তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় সচরাচর রাজনৈতিক সরকারের চেয়ে প্রশাসনিক আমলারাই মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সরকারের যে পরিবর্তন হয়েছে, তা শুধু স্বাভাবিক সরকার পরিবর্তন নয়, ছাত্র-জনতার একটি অভ্যুত্থান হয়ে গেছে। এ রকম অবস্থায় প্রশাসনে এই পরিবর্তনটি আরও ব্যাপক পরিসরে হওয়া উচিত ছিল।
টার্কিতে একটা ক্যু ঠেকানোর পর প্রায় ৫০ হাজার কর্মচারীকে পদচ্যুত করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমান দিলদরিয়া সরকার অনেক মারাত্মক ক্রিমিনাল এবং খুনিদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে রেখেছে ও ইউনূস সরকারের কাছে জনগণের সবচেয়ে বড় প্রত্যাশা ছিলÑ সামরিক এবং বেসামরিক প্রশাসনকে আওয়ামী মুক্তকরণ করা। এ ক্ষেত্রে কিছু আইওয়াশ ছাড়া কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
মাফিয়া রানি ড. ইউনূসকে অনেক খায়েশ থাকার পরও পদ্মা নদীতে টুপ করে ফেলতে পারেননি। তিনি বুঝতে পারছেন কি না জানি না, তবে তাকে টুপ করে পদ্মায় ফেলে দেওয়ার ঝুঁকি আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। এমতাবস্থায় অতি শিগগিরই যদি ড. ইউনূস তার শত্রু ও মিত্র স্পষ্টভাবে চিনতে না পারেন, তবে বিপদ শুধু জাতির ওপর পতিত হবে না, তিনি নিজে এবং বিশেষ করে এত বছর তিনি বিশ্বব্যাপী যে সুনাম অর্জন করেছেন, তা মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়তে পারে! এখন খুঁজে দেখতে হবে, সরকারের ভেতরে বসে কারা এসব ষড়যন্ত্র করছে? মুশকিল হলো, যারা খুঁজে দেখবে, তারা নিজেরাই ছিল ফ্যাসিবাদের একেকজন দোসর! কালো বিড়ালরা ড. ইউনূসের সব শুঁটকির বাজারের চৌকিদার বনে গেছে।
সচিবালয়ে আগুনের ঘটনা ইউনূস সরকারের জন্য একটা সতর্ককারী ছিদ্র (Tell Tale holes) হিসেবেই দৃশ্যমান হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। যদি ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকে শিক্ষা না নেন, তবে এবার তার চারপাশের সুশীল-সুশীলা উপদেষ্টারা সত্যি সত্যি ডুবিয়ে ছাড়বেন।
বস্তুত এরা হলেন বিশেষ জায়গা থেকে সনদপ্রাপ্ত বিশিষ্ট নাগরিক বা সৎ মানুষ অথবা সাদা দিলের মানুষ । কুমির ছানার মতো এদেরই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সৎ মানুষ হিসেবে তুলে ধরা হয়। সেই যে এক-এগারোতে এদের খুঁজে পেয়েছিলÑ এখনও সেই সহবত (Fatal attraction) জাতি ছাড়তে পারেনি।
আলো-স্টার-সিপিডি চক্রটিকে আমি বলি মেছোভূত কানাওয়ালা। কানাওয়ালা যেমন অন্ধকার রাতে পথচারীকে পথ ভুলিয়ে সারা রাত উন্মুক্ত প্রান্তরে ঘোরায়, এরাও তেমনি আমাদের জাতিকে ৫০ বছর ধরে ঘুরিয়েছে, আমাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে দেয়নি।
সত্যি বলতে কী, বর্তমান সরকারের নিয়ন্ত্রণটিও এই কানাওয়ালাদের হাতে পড়ে গেছে। এদের এমনই শক্তি যে ফরেন মিশনের প্রেস মিনিস্টারের পদবি রাষ্ট্রদূতের ওপরে উঠে পড়ে। অর্থাৎ এদের দাপটে বাঁশের চেয়ে কঞ্চি মোটা বনে যায়।
এই কানাওয়লারাই ফ্যাসিবাদের দোসরদের বহাল তবিয়তে আগের জায়গায় বসিয়ে রেখেছে! অজুহাত হলো, নিচের কয়েক স্তরে আওয়ামী লীগ তাদের লেসপেন্সারদের সেট করে গেছে। চারপাশে আওয়ামী বান্দর, হনুমান, বেজি, শিয়ালে ভর্তি দেখে আওয়ামী বাঘকেই বসিয়ে রাখতে হবেÑ এই যুক্তি গ্রহণযোগ্য হবে না!
