
আবদুল লতিফ মাসুম
আওয়ামী স্বেচ্ছাচার বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড ওবায়দুল কাদের, যিনি কাউয়া কাদের নামে সমধিক খ্যাতি অর্জন করেছেন। তিনি অতি সম্প্রতি মুখ খুলেছেন। তার বেশি কথা বলার বদনাম ছিল। সারাক্ষণ বক বক করতেন। ৫ আগস্ট তার মুখে কুলুপ এঁটে দিয়েছে। এতদিন তিনি বাকরুদ্ধ ছিলেন। নিশ্চয়ই তার দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। মোদিজীর কল্যাণে তারা আছেন বেশ। তার প্রভু শেখ হাসিনারও কথা বলার বাতিক ছিল। বাতিকগ্রস্ত এই মহিলা বেমালুম ভুলে গেছেন যে, তিনি আর বাংলাদেশের সিংহাসনে সমাসীন নন। তাই তিনি পলায়নের লজ্জা-শরমের তোয়াক্কা না করে দাদাদের কৃপায় কথা বলেই যাচ্ছেন। এই কথাগুলোর কী ক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়া এখানে-ওখানে এবং সেখানে হতে পারে সে কাণ্ডজ্ঞান হারিয়েছেন তিনি। মনস্তত্ত্ববিদরা নিশ্চয়ই বলবেন যে, তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছেন। এখানে অনেক আগে হাইকোর্ট বলেছিল তিনি রং হেডেড । রাষ্ট্রবিজ্ঞান এ ধরনের নেতৃত্বকে ‘বিকারগ্রস্ত ব্যক্তিতন্ত্র’ (Perverted Personal Leadership) বলে চিহ্নিত করে থাকে। গ্রাম দেশে বলেÑরতনে রতন চেনে। যেমনটার সঙ্গে মিলে তেমনটা। তাই আওয়ামী লীগের বাঘা বাঘা নেতাদের গাধা গাধা বানিয়ে ওবায়দুল কাদেরের মতো একান্ত অনুগত ভৃত্য পছন্দ করেছেন। এই কথিত কাউয়া কাদের যদি আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে উন্মুক্ত ভোটে প্রতিযোগিতা করতেন, হয়তো তিনি ১৯টি ভোট পেতেন। এখন ব্যক্তিতন্ত্রের আশীর্বাদে তিনি একলাই এক শ। কাদেরের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের আদি নেতা, পাতি নেতা এবং পরিত্যক্ত নেতা সবার অভিযোগ ছিল তিনি সঠিক সময়ে দলকে সঠিক সিদ্ধান্ত দিতে পারেননি। আরো অভিযোগ তৃণমূলের নেতাকর্মীদের পাত্তা দেননি। সংগঠনকে অকার্যকর করেছেন। অবশ্য যে দল বা সংগঠনে নেতানেত্রীর আশীর্বাদ অথবা অভিশাপে চলে সবকিছু, সেখানে নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন না হওয়ারই কথা। প্রতিটি পর্যায়ে ব্যক্তির প্রাধান্য, ব্যক্তিতন্ত্র ডেকে আনে। আওয়ামী ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনের পরে দেখা যায় যে, চেয়ারম্যানের ছেলে চেয়ারম্যান, মেম্বারের ছেলে মেম্বার হয়েছেন। এটি শীর্ষপর্যায় থেকে উৎসারিত এবং তৃণমূলপর্যায় পর্যন্ত প্রসারিত।
