Image description
 

ভারতের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল মনোজ মুকুন্দ নারাভানে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি দ্য প্রিন্টে একটি নিবন্ধ লিখেছেন। তার লেখার শিরোনাম, ‘বাংলাদেশ ভারতের জন্য নিরাপত্তা হুমকি হয়ে উঠেছে’। ইউনূস সরকার ভারতবিরোধী রাজনীতি উসকে দিচ্ছে। (Bangladesh is becoming a security threat to India. Yunus govt is stoking anti-India politics) ভারতের গণমাধ্যমে বাংলাদেশবিরোধী যে প্রচারণা চলছে, তার প্রতিফলন আমরা সাবেক এই সেনাপ্রধানের লেখায় দেখতে পেয়েছি। তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশে উগ্র ইসলামপন্থির বিস্তার ঘটছে।

জামায়াত, হেফাজত, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন আর ওলামা লীগ মিলে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ডাক দিয়েছে। ওলামা লীগ যে আমলে আওয়ামী লীগের একটি সহযোগী সংগঠন, তা যাচাই করার প্রয়োজন তিনি বোধ করেননি। তিনি আরও দাবি করেছেন, বাংলাদেশের কিছু রাজনীতিবিদ ও সাবেক কর্মকর্তারা ভারতের কিছু অংশ দখলের মতো জিঙ্গোইস্টিক (Jingoistic) বিবৃতি দিয়েছে।

ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে ভারতের গণমাধ্যমে যেসব ভুয়া খবর ও প্রচার চালানো হয়েছে, ভারতের সাবেক ও বর্তমান নীতিনির্ধারকদের বক্তব্য এবং বিশ্লেষণের মধ্যে তারই প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে। জেনারেল নারাভানের এই লেখাটি তার বড় প্রমাণ। তবে জেনারেল নারাভানে হাসিনার পতনের পেছনের কিছু কারণ অন্তত উপলব্ধি করেছেন।

হাসিনার পতন ও পলায়নের পর শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তি ভাঙার দৃশ্য থেকে তিনি বুঝতে পারেন, এগুলো হয়েছে বছরের পর বছর ধরে চলা দমন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে। হাসিনা সরকারকে সমর্থন করার কারণে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাব বেড়েছে বলেও মনে করেন নারাভানে। তিনি আরও বলেছেন, ভারতে হাসিনার উপস্থিতি ভারতবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি উসকে দিচ্ছে।

ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর মানুষ কেন ভারতবিরোধী, তা দিল্লির নীতিনির্ধারকরা বুঝতে পারেন না। বোঝার চেষ্টাও করেন না। আবার যখন বোঝেন, তখন ভারতের আর কিছু করার থাকে না। উল্টো জনবিচ্ছিন্ন পতিত নেতাদের পুনঃপ্রতিষ্ঠার অল্প চেষ্টা করে থাকেন। শুধু বাংলাদেশে নয়, এমন ঘটনা অন্য দেশেও ঘটেছে।সম্প্রতি ওয়াশিংটন পোস্টের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে মালদ্বীপের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুইজ্জুকে উৎখাতে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ভারতপন্থি দলগুলোকে সংগঠিত করতে বড় অঙ্কের টাকা খরচ করেছে। যদিও সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।

জেনারেল নারাভানে স্বীকার করেছেন, হাসিনাকে ভারতে আশ্রয় দেওয়ার কারণে বাংলাদেশের মানুষ ক্ষুব্ধ। কিন্তু এ নিয়ে ভারতের নীতিনির্ধারকদের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি। শেখ হাসিনাকে বিচারের মুখোমুখি করতে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বন্দিবিনিময় চুক্তির আওতায় তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য ভারতকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ভারত এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত নীরবতা পালন করছে। শেখ হাসিনা যে একজন অপরাধী, ভারতের গণমাধ্যম কিংবা বুদ্ধিজীবীরা তা স্বীকার করতে চান না। হাসিনার পতনের শোকে তারা মুহ্যমান।

ক্রীতদাসের মতো বিশ্বস্ত হাসিনাকে বিচারের জন্য দিল্লি যে ফেরত দেবে না, তা সহজেই অনুমান করা যায়। ভারত সব সময় প্রতিবেশী দেশগুলোয় কোনো একটি দল বা গোষ্ঠীর সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক রক্ষা করে চলে। শেখ হাসিনা ছিলেন তেমনই একজন দিল্লির অনুগত রাজনীতিক।

তাকে আশ্রয় না দিয়ে বিচারের জন্য তুলে দেওয়া হলে অন্য দেশের ভারতপন্থিরা দিল্লির প্রতি আস্থা হারাবে। এ কারণে ভূরাজনৈতিক ক্ষতি মেনে নিয়েও ভারত অনুগত ব্যক্তিদের আশ্রয় ও সমর্থন দিয়ে থাকে। আবার প্রতিবেশী এসব দেশে প্রয়োজনে অস্থিরতা সৃষ্টির কাজে তাদের রাজনৈতিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করা হয়।

জেনারেল নারাভানে তার লেখার শিরোনাম করেছেন, ভারতের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। বাস্তবতা হচ্ছে গণহত্যার সঙ্গে অভিযুক্ত শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশের জন্যই বড় নিরাপত্তার হুমকি হয়ে উঠেছে ভারত।

বাংলাদেশের মানুষ উদ্বিগ্ন যে, শেখ হাসিনা ও তার মাফিয়া শাসনকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য ভারত নানাভাবে চেষ্টা করে যাবে। গত বছরের জুলাই-আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতার হত্যার সঙ্গে জড়িত প্রথম সারির সব আওয়ামী লীগ নেতা এখন ভারতে অবস্থান করছেন। সেখান থেকে তারা বাংলাদেশবিরোধী নানা প্রোপাগান্ডা চালিয়ে যাচ্ছেন।

শেখ হাসিনার সঙ্গে দিল্লির শাসকগোষ্ঠীর সম্পর্ক অনেক নিবিড় ও পুরোনো। বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের নীতি বাস্তবায়নের জন্য হাসিনার বিকল্প এখনো দিল্লির হাতে নেই। ব্যক্তিপর্যায়ে তার পেছনে বিনিয়োগও কম নয়। ১৯৭৫ সালে ইন্দিরা গান্ধীর রাজনৈতিক আশ্রয়ের প্রস্তাব গ্রহণ করে শেখ হাসিনা জার্মানি থেকে দিল্লিতে বসবাস শুরু করেন। দিল্লিতে থাকা অবস্থায় ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামী লীগ সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন।

অর্থাৎ সে সময় থেকে তিনি ভারতের সমর্থন নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। শেখ হাসিনার ছেলে লেখাপড়া করেছেন ভারতে। তার মেয়ে এখনও ভারতে অবস্থান করছেন। ভারতের জোরালো লবিংয়ের কারণে যোগ্যতার ঘাটতি এবং জালিয়াতির পরও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালকের পদ বাগিয়ে নিয়েছিলেন। অনেকে মনে করেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দিল্লির অফিসে তার কাজের সূত্রে সেখান থেকে হাসিনা-পরবর্তী উত্তরাধিকার হিসেবে তাকে প্রস্তুত করা হচ্ছিল। এর মধ্যে হাসিনার পতন হলে বাংলাদেশ ঘিরে ভারতের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ভণ্ডুল হয়ে যায়।

৭৫-এর পর শেখ হাসিনা যখন দিল্লিতে ছিলেন, তখন ভারতের পরামর্শে তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। সে সময় আওয়ামী লীগ নানা ভাগে বিভক্ত ছিল। ভারতের পৃষ্ঠপোষকতায় সে সময় বাংলাদেশবিরোধী সশস্ত্র তৎপরতা শুরু হয়। সে সময়ও অনেক আওয়ামী লীগ নেতা দিল্লিতে আশ্রয় নিয়েছিলেন।

শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার পর শেখ হাসিনা যখন জার্মানি থেকে দিল্লিতে আসেন, তখন কাদের সিদ্দিকী বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে গিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। সীমান্ত এলাকায় শুরু করেন যুদ্ধ। জিয়াউর রহমানের সরকারকে সেই বিদ্রোহ দমনে অনেক কঠোর পদক্ষেপ নিতে হয়েছে। কাদের সিদ্দিকীর রাষ্ট্রবিরোধী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পেছনে ছিল ভারত ও শেখ হাসিনার সমর্থন। কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের নাসিম ওসমান ও চট্টগ্রামের মহিউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন।

চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশে অস্থিরতা সৃষ্টিতে আমরা ভারতের একই ধরনের ভূমিকা দেখছি। প্রকাশ্য বাংলাদেশবিরোধী বক্তব্য রাখছেন ভারতের রাজনীতিকরা। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচারের নানা কল্পকাহিনি প্রচার করে বিশ্বজুড়ে চলছে বাংলাদেশবিরোধী নানা প্রচারণা। এমনকি ভারতের উগ্রপন্থিরা বাংলাদেশ দূতাবাসে হামলা পর্যন্ত করেছে। দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে সরকারবিরোধী ভূমিকা নিতে নানাভাবে উসকানি দেওয়া হচ্ছে।

গণহত্যায় অভিযুক্ত আওয়ামী লীগ নেতাদের এখন নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে ভারত। আওয়ামী লীগ নেতারা জানেন, তারা গণহত্যার দায় নিয়ে এ দেশের রাজনীতিতে আর ফিরতে পারবেন না। এ কারণে তারা কৌশল হিসেবে দেশকে অস্থিতিশীল রাখার পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন।

শেখ হাসিনা তার দেড় দশকের স্বৈরশাসনে ভারতের প্রত্যক্ষ সমর্থন নিয়ে দেশের নির্বাচনব্যবস্থা ধ্বংস করেছেন। ২০১৪ সালে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিং বাংলাদেশে এসে নির্বাচনব্যবস্থার ওপর সরাসরি হস্তক্ষেপ করেন।

হাসিনা এরপর থেকে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে কখনও রাতের ভোট, কখনও ডামি ভোট করে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার চেষ্টা করেছেন। তিনি এ জন্য পুরোপুরি ছিলেন ভারতের ওপর নির্ভরশীল। শেখ হাসিনা কখনো জনগণের ম্যান্ডেটের প্রয়োজন বোধ করেননি। তাদের মুখোমুখি হননি। শেখ হাসিনা আর কখনোই বাংলাদেশের জনগণের মুখোমুখি হতে পারবেন না।

শেখ হাসিনা জানেন দেশের মানুষ কৃতকর্মের জন্য তাকে কতটা ঘৃণা করেন। তিনিও বিক্ষুব্ধ মানুষকে শত্রু বিবেচনা করেছেন। পালিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত দমন-পীড়ন ও হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে বিক্ষোভ দমনের চেষ্টা করেছেন। তার নির্দেশে অন্তত দুই হাজার মানুষকে হত্যা, বিশ হাজারের বেশি মানুষকে আহত ও চার শ মানুষকে অন্ধ করে ফেলা হয়েছে। এমনকি পুলিশ নিহত মানুষের লাশ পুড়িয়ে ফেলার মতো নৃশংসতা দেখিয়েছে।

দেশের মানুষ তো বটে, তার দলের নেতাকর্মীদের মুখোমুখি হওয়ার মতো সাহস আর শেখ হাসিনার নেই। তিনি দলের নেতাকর্মীদের জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিলেন। তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে চেষ্টা করেছেন গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টির। তিনি শুধু নৃশংস শাসক ছিলেন না, একই সঙ্গে ছিলেন ভীরু, পলায়নপর ও লোভী রাজনীতিক। প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা ছিল তার রাজনীতির লক্ষ্য।

শেখ হাসিনার ডিএনএতে রয়েছে ষড়যন্ত্র ও প্রতিশোধপরায়ণতা। তিনি হয়তো আর কখনো দেশে ফিরবেন না। কারণ তিনি জানেন, আজ হোক কাল হোক, গণহত্যার জন্য তাকে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। একই সঙ্গে দেশে থাকা তার দলের নেতাকর্মীদের কাছে বহু প্রশ্নের জবাব দিতে হবে।

এ কারণে বিদেশে বসে তিনি ষড়যন্ত্রের রাজনীতির জাল বুনবেন। বাংলাদেশের ওপর প্রভাব বিস্তারের জন্য ভারত শেখ হাসিনা ও তার অনুসারীদের দাবার গুটির মতো ব্যবহার করার চেষ্টা করে যাবে। শেখ হাসিনার দিল্লিতে থাকার অর্থ হচ্ছে বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে অস্থিরতা সৃষ্টির পথ খোলা রাখা। বাংলাদেশের জন্য নিরাপত্তার প্রধান হুমকি এখন শেখ হাসিনা।

 

আলফাজ আনাম