এখন কাঙালের কথা বাসী হওয়ার আগেই ফলতে শুরু করেছে ও সচিবালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় রহস্যময় আগুন লাগানো হয়েছে! এখানে আস্তিনের সাপ যে ছোবল বসিয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আগুনের পেছনে কারা এটা উপলব্ধির জন্য বিরাট শার্লক হোমস হওয়ার দরকার নেই। একটা স্কুলের বাচ্চাও বুঝতে পারছে যে এর পেছনে কারা থাকতে পারে।
সবকিছুতে যেমন কেষ্ট ব্যাটাই চোর। তেমনি আগুন লাগলেই দোষ পড়ে বৈদ্যুতিক লাইনে শর্টসার্কিটের। অথচ এসব শর্টসার্কিট প্রতিরোধে বেশ কয়েকটি প্রটেকশন মেকানিজম রয়েছে। এগুলোও স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করে। প্রথম প্রটেকশন হলো লাইনের সার্কিট ব্রেকার ট্রিপ করে অতিরিক্ত কারেন্ট প্রবাহ বন্ধ করে দেবে! আর কারেন্ট বৃদ্ধি হঠাৎ হলে লাইনের ফিউজ নিজে গলে গিয়ে বৈদ্যুতিক লাইন বা ইকুইপমেন্টকে অতিরিক্ত কারেন্টপ্রবাহ থেকে রক্ষা করবে।
এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে সরকারের এমন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় এ ধরনের ইলেকট্রনিক ইকুইপমেন্টগুলো ত্রুটিপূর্ণ থাকতে পারে। তা ছাড়া ঘটনা ঘটেছে অফিস এলাকায় রাতের বেলা, যখন অধিকাংশ বৈদ্যুতিক ইকুইপমেন্ট বন্ধ ছিল। অব্যবহৃত ইকুইপমেন্টে বা লাইনে শর্টসার্কিটিংয়ের সম্ভাবনা আরও কমে যায়।
এ রকম হলে প্রথমেই তো এই বিল্ডিংয়ের সংশ্লিষ্ট নির্বাহী ইঞ্জিনিয়ার এবং টিমকে শূলে চড়ানো উচিত। এ রকম গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় এ রকম অবহেলা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। আগুন লাগলেই যদি ছেলে ভোলানো শর্টসার্কিটের গল্প ফাঁদা হয়, তবে এই সরকারের সঙ্গে আগের অন্যান্য সরকারের সঙ্গে পার্থক্য কোথায় রইল?
মুরব্বি নিজে হুক্কায় টান দিয়ে শিষ্যদের বিড়ি ফুকতে মানা করলে কোনো কাজ হবে না। কাজেই কারও পক্ষেই রাতারাতি বিরাট সংস্কার সম্ভব হবে না। এই সংস্কারের জন্য আগে আমাদের মন ও মননের সংস্কার জরুরি। সেটা আসবে ধীরে ধীরে, ধাপে ধাপে। সংস্কার হলো রাজনৈতিক, সামাজিক, নৈতিক ও অর্থনৈতিক সংগ্রামের যুগপৎ প্রক্রিয়া। এর কোনো একটিকে থামিয়ে রাখলে বা সাসপেন্ড করে রাখলে কাঙ্ক্ষিত ফল আসবে না। কাজের কাজ কিছুই হবে না, শুধু সংস্কারের নামে লেফট-রাইট বা হম্বি-তম্বি চলবে। ড. ইউনূস এই মুহূর্তে জাতির জন্য আশীর্বাদ, তাকে জাতির প্রয়োজনেই কাজে লাগানো উচিত। কোনো মতলববাজ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প্রয়োজনে নহে।
আরেকটা ব্যাপারও আমাদের সবার জন্য কিছুটা হতাশার কারণ হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো নিজ নিজ স্টেইক প্রতিষ্ঠার নিমিত্তে অনেক আগেভাগেই বিভক্ত হয়ে পড়েছে। ফলে অরাজনৈতিক এ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির ক্ষমতাও অনেকটা হারিয়ে ফেলেছে।
