Image description


নারীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহন এবং জাতীয় সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্ব বাড়াতে সংরক্ষিত নারী আসনের আলাপের পাশাপাশি জেনারেল ৩০০ আসনে প্রার্থী দেয়ার ক্ষেত্রে দলগুলোকে একটা নির্দিষ্ট শতাংশ নারী প্রার্থী দেয়ার শর্তের প্রস্তাব করেছেন অনেকেই। কিছু কিছু উন্নয়নশীল দেশে এ পদ্ধতি অবলম্বন করেছে। 
আমার পোস্টডক্টোরাল গবেষণার এরিয়া হচ্ছে ভারতের স্থানীয় সরকারে নারী কোটার মাধ্যমে নির্বাচিত/মনোনীত নারীদের রাজনৈতিক অংশগ্রহন, পলিসি মেকিং-এ তাদের ভূমিকা, ইত্যাদি ইত্যাদি। গবেষণার অংশ হিসেবে এ বিষয়ে আমার মোটামুটি পড়াশোনা করার সুযোগ হয়েছে। 


জেনারেল আসনগুলোতে নির্দিষ্ট শতাংশ নারী প্রার্থী দেয়ার প্রস্তাব একটা মারাত্মক সমস্যাজনক প্রস্তাব, সংরক্ষিত নারী আসনের চেয়েও ক্ষতিকর প্রস্তাব নারী রাজনীতিবিদদের জন্য। ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশে এ পদ্ধতি নিয়ে অনেক সমালোচনা তৈরি হয়েছে। এর ইফেক্টিভনেস নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে অনেক গবেষণা হয়েছে। এ পদ্ধতি নারীর মুলধারার রাজনীতিতে অংশগ্রহনের অর্গানিক বা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া নয়, বরং চাপিয়ে দেয়া পদ্ধতি।


এ প্রস্তাবের প্রপোজিশন হচ্ছে সংরক্ষিত আসনের নারীরা যেহেতু জনগণের মাধ্যমে নির্বাচিত না এবং তারা নির্দিষ্ট কোন এলাকাকে রিপ্রেজেন্ট করে না, তাই তারা সংসদে পলিসি লেভেলে ভালো ভূমিকা রাখতে পারছে না। সরাসরি নির্বাচিত হয়ে আসলে তাদের স্টেক বেশি থাকবে।


গত পঞ্চাশ বছরে সংসদে সংরক্ষিত আসনের নারী এমপিরা কেন যথাযথ ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে? সংরক্ষিত আসন ইন্ট্রুডিউস করার পিছনে যে প্রত্যাশা ছিলো (অর্গানিক প্রসেসে নারীর রাজনীতিতে ও পলিসি মেকিং-এ অংশগ্রহন বাড়া) , সে প্রত্যাশা কেন যথাযথ পূরণ হলো না? কেন সংরক্ষিত আসনগুলো আলংকারিক থেকে গেলো? এ ফেইলিওরগুলো সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে না পারার কারণেই নতুন নতুন কোটা বা শর্ত আরোপের প্রস্তাবনা আসছে।
ধরে নিই, দলগুলোর উপর কোটা চাপিয়ে দেয়া হলো যে ১০ শতাংশ নারী প্রার্থী দিতে হবে। অর্থ্যাৎ ৩০০ আসনের অন্তত ৩০ টি আসনে নারী প্রার্থী দিতে হবে। কী সমস্যা হবে তাতে? সংসদে নারীর অর্থবহ প্রতিনিধিত্ব বাড়বে? নারীর সংসদে অংশগ্রহন বাড়বে?


১) নারী প্রার্থী দেয়ার বাধ্যবাধকতা 'সিম্বলিক ইনক্লুশান' বা প্রতিকী নারী প্রার্থী বাড়াবে। আপনি দেখবেন নারী প্রার্থী, কিন্তু আসলে প্রতিনিধি একজন পুরুষ-ই। আব্দুর রহমান বদি ওরফে ইয়াবা বদি'র পরিবর্তে সে আসনে প্রার্থী দেয়া হবে বদির বউ শাহীন আক্তারকে, মেয়র জাহাংগীরের পরিবর্তে প্রার্থী দেয়া হবে তার মা জায়েদা খাতুনকে। কারণ ক্যান্ডিডেটের ইমেজ একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নির্বাচনে। কোটা পূরণ হবে নারীর নাম দিয়ে, কিন্তু আন-অফিসিয়ালি প্রতিনিধিত্ব করবে পুরুষ-ই। যে লাউ, সে কদু।


২) দলগুলো যদি বাধ্য হয়েই নারী প্রার্থী দিতে হয়, এমন সব আসনে প্রার্থী দিবে যেখান থেকে পাশ করে আসার সম্ভাবনা অনেক কম (নন-উইনিং সিট)। ব্যালটে নারী ক্যান্ডিডেটের নাম বা প্রতিক দেখবেন, কিন্তু সংসদে প্রতিনিধিত্ব নাও থাকতে পারে। বিশেষ করে কনজারভেটিভ পার্টিগুলোর ক্ষেত্রে তাই হবে।


