মসনদে বসার ইচ্ছা কোনোদিন পূরণ হবে না ওনাদের? মানুষ যে ওনাদেরকে ‘ক্ষমতায় গেলে কি করবে’ ভেবে ভয় পাচ্ছে, সেটা ওনারা টের পাচ্ছেন না?
এটা ভেবে অবাক লাগে, যারা ১১ মাসের ব্যবধানে দেশটাকে নরক বানিয়ে ফেলেছে, মানুষের ন্যূনতম নিরাপত্তা দিতে পারে নাই, একটা ঘণ্টার জন্য মানুষ নিরাপদ বোধ করে নাই, দেশটাকে তুলে দিছে জঙ্গি আর সন্ত্রাসীদের হাতে, যারা লুট হওয়া অস্ত্র ফেরত আনতে পারে নাই, জঙ্গিদের জেল থেকে ছেড়ে দিয়ে ওদের দিয়ে সারা দেশে বিরোধী মত দমন করতেছে, মারতেছে মানুষ, তারা আবার লিখতেছে দেশের সংবিধান, তারা নাকি করতেছে দেশের সংস্কার!
রাজু নূরুল: লেখক, অনুবাদক ও বেলজিয়ামে পিএইচডি গবেষক
যোগাযোগ: [email protected]