বিগত ২৩ মে ভারতীয় গণমাধ্যম ‘দ্য ওয়াল’-এর এক্সিকিউটিভ এডিটর অমল সরকারকে ওবায়দুল কাদের এক সাক্ষাৎকার দেন। এই সাক্ষাৎকারে ক্ষমতায় ফিরে আসার খায়েশ আছে। আস্ফালন আছে। মিথ্যাচার আছে। আজগুবি কথাবার্তা আছে। কিন্তু নেই বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের প্রতি মমত্ব। ২৪-এর বিপ্লবের আগে বাংলাদেশে যে অভূতপূর্ব রক্তক্ষরণ তারা করেছেন, তার জন্য কোনো অনুশোচনা নেই। বরং ভিন্ন ভিন্ন বয়ানে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে অস্বীকার করার দৃষ্টতা রয়েছে। ষড়যন্ত্র তত্ত্ব দ্বারা নিজেদের ষড়যন্ত্রের ইতিহাসকে অস্বীকার করার প্রবণতা রয়েছে। আরো মজার বিষয়, পুরো পাশ্চাত্যকে ব্ল্যাকমেইল করার জন্য মৌলবাদের লেবাস দিয়ে সবকিছুর জন্য জামায়াত এবং জাতীয়তাবাদী শক্তিকে দায়ী করার দুষ্টু বুদ্ধি রয়েছে। স্মরণ করা যেতে পারে, ২৪-এর গণবিপ্লবের প্রাক্কালে সমগ্র আন্দোলনকে মৌলবাদী শক্তির উত্থান বলে বিভ্রান্ত করার প্রমাণ রয়েছে। তখন জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করা হয়। অথচ গণঅভ্যুত্থানে ছিল গণঅংশগ্রহণ। ডান, বাম- সব মত ও পথের মানুষ বিপ্লবকে সফল করেছে। এত রক্তপাত, এত মানুষের আহাজারির মধ্যেও তার ক্ষমতা লাভের খায়েশ এতটুকু হ্রাস পায়নি। ওই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমি বাংলাদেশেই ছিলাম তিন মাসের মতো। আমার একটা উদ্দেশ্য ছিল ওখান থেকে কিছু করা যায় কি না, সংগঠিত করা যায় কি না। বিভিন্ন জায়গায় শ্রমিক অসন্তোষ, কর্মচারীদের অসন্তোষ। প্রতিদিনই এগুলো লক্ষ্য করতাম। ক্ষোভগুলো তখন রাস্তায় নেমে আসছিল। বিশেষ করে গার্মেন্টস। সে সময় ভাবলাম এদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কিছু করা যায় কি না। এই চিন্তাতেই তিন মাস পেরিয়ে গেল। এরপর একে একে সবাই অ্যারেস্ট হচ্ছি। আমি তো নেত্রীর পরের, তখনই ২১২টি খুনের মামলায় আমি আসামি হয়ে গেছি। এ অবস্থায় অনেকে বলল, ‘আবার এখান থেকেও অনেক অনুরোধ যাচ্ছিল আমি যেন সতর্কভাবে এদিকে চলে আসি। এভাবেই চিন্তা করলাম, আমার বাইপাস সার্জারি হয়েছিল, অনেকগুলো ওষুধ খাওয়াবে কে? তারপর এখানে এলাম।’
সবাই জানেন হাসিনা স্বৈরাচারের লাঠিয়ালদের বড় লাঠিয়াল ছিলেন ওবায়দুল কাদের। দেশের মানুষ এবং সচেতন বুদ্ধিজীবীরা একটি রাজনৈতিক সমাধানের অপেক্ষা করছিলেন। একপর্যায়ে শেখ হাসিনা হাসপাতালে হাসপাতালে মায়া কান্না করে ন্যূনতম রাজনৈতিক সমাধানের কথা ভেবেছিল। পাশের এবং দূরের দেশগুলো থেকে চাপও কম আসছিল না। কিন্তু, সালিশ মানি কিন্তু তালগাছ আমার। পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জন যাই হোক না কেন, সবই হতে হবে হাসিনাকেন্দ্রিক। আর তার সভাসদরা একটু বেশি করে তেল মর্দন করছিলেন। ওরা বলছিলেন, ‘সব জ্যুট হ্যায়, সবকুচ ঠিক হো যায়েগা’। কবিগুরু তো আর এমনি বলেননি, ‘রাজা যা বলে পারিষদ বলে তার শতগুণ’। আর ওবায়দুল কাদের কূটকৌশলের ওস্তাদ। তিনি কৈ-এর তেলে কৈ ভাজার বুদ্ধি নিলেন। ছাত্রদের দ্বারা ছাত্রদের মোকাবিলার সিদ্ধান্ত নিলেন। প্রকাশ্যেই বললেন, ওদের মোকাবিলার জন্য ছাত্রলীগই যথেষ্ট। আর ছাত্রলীগের সোনার ছেলেরা ভবিষ্যতে সোনার মেডেল পাওয়ার জন্য বিবেকহীনভাবে, নৃশংসভাবে সাথিদের, বন্ধুদের রক্ত নেওয়ার জন্য সর্বাত্মক তৎপরতা শুরু করল। এখন অবশ্য কাউয়া কাদের সবকিছু অস্বীকার করছেন। ‘দ্য ওয়াল’-এর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমি কখনো বলিনি যে ছাত্রলীগকে অভ্যুত্থান থামানোর জন্য। সেটা লন্ডন থেকে আমাদের এক ব্যারিস্টার নিঝুম মজুমদার ইউটিউবে এ কথা বলেন। ও তখনকার ভিডিও নিয়ে সেটা প্রচার করেছেন মাস-তিনেক আগে। সেখানে ছাত্রলীগের নামই ছিল না। বিভিন্নভাবে বলা হয়েছে, ওইদিন ছাত্রলীগই যথেষ্ট- এ ধরনের কোনো বিষয় ছিল না আমার বক্তব্যে। আর আমি পার্টির সেক্রেটারি। সে সময় পার্টির সেক্রেটারি হিসেবে আমার ওপর সময়ারোপিত যে দায়িত্ব, তা আমি পালন করেছি।’
আন্দোলনের পটভূমি তথা কারণ সম্পর্কেও তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়। প্রশ্ন ছিল ১৫ বছর দেশ শাসন করেছেন। এত বড় পার্টি, আপনারা কি বুঝতে পারলেন না, এত বড় জনমত তৈরি হয়েছে! এটা কেন হলো? এর জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা তো শুরু হয়েছে কোটা দিয়ে। শেষ হয়েছে একদফায়। এটি একটি ষড়যন্ত্রমূলক ঘটনা। একটা বিস্ফোরণ হয়েছে। সেটা ইন্টেলিজেন্সের একটা ব্যর্থতা ছিল এবং অন্য ব্যর্থতা এটা বলা যাবে না।’ দেশবাসীর কাছে ন্যূনতম ভুল স্বীকারের বিষয়ে আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল আর জাতির কাছে দায়িত্বহীন এই নেতা বলেন, ‘ভারতে বসে আমি কেন ক্ষমাপ্রার্থনা করব? আমি দেশে গিয়ে করব। আমার ভুলত্রুটি হলে সেটার জন্য আমাদের নেত্রী আছেন, তিনিই দেশবাসীকে বলবেন, এখান থেকে বলা কি ঠিক?’ তবে তার নেত্রী নির্লজ্জভাবে এর আগে শতবার বলেছেন, তারা কোনো অন্যায় করেননি। সবই সাজানো নাটক। শেখ হাসিনার ভারত থেকে প্রথম বিবৃতিটি প্রকাশিত হয় ২ নভেম্বর ২০২৪ আওয়ামী লীগের ভেরিফায়েড পেজে। তাতে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে পরিণত হয়েছে। দেশে মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি নেই। শোক পালনের অধিকার নেই। পঁচাত্তরের পরও কুচক্রী মহল একই পরিবেশ তৈরি করেছিল। আজ প্রশ্ন জাগে : মুক্তিযোদ্ধারা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলেন? ৩ নভেম্বর জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে দেওয়া এক বিবৃতিতে তিনি এসব কথা বলেন। এরপরও একই ধরনের অনেক বিবৃতি দিয়ে চলেছেন তিনি। এসব বিবৃতির ভাষায় তার নিজের অন্যায়-অপকর্মের ও অত্যাচারের কোনো স্বীকৃতি নেই, কোনো অনুতাপ, অনুশোচনা নেই। সবকিছুর জন্য প্রাথমিকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জো বাইডেনকে দায়ী করলেও ট্রাম্প আসার পর সুর বদলে যায়। ইসলামি মৌলবাদের উত্থানের ভয় দেখিয়ে তিনি যেমন অতীতে এক-এগারো অনিবার্য করে তুলেছিলেন, ঠিক তেমনিভাবে এখনÑক. সংখ্যালঘু কার্ড ব্যবহার করছেন। খ. দেশের অভ্যন্তরে অস্থিরতা, অরাজকতা তৈরি করছেন। গ. আওয়ামী নেতাকর্মীদের প্রত্যাবর্তনের অলীক কাহিনি শুনিয়ে তাদের জন্য বিপদ আমদানি করছেন। ঘ. বহির্বিশ্ব থেকে বাংলাদেশ যাতে কোনো সহায়তা না পায় সে জন্য চেষ্টা-তদবির করছেন। ঙ. দেশের অভ্যন্তরে ও প্রশাসনে ঘাপটি মেরে থাকা আওয়ামীদের উসকে দিচ্ছেন। বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে ভারতের আশ্রয়-প্রশ্রয় এ ধরনের দেশবিরোধী তৎপরতার প্রতিবাদ জ্ঞাপন করা হয়েছে। কিন্তু ভারত কোনোই তোয়াক্কা করছে না, বরং মোদিজী বলছেন শেখ হাসিনাকে নিরস্ত করতে তার দায় নেই। ভারতের মতো তথাকথিত বৃহত্তর গণতান্ত্রিক দেশের পক্ষ থেকে এ ধরনের বক্তব্য ও তৎপরতা অনাকাঙ্ক্ষিত, অযাচিত ও অনভিপ্রেত।
কাউয়া কাদের আবার আরেকটি বিবৃতি দিয়েছেন। গত ২৩ মে ২০২৫ দলের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে প্রকাশিত তার বিবৃতির শিরোনাম ছিল, ‘ধ্বংসপ্রাপ্ত, ক্ষতবিক্ষত আর রক্তাক্ত এই বাংলাদেশকে নতুনভাবে গড়ার লক্ষ্যে রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা আবার হাল ধরবেন। অসারের এই তর্জন-গর্জনে হাস্যরসের সৃষ্টি হয়েছে। দিন যতই যাচ্ছে, বিশেষত আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হওয়ার পর তাদের আশা-দুরাশায় পরিণত হয়েছে। সচেতন আওয়ামী লীগ কর্মীরা এখন আত্মরক্ষা ও আত্মগোপনে ব্যস্ত। ওবায়দুল কাদেরের বিবৃতি তাদের জন্য বাড়তি ঝুঁকি ও বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতোমধ্যে গণমাধ্যমে কাউয়া কাদেরের প্রতি আওয়ামী মহলের সমালোচনা, ক্ষোভ ও ক্রোধ সৃষ্টি করেছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করে, আওয়ামী লীগ ভবিষ্যতে মুসলিম লীগে পরিণত হবে। হয়তোবা এক দশক পর তাদের অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে আবিষ্কার করতে হবে।
আওয়ামী স্বপ্ন বিলাসের শেষ নেই। আবার আসিব ফিরে এই আশায়, নেশায় বুঁদ হয়ে আছে তারা। তবে তারা মানুষ হিসেবে ফিরে আসতে পারবে কি না, তা সন্দেহের বিষয়। জীবনানন্দ আশা করেছিলেন, ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে- এই বাংলায়, হয়তো মানুষ নয়- হয়তো শঙ্খচিল শালিকের বেশে।’ তারা হয়তো ফিরে আসবে এই বাংলায় শকুন অথবা হায়েনার বেশে। আবার আওয়ামী স্বৈরাচারের পুরোনো শকুন খামচে ধরবে আমাদের জাতীয় পতাকাকে সে আশা দুরাশা মাত্র। বাংলাদেশের আপামর জনতা অনাদি অনন্তকালের জন্য আওয়ামী লীগকে গুডবাই বলেছেন। বাংলাদেশের মানুষ ভয় পাবে না। বাংলাদেশের মানুষ নিঃশেষ হবে না। পবিত্র প্রতিজ্ঞায় গড়বে স্বৈরাচারমুক্ত বাংলাদেশ।