
আবদুল লতিফ মাসুম
রাজনৈতিক দল সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে যেসব কথাবার্তা বলা হয়, তার সারাংশ হচ্ছে প্রতিটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতা অভিলাসী। একেকটি রাজনৈতিক দল দেশ-জাতি-রাষ্ট্রের একেক অবস্থায় বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
ঔপনিবেশিক শক্তির অবসানে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় স্বাধীনতা-সংগ্রামের প্রাক্কালে যেসব রাজনৈতিক দল গঠিত হয়, সেগুলো সাধারণভাবে সব মতের, সব পথের মানুষজনকে একত্র করে। অনেকে একে বলেন Umbrella বা ছাতার মতো দল।
যখনই স্বাধীনতা অর্জিত হয়, তখন এই সম্মিলিত Umbrella Party-এর প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায়। ভিন্ন মত, ভিন্ন দল ও বিশেষ বিশেষ নেতার আবির্ভাব লক্ষ করা যায়। ১৯৪৭ সালের পূর্বকালে মুসলিম লীগের অধীনে গোটা ভারতবর্ষের মুসলমানরা একত্র হয়। পাকিস্তানে মুসলিম লীগ ক্ষমতাসীন হয়। কালের বিবর্তনে সময়ের প্রয়োজনে মুসলিম লীগের বিপরীতে পূর্ব ও পশ্চিম অংশে বিরোধী দলের উদ্ভব হতে থাকে।
মুসলিম লীগের শাসনে সাধারণ মানুষের স্বার্থ উপেক্ষিত হতে থাকে। তাই সাধারণ মানুষের কথা বলার জন্য ২৩ জুন ১৯৪৯, ঢাকার কেএম দাস লেনের রোজ গার্ডেন (Rose Garden) নামক স্থানে, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। আওয়ামী শব্দটির অর্থ সাধারণ। এর দ্বারা বোঝানো হয় যে মুসলিম লীগের খাজা-গজাদের থেকে ভিন্নতর এই দল। তখনকার রাজনীতিতে মুসলিম সেন্টিমেন্ট ছাড়া অগ্রসর হওয়া সম্ভব ছিল না।
যতই দিন যেতে থাকে, এই নবগঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগ বামদের খপ্পরে পড়ে। মওলানা ভাসানীকে দলের প্রধান করে ইসলামি ভাবধারা অক্ষুণ্ণ রাখার ভান করা হয়। সুযোগ বুঝে পরে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে শুধু আওয়ামী লীগ গঠিত হয়। পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনৈতিক নেতৃত্বের অবহেলা, অদূরদর্শিতা ও অন্যায়ের কারণে পূর্বাংশের মানুষ দিনে দিনে ক্ষুব্ধ হতে থাকে। বিশেষ করে ভাষা আন্দোলনে শাসক মুসলিম লীগের ভূমিকার কারণে ১৯৫৪ সালে এক কালের অবিসংবাদিত রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগের কবর রচিত হয়। পরবর্তী পাকিস্তান আমলে মুসলিম লীগ আর এই অঞ্চলে পূর্ব অবস্থায় ফিরে যায়নি। পাকিস্তানের ওই অংশে মুসলিম লীগ বহু রদবদলের পর এখনো টিকে আছে।
এদিকে পাকিস্তানের এই অংশের মানুষের দুঃখ, কষ্ট ও বঞ্চনার কথা বলে সংগতভাবেই আওয়ামী লীগ বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। প্রতিটি আন্দোলনে তাদের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব আরো বিস্তৃত হয়। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের একমাত্র জাতীয় নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে দৃশ্যত পাকিস্তানের মনস্তাত্ত্বিক মৃত্যু ঘটে। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অবশেষে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্ররূপে আত্মপ্রকাশ করে।