৩) যোগ্যতার মধ্য দিয়ে এমপি হয়ে আসার পরও নারী এমপিদের ট্রিট করা হবে কমযোগ্য কোটার এমপি হিসেবে। তোমরা তো নিজের যোগ্যতায় এমপি হতে পারতা না, কোটার কারণে হয়েছো। অযোগ্য বা নোমিনাল এমপিদের ক্ষেত্রে এটা ইস্যু না হলেও প্রকৃত রাজনীতিবিদ নারীদের জন্য এটা অসম্মানজনক। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের সন্তানদের জন্য পোষ্য কোটা থাকায় অনেক ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট নিজের যোগ্যতায় বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার পরেও শিক্ষকের সন্তান হওয়ায় সহপাঠীরা আড়চোখে তাকায়- "কোটায় চান্স পাওয়া"! এজন্য অনেক শিক্ষকেরা  সাম্প্রতিক সময়ে এ কোটা বাতিলের দাবীতে লেখালেখি করেছেন।


৪) দলগুলো বাধ্য হয়ে নারী প্রার্থী দিতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট আসনে হয়তো আরো বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন পুরুষ প্রার্থীকে ডিসক্রিনেইট করতে হবে। সংসদে যোগ্য লোকটা আসার ক্ষেত্রে একটা ব্যারিয়ার তৈরি হলো, এটা দেশের জন্য ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য নেতিবাচক। এটা মেরিটোক্রেসির প্রিন্সিপলকে ভায়োলেট করে, একটা অসমতাকে অ্যাড্রেস করতে গিয়ে আরেকটা বৈষম্য হাজির করছে।


৫) এই নারী সিট বন্টনের সাথে নারী ভোটারদের ভোট বা সমর্থন দেয়া না দেয়ার কোন কোন সম্পর্ক নেই। ফলে নারীবান্ধব পলিসি নেয়া বা নারীদের পলিসি কনসার্নগুলোকে প্রায়োরিটির দেয়ার জন্য পার্টিগুলো কোন চাপ অনুভব করবে না। 


তাহলে সমাধান কি?
নারীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহনের অর্গানিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করা। বিদ্যমান যে ৫০ টি সংরক্ষিত আসন আছে সেখানকার সমস্যাগুলোকে সঠিকভাবে অ্যাড্রেস করা যাতে দলগুলো নারীবান্ধব পলিসি নিতে আগ্রহী হয় নারী ভোটারদের আকৃষ্ট করার জন্য, যোগ্য নারীদের এমপি হিসেবে মনোনীত করতে বাধ্য হয়, এবং এর মধ্য দিয়ে নারীদের মেইনস্ট্রিম রাজনীতিতে অংশগ্রহণের পথে যে সব প্রতিবন্ধকতা আসে সেগুলো ধীরে ধীরে দূর হয়। 


স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় নারী তার রাজনৈতিক দলে কন্ট্রিবিউশনের মাধ্যমে নেতৃত্বে আসবে, এমপি হবে; কারো কোটার দয়ায় নয়। তখনি আমরা সত্যিকার অর্থে আত্মমর্যাদার সাথে নারী অংশগ্রহন ও প্রতিনিধিত্ব দেখতে পাবো। দল-ই তখন নিজের প্রয়োজনেই সেই নারীকে নোমিনেশন দিবে। উদাহরণস্বরূপ- খালেদা জিয়া যে আসনের প্রার্থী হবে, সেখানে তার দল অন্য কোন পুরুষ মানুষকে নোমিনেশন দিবে না। দলের স্বার্থেই খালেদা জিয়াকে প্রার্থী দিতে হবে, তার জেন্ডার সেখানে ম্যাটার করছে না, রাজনৈতিক যোগ্যতা ম্যাটার করছে। 


বিদ্যমান সংরক্ষিত নারী আসনের সমস্যা সমাধানে আমি দুইটি প্রস্তাব করেছি: যে দল নারী ভোটারদের যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে সংসদে তত শতাংশ নারী সংরক্ষিত আসন পাবে; এবং প্রত্যেক দল নির্বাচনের আগেই তাদের নারী সাংসদদের প্যানেল ঘোষনা করতে হবে যাতে জনগণ জানতে পারে কিরকম যোগ্য নারীদের তারা নোমিনেইট করছে (নাকি পারিবারিক কোটায় অযোগ্য অদক্ষ রিডিং পড়তে না পারা নারী বা গান গাওয়ার জন্য সং দের সংসদে নিয়ে আসবে)। আমার বিস্তারিত প্রস্তাবের লিংক কমেন্টে দিচ্ছি যেখানে আমি আলোচনা করেছি কিভাবে এদুটো সংস্কারের মাধ্যমে বিগত পঞ্চাশ বছরের সংরক্ষিত আসন থেকে আকাঙ্ক্ষিত সফলতা না আসার কারণগুলোকে সঠিকভাবে অ্যাড্রেস করা যাবে।


কেন নারী আসন ৫০ থেকে ১০০ করাটা যৌক্তিক না সেটা নিয়ে আলাপ করেছি আরেকটা পোস্টে, সেটার লিংকও থাকছে কমেন্টে। আলাপ-আলোচনা চলুক।

 

ডঃ শিব্বির আহমেদ