ছাত্র সমন্বয়করা নিজেদের রাজনৈতিক অভিলাষ প্রকাশ করলেও তাদের পেছনের শক্তি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা করা যাচ্ছে না। ছাত্ররা তাদের বয়সের কারণেই চাণক্য রাজনীতি কম বোঝেন। কিন্তু আমাদের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতারা বুঝেন একটু বেশি । কাজেই এই কম বোঝা যেমন আমাদের জন্য বিপদ, তেমনি বেশি বোঝা আমাদের জন্য আপদ হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে । আগেরবার ছিলাম তেরো বছর নির্বাসনে। সামনে জানি না কত বছর থাকতে হবে? সমস্যা হলো, বিএনপি, ছাত্র সমন্বয়ক এবং জামায়াত ধাওয়া খাওয়া শুরু করলে ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চা হিসেবে এই অধমকেও দৌড়াতে হবে। তাই সবাইকে উদ্দেশ্য করে কিছু কথা না লিখে পারছি না।
সামগ্রিক পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, একটি কমন জায়গা থেকে বিএনপি এবং জামায়াত উভয় দলকেই একটা কলিসন কোর্সের দিকে ধাবিত করা হচ্ছে, এই মিঠাই খাওয়ানোর লোভ দেখিয়ে। কাজেই আগে যারা বিষ খাইয়ে মারতে পারেনি, তারা কি এখন মিঠাই খাইয়ে মারার পরিকল্পনা নিচ্ছে কি না, তা উভয় দলকেই ভেবে দেখতে হবে।
এখন ইন্ডিয়া খুঁজছে সফট বা সহনশীল ‘আওয়ামী লীগ’ । এ কারণে বিএনপি এবং জামায়াত উভয়কেই সম্ভবত (অনুমান) এ রকম অফার সরাসরি অথবা ইঙ্গিতে দেওয়া হয়েছে। এ কারণেই দুটি দলই একে অপরের দিকে ইন্ডিয়াপ্রীতির অঙ্গুলি নির্দেশ করেছে! বাস্তবতা হলো, ইন্ডিয়া বিএনপিকে সামান্য সহ্য করলেও জামায়াতকে কখনোই মেনে নেবে না। আর বিএনপিকেও খালে নামিয়ে লুঙ্গিটা সবাইকে দেখিয়ে ছাড়বে, যে কিছিমে বিজেপি নেতার সম্মুখে প্রভাবশালী বিএনপি নেতার সেই গোপন ছবিটি প্রদর্শন করেছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যেখানে একই দলের বিভিন্ন গ্রুপে প্রায়ই খুনাখুনি বেধে যায়, সেখানে অনেক স্বার্থের ক্ষেত্রে পরস্পরের মুখোমুখি দুটি দলের মধ্যে এসব বাগবিতণ্ডা, অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার । এটাকে একটা সীমার মধ্যে কনটেইন করে রাখতে পারলে দেশের গণতন্ত্র উপকৃত হবে। তবে সবার কমন শত্রু আওয়ামী লীগকে নিয়ে একটা রাজনৈতিক ও আইনি সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত গণতন্ত্রের এই আশীর্বাদ আমাদের জন্য অভিশাপ হয়ে পড়তে পারে। সিম্পটম দেখে তেমনই মনে হচ্ছে।
সেই পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য উভয় দলকেই একটা রাজনৈতিক বোঝাপড়ায় পৌঁছানো উচিত। অন্ততপক্ষে আগামী দুটি টার্ম এই রাজনৈতিক বোঝাপড়া বজায় রাখা দরকার।
আমি এ কথাটি বলছি, একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে, কোনো ইজম বা দলের প্রতিনিধি হিসেবে নহে। বারবার বলেছি, বিএনপি ও জামায়াতের আলাদা আলাদা রাজনৈতিক ভিশন ও মিশন রয়েছে। অনেক জায়গায় একদল আরেক দলের শক্ত প্রতিপক্ষ। সামনের সময়ে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে বা করতে হবে। তবে এই পলিটিক্যাল ফাইট বা রাজনৈতিক কাইজ্জা নতুন স্টাইলে করতে হবে। প্রতিপক্ষকে কুৎসিত দেখিয়ে নয় বরং নিজেকে অধিকতর সুন্দর দেখিয়ে এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে হবে।
৭১-এর চেতনাকে আওয়ামী লীগ লেবুর চেয়েও বেশি চিপে ফেলেছে। আওয়ামী লীগের সেই চিপা লেবুকে একই কিছিমে বিএনপি চিপে কতটুকু রস বের করতে পারবে বা রাজনৈতিক পয়েন্ট অর্জন করতে পারবে, সেটাই গবেষণার বিষয়। জেনারেশনÑ জি প্রজন্মের কাছে পৌঁছাতে বা প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করতে অন্য কৌশলে অগ্রসর হতে হবে।