দিলশানা পারুল
জুলাইয়ে আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকে ৩৬ জুলাই (৫ আগস্ট) পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ২১ দিনে বাংলাদেশে দুই হাজারেরও বেশি ছাত্র-জনতা নিহত হয়েছে, ৩৩ হাজারেরও বেশি আহত হয়েছে এবং এ হামলাগুলোর বেশির ভাগই বুকে, মাথায় এবং চোখ বরাবর গুলি করা হয়েছে।
জুলাইয়ে আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকে ৩৬ জুলাই (৫ আগস্ট) পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ২১ দিনে বাংলাদেশে দুই হাজারেরও বেশি ছাত্র-জনতা নিহত হয়েছে, ৩৩ হাজারেরও বেশি আহত হয়েছে এবং এ হামলাগুলোর বেশির ভাগই বুকে, মাথায় এবং চোখ বরাবর গুলি করা হয়েছে। এটি প্রমাণ করে যে যখন গুলি করা হয়েছে, তখন লক্ষ্য করে হত্যা নিশ্চিত করার জন্য গুলি করা হয়েছে। অনলাইনে ভেসে বেড়ানো ভিডিও ডকুমেন্ট থেকেও আমরা দেখেছি যে পুলিশ লক্ষ্য করে গুলি করেছে। পুরো জুলাই মাসে অসংখ্য ভিডিও ডকুমেন্ট, হাসপাতালে ভর্তি আহত ছাত্র-জনতা এবং শহীদদের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট থেকে পরিষ্কার যে জুলাই মাসে যে গণহত্যা হয়েছে, তা টার্গেট শুটিং এবং হত্যার উদ্দেশ্যেই করা হয়েছে। এমন নয় যে তারা ফাঁকা গুলি করেছে বা র্যান্ডম মানুষ মারা গেছে।
শত শত মানুষের মিছিলে একটি দেশের নিরাপত্তা বাহিনী অস্ত্র নিয়ে হাজার রাউন্ড গুলি চালিয়েছে। সেই নিরাপত্তা বাহিনী, যারা জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দেয়ার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল। এসব ঘটনা আসলে আমাদের চোখের সামনেই ঘটেছে। প্রতিটি মৃত্যুর আমরা সাক্ষী। এ ধরনের একটি সময়ের সাক্ষী হওয়ার পর, ৩৬ জুলাইয়ের পর পরবর্তী রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটে। জুলাইয়ে যে হত্যাকাণ্ড আমরা দেখেছি, স্বাভাবিকভাবেই ৩৬ জুলাইয়ের প্রধান রাজনৈতিক আলোচনা হওয়ার কথা ছিল এ হত্যাকাণ্ডের বিচার।
অনেক কারণে এ হত্যাকাণ্ডের বিচার করা জরুরি ছিল। প্রথমত, এ হত্যাকাণ্ডের বিচার শহীদদের প্রাপ্য। জাতি হিসেবে আমরা যদি এ বিচার না করতে পারি, তবে যে যৌথ ট্রমা তৈরি হয়েছে, তা কাটিয়ে ওঠার জন্য কোনো সমাধান হবে না। এ বিচার আরো প্রয়োজন, কারণ ভবিষ্যতে কোনো রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তি যেন এ ধরনের দুঃসাহস আর না করে। বিষয়টি তো এমন নয় যে ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে বেশির ভাগ গরিব বলে তাদের রাজনৈতিক প্রয়োজনে বা ক্ষমতায় থাকার লোভে চাইলেই মেরে ফেলা যায়।
এ হত্যাকাণ্ডের বিচারের প্রসঙ্গটি যতখানি আইনগত এবং নৈতিক, তার চেয়েও অনেক বেশি রাজনৈতিক। যেহেতু দল হিসেবে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে এবং আওয়ামী লীগ নিজেকে একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে দাবি করে, আর যেহেতু রাষ্ট্র একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং রাষ্ট্রের পুলিশ বাহিনীর মাধ্যমে এ হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছে, কাজেই এ হত্যার বিচারের প্রসঙ্গটি সবার আগে রাজনৈতিক।
বিষয়টি এমন নয় যে হঠাৎ একটি সন্ত্রাসী দল বা মানসিক বিকৃত ব্যক্তি গুলি করে হাজার হাজার মানুষ মেরে ফেলেছে, যার ফলে এ খুনিদের আইনগত কাঠগড়ায় এনে আদালতের সহায়তায় বিচার সম্ভব। এটি একটি রাজনৈতিক দল, যারা রাজনীতির নামে এ বিপুল হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। এমনকি এ হত্যাযজ্ঞ ঘটানোর পর তারা পাঁচ মাস ধরে জুলাইয়ের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানকে জামায়াত-জঙ্গি হামলা এবং শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনার মতো একটি রাজনৈতিক চক্রান্ততত্ত্ব দাঁড় করিয়ে চলেছে।
এ হত্যাকাণ্ডকে যুক্তিসংগত করার চেষ্টা চালাচ্ছে তারা এবং এ দায়িত্ব নিচ্ছে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যারা বিশ্বাসী তারা। এমনকি এ হত্যাযজ্ঞ পরিচালনার জন্য শেখ হাসিনা তার সহযোগী রাজনৈতিক দলগুলোর ম্যান্ডেট নিয়ে মিটিং করেছেন। এখনো এ হত্যাযজ্ঞের যারা সাফাই গাইছে, তারা রাজনীতির নামেই সাফাই গাইছে। যারা জুলাই হত্যাকাণ্ডের নেতৃত্ব দিয়েছে, তাদের প্রত্যেকেই আওয়ামী লীগ নামে রাজনৈতিক দলের পদধারী। রাজনৈতিক পদধারী হিসেবেই তারা মনে করেছিল যে তারা তাদের বিরোধী মতকে নিধন করছে এবং রাজনৈতিক দোহাই দিয়ে এটা করাই যায়।
সুতরাং আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক দল হিসেবেই এ হত্যাকাণ্ডের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। সেই কারণেই জুলাই হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গটি সবার আগে একটি রাজনৈতিক প্রশ্ন, তারপর এটি আইন ও নৈতিকতার প্রশ্ন।"
এখানে এসে আমি বর্তমানে পাঁচ মাস পর কোন রাজনৈতিক দল বা প্লাটফর্ম জুলাই হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গটি কীভাবে মোকাবেলা করছে সেটি বিস্তারিত দেখতে চাই।
খুব দুঃখজনকভাবে দেখতে পেলাম এবং দেখছি যে বড়-ছোট সব দল, যে ভাষায় ও দৃঢ়তায় তাদের এ বিচারের জন্য মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানোর কথা ছিল, সেখানে তারা নেই। জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার এবং আওয়ামী লীগের বিচার, বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনেকটা হয়ে গেছে বড় ডিনারের পাশে ডিজার্টের মতো। যেন এ বিচার এ মুহূর্তে তাদের রাজনীতির জন্য মুখ্য নয়, জরুরি নয়। এটি একটি সাইড ডিশ, মেইন কোর্স হচ্ছে অন্য কিছু—কারো জন্য সংস্কার, কারো জন্য নির্বাচন, কারো জন্য রাজনৈতিক অন্য দলের সঙ্গে প্রতিযোগিতা।
সব কিছু চাপা পড়ে গেছে বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠে ক্ষমতা দখলের জন্য কে কার প্রতিযোগী হয়ে উঠতে চাইছে, সেই চেষ্টার মধ্যে। রাজনৈতিক মেরুকরণে, প্রতিযোগিতায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে এ হত্যাকাণ্ডের বিচার, শহীদদের ইনসাফ। রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, এ দায়িত্ব সরকারের, কাজেই এ বিচার সরকার করবে বা সরকারকে করতে হবে। যেন বিএনপি, জামায়াত বা অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো দায় নেই।
বড়-ছোট রাজনৈতিক দলগুলোর কথা শুনে মনে হচ্ছে যেন দায় এড়ানোর পালা চলছে।
বাংলাদেশের বামপন্থী নামে ঘোষিত ১৪ দল মিটিং করে শেখ হাসিনাকে এ হত্যাযজ্ঞের ম্যান্ডেট দিয়ে এসেছে, কাজেই তারা এ হত্যাযজ্ঞের বিচারের ব্যাপারে কোনো নৈতিক অধিকার রাখে না। অন্যপক্ষে বাম দলের যারা আছেন, তাদের একটি বিশাল অংশ মনে করেন যে জুলাই অভ্যুত্থান হয়েছে আমেরিকার সিআইএর ডিজাইনে। তাদের আরেকটি অংশ শক্তভাবে বিশ্বাস করেন যে জুলাইয়ে যারা অংশ নিয়েছিল, তারা জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী জঙ্গি; কাজেই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে এ হত্যাযজ্ঞের জন্য আওয়ামী লীগের বিচার হওয়ার মতো কিছু নেই।
এবার আসি জামায়াতে ইসলামী প্রসঙ্গে। জামায়াতে ইসলামীর নিজস্ব যেহেতু ১৯৭১ সালের বিতর্কিত অবস্থান আছে, কাজেই তারাও শক্তিশালীভাবে আওয়ামী লীগের বিচারের কথা বলতে পারছে না বা চাইতেও পারছে না। এখানে এটি তাদের জন্য একটি নৈতিক এবং রাজনৈতিক প্রশ্ন। কারণ যতবার তারা বিচারের দাবি করবে, ততবার তাদের নিজেদের বিচারের প্রসঙ্গটি সামনে আসবে।
রাজনীতির প্রতিযোগিতার মাঠে জামায়াতে ইসলামীর জন্য আওয়ামী লীগ আর শত্রু হিসেবেই মাঠে নেই, বরং প্রতিযোগিতার মাঠে বিএনপি তাদের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী। কাজেই বিএনপিকে লক্ষ্য করে রাজনীতি সাজানোই এখন তাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য।
একইভাবে বিএনপির জন্য এখন জামায়াতে ইসলামী সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক ক্ষেত্রে। কাজেই বিএনপি যতটা রাজনৈতিকভাবে জামায়াতে ইসলামীকে কাউন্টার দেয়ার চেষ্টা করছে, আওয়ামী লীগকে কাউন্টার দেয়ার চেষ্টা তাদের জন্য ততটা জরুরি নয়। কারণ ভোটের মাঠে আওয়ামী লীগ এখন শক্তি হিসেবে দুর্বল। বরং আওয়ামী লীগের যে ২৫ শতাংশ ভোট ব্যাংক আছে, বিএনপির কাছে অনেক বেশি মনোযোগ দেখা যাচ্ছে সেই দিকে। আওয়ামী লীগের বিচার চাওয়া দেখে মনে হচ্ছে যে এ ২৫ শতাংশ ভোট ব্যাংক নিরাপদ করা বিএনপির জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে।
জুলাই হত্যাকাণ্ডের পর বিএনপি ও বামপন্থী দলগুলো নতুন করে জামায়াত-শিবিরের ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধ এবং তার বিচার নিয়ে বিষয়টি সামনে নিয়ে এসেছে। এই যে জুলাই হত্যাকাণ্ডের মাত্র পাঁচ মাসের মধ্যে ৫৪ বছরের পুরনো যুদ্ধাপরাধকে সামনে আনার যে রাজনীতি, তা আমার কাছে সমস্যাজনক এবং অসততার রাজনীতি মনে হয়। আজ যুদ্ধাপরাধের জন্য বিচার চাওয়াও একটি রাজনীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ধরুন জামায়াতের যুদ্ধাপরাধ যদি বিএনপির জন্য সমস্যা হতো, তবে বিএনপি আওয়ামী লীগের গত ১৬ বছরেও জামায়াতের বিচার চাইত, তারা জামায়াতের সঙ্গে যে রাজনৈতিক ঐক্য গড়েছিল, সেটাও করত না, যা আওয়ামী লীগের জন্যও সমানভাবে সত্যি। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের বিচার হোক—এ প্রত্যাশায় যতটা না জামায়াতে ইসলামীর বিচার চেয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতায় থাকার ট্রাম্প কার্ড হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকে ব্যবহার করেছে।
জামায়াতে ইসলামীকে রাজনৈতিক-নৈতিকভাবে আটকে রাখার জন্য তারা মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করেছে। একইভাবে বিএনপিকেও নৈতিকভাবে আটকে রাখার জন্য তারা ২১ আগস্টের বোমা হামলা এবং ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলাকে ব্যবহার করেছে। একইভাবে বিএনপিও ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধকে সামনে আনার চেষ্টা করেছে, যতটা না বেশি তারা যুদ্ধাপরাধের বিচার চায়, তার চেয়ে অনেক বেশি জামায়াতকে ভোটের রাজনীতির মঞ্চে ঘায়েল করতে চায়।
জামায়াতে ইসলামী আওয়ামী লীগের মতো যেমন নৈতিক ট্রাম্প কার্ড হিসেবে ব্যবহার হয়েছে, এখনো তাদেরকে নৈতিক ট্রাম্প কার্ড হিসেবেই ব্যবহার করা হচ্ছে। জামায়াতে ইসলামীর যুদ্ধাপরাধের ইস্যু তখন যেমন ব্যবহার করা হয়েছিল আওয়ামী লীগের ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য, এখনো তেমনি তাদেরকে ব্যবহার করা হচ্ছে আওয়ামী লীগের জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি ঢাকা দিতে, ধামাচাপা দিতে।
জামায়াতে ইসলামী অবশ্যই যুদ্ধাপরাধী এবং সেই অপরাধে গত ৫৪ বছর তারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাজে একঘরে হয়ে ছিল। যতই তারা নির্বাচিত হোক না কেন গত ৫৪ বছর রাজনৈতিকভাবে একঘরে হয়ে ছিল। এখন যখন আবার জামায়াতে ইসলামীর ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধের প্রসঙ্গ সামনে আসে, তখন প্রশ্ন জাগে, তাহলে ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চ করে আমরা কী করেছিলাম? বিচার করে ফাঁসি তাহলে কাদের দেয়া হয়েছিল? তাহলে সেই বিচার এবং ফাঁসি কী ছিল? যুদ্ধাপরাধের প্রশ্নে যদি ২০১৩ সালে আমরা বিচার করে থাকি, তাহলে একই অপরাধের জন্য আমরা কয়বার বিচার করতে বলব? নৈতিকভাবে ও আইনগতভাবে সেটা আমরা পারি কিনা।
এ প্রশ্নগুলো তোলা জরুরি, কারণ যখনই জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচারের প্রশ্নটি আমরা সামনে আনার চেষ্টা করছি, তখনই এক দল এসে বলছেন সব হত্যাকাণ্ডের বিচার হতে হবে। এই যে সব বলে জেনারেলাইজ করা—এটা আমার কাছে খুবই সমস্যাজনক রাজনীতি মনে হয়। এ সাধারণীকরণের ফাঁক গলে জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচারের সম্ভাবনা আড়াল হয়ে যাবে। আমার প্রধান সংকট ভোটের মাঠের প্রতিযোগিতার ফাঁকগুলো, ভোটের মাঠের রাজনীতির ফাঁক গলে অথবা সংস্কার প্রশ্নের চাপে জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার একটি মামুলি ঘটনা, সাধারণ প্রশ্নে পরিণত হচ্ছে। যেনবা বেশির ভাগ গরিব, দুর্দশাগ্রস্ত এই দুই হাজার মানুষ ও তাদের সন্তানদের হত্যার বিচার না পেলেও খুব একটা সমস্যা নেই। যেনবা বাংলাদেশের জনতা রাজনৈতিকভাবে এক্সপেন্ডেবল!
দিলশানা পারুল: পলিটিক্যাল অ্যাক্টিভিস্ট, পাবলিক পলিসি প্রফেশনাল, অস্ট্রেলিয়া