ভারতের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এই স্বাধীনতা অর্জিত হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সেই ব্যাকরণ অনুযায়ী আওয়ামী লীগ স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে জনগণের আস্থা হারিয়ে ফেলে। আওয়ামী লীগ নামক Umbrella Party-তে যারা এতদিন একত্র ছিলেন বা একজোটে ছিলেন, তারা বিরোধী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হন। স্বাধীনতার পরপর যেহেতু সমগ্র জাতির রক্তক্ষরণের মাধ্যমে মুক্ত হয়েছে স্বদেশ, যৌক্তিক ছিল জাতীয় সরকারের মাধ্যমে দেশ পরিচালনা করা। মওলানা ভাসানীর মতো বর্ষীয়ান নেতা জাতীয় সরকারের আবেদন জানালেও আওয়ামী লীগ কোনো ধরনের বিরোধিতাকে সহ্য করেনি। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তাই করেছে, যা করেছে শেখ হাসিনা ১৫ বছরে। অবশেষে ‘এক নেতা এক দেশ’ বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ ঘোষণা করে তারা বাংলাদেশে অর্জিত গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠায়।
আওয়ামী লীগ যখন থেকে শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়, তখন থেকেই ক্রমেই তার গণতন্ত্রবিরোধী ভূমিকা অতিমাত্রায় দৃশ্যমান হতে থাকে। অথচ পাকিস্তান আমলে ২৩ বছর তারা গণতন্ত্রের জন্য যুদ্ধ করেছে। তাহলে বোঝা যায় যে গণতন্ত্র তাদের মূল আদর্শ নয়। তারা এ অঞ্চলের মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য গণতন্ত্রের কথা বলেছে। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরেও লেশমাত্র গণতন্ত্রের চর্চা ছিল না। এক ব্যক্তি এক নেতা প্রথম থেকেই দৃশ্যমান ছিল। তৃণমূল থেকে একেবারে কেন্দ্রীয় পর্যায় পর্যন্ত শক্তির এই মদ-মত্ততা প্রকাশ্য ছিল। জনগণ তাদের ভয় করত। ভালোবাসত না।
ভয়তন্ত্র দ্বারা জয়তন্ত্র কায়েম করেছিল তারা। একটি ভোটকেন্দ্রের উদাহরণ দেওয়া যাক যেখানে এই লেখক উপস্থিত ছিলেন। ৩০ ভাগ লোক সেখানে নৌকার সমর্থক ছিল। আর ১০ ভাগ ছিল বিরোধী। বাকি ৬০ ভাগ ছিল নীরব-নিষ্ক্রিয়। ৩০ ভাগ লোক ওই ৬০ ভাগ লোককে কীভাবে দাবিয়ে নিয়ে ৯০ ভাগ ভোট কাস্ট করিয়েছিল তা চোখের সামনে দেখা ঘটনা। আওয়ামী লীগের ইতিহাস যারা জানেন তারা অবশ্যই অবগত আছেন যে বড় নেতারা তার অগণতান্ত্রিক ও অশোভন আচরণের জন্য একে একে আওয়ামী লীগ ছেড়ে যান। সে এক অন্য গল্প। এমনকি আওয়ামী লীগের অবিসংবাদিত নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৬২ সালের পরে রাজনৈতিক কার্যক্রম শুরুর পরপর বড় নেতাদের সঙ্গে এক বিবৃতি দিয়ে বলেন যে, স্বৈরাচার খেদাও ও গণতান্ত্রিক পুনরুদ্ধারের আগে ভিন্ন ভিন্নভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যক্রম পরিচালন করবে না।
৯ নেতার বিবৃতি বলে খ্যাত ছিল সেটি। নেতার আদেশ লঙ্ঘন করে শেখ সাহেব এখানে আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবন ঘটান। একে একে খসে পড়েন আতাউর রহমান খান, আবদুস সালাম ও আমেনা বেগমের মতো নেতানেত্রীরা। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর তাজউদ্দীনের মতো ত্যাগী নেতাকেও নীরবে-নিঃশব্দে বিতাড়ন করা হয়। বাকশালের নেতৃত্বের বণ্টন দেখলেও বোঝা যাবে যে একটি শেখতন্ত্র নামের রাজতন্ত্রের দিকে দেশ ধাবিত হচ্ছিল। বাকশালের চেয়ারম্যান ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। যুবলীগের প্রধান ছিলেন তার ভাগনে শেখ ফজলুল হক মনি। জাতীয় ছাত্রলীগ সভাপতি ছিলেন তার আরেক ভাগনে শেখ শহিদুল ইসলাম। কৃষক লীগ সভাপতি ছিলেন তার আপন ভগ্নিপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবাদ। আমলাতন্ত্রে দাপট ছিল তার আরেক ভগ্নিপতির। গুজব ছিল শেখ জামালকে দ্রুত প্রমোশন দিয়ে সেনাবাহিনীপ্রধান করার।
এসব প্রবণতা দেখে পাকিস্তান আমল থেকেই সচেতন মানুষ আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী তথা নাজিবাদী বিষয়-বৈশিষ্ট্যের কথা বলতেন। জার্মানির হিটলার ও ইতালির মুসোলিনি মূলত নিরেট ও নিরঙ্কুশ নির্বাচনের মাধ্যমে কখনোই ক্ষমতাসীন হয়নি। তারা নির্বাচনকে ক্ষমতা আরোহণের বাহন হিসেবে ব্যবহার করেছে।
১৯৩২ সালের নির্বাচনে নাৎসি পার্টি সর্বাধিক ভোট পেলেও (প্রায় ৩৭%) সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। প্রেসিডেন্ট পল ফন হিন্ডেনবার্গ তখনো হিটলারকে চ্যান্সেলর বানাতে অনিচ্ছুক ছিলেন। অবশেষে রাজনৈতিক চাপে এবং ব্যাকডোর চুক্তির মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গ ১৯৩৩ সালের ৩০ জানুয়ারি হিটলারকে চ্যান্সেলর (প্রধানমন্ত্রী) হিসেবে নিযুক্ত করেন। একই ঘটনা ঘটে মুসোলিনির ক্ষেত্রে। ১৯২২ সালে মুসোলিনি তার ব্ল্যাকশার্ট বাহিনী নিয়ে ‘মার্চ অন রোম’ নামের এক শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রদর্শন করেন। এ ঘটনার চাপে পড়ে তৎকালীন ইতালির রাজা ভিক্টর ইমানুয়েল III, গণতান্ত্রিক সরকার ভেঙে মুসোলিনিকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন (২৯ অক্টোবর ১৯২২)।
১৯৪৯ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত যদি আওয়ামী লীগের ইতিহাস বিশ্লেষণ করা যায়, তাহলে ওই নাজিবাদী-ফ্যাসিবাদী চরিত্রের ও ঘটনার আবর্তন-বিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে বিগত ১৫ বছরে যে তিনটি নির্বাচন হয়েছে, তা প্রমাণ করে যে নির্বাচনকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা আরোহণের বাহন হিসেবে ব্যবহার করেছে। কখনোই কোনোদিনও তারা স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দেয়নি।
২০১৪ সালে ভোটারবিহীন নির্বাচন করে তিনি কূটনীতিকদের আশ্বস্ত করেছিলেন- আরেকটি প্রকৃত নির্বাচন শিগগিরই হবে। সে কথা তিনি রাখেননি। ২০১৮ সালে ড. কামাল হোসেনের মতো প্রবীণ রাজনীতিবিদকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, আমি জাতির পিতার কন্যা আমাকে বিশ্বাস করুন। তিনি দিনের ভোট রাতে করে সে বিশ্বাসের জবাব দিয়েছিলেন। ২০২৪ সালে স্ব-ঘোষিত ‘ডামি’ ভোট করে আত্মপ্রতারণার মহড়া প্রদর্শন করেছিলেন। এরপরের ইতিহাস আরো করুণ, আরো নির্মম। হিটলার মুসোলিনিরা রক্তপাতের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। শেখ হাসিনা রীতিমতো গণহত্যার মধ্য দিয়ে ক্ষমতার মসনদ রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। যে নির্মমতা ও পাশবিকতা তিনি প্রদর্শন করেছেন, তা সমসাময়িক ইতিহাসে বিরল।
২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবের পর আওয়ামী লীগ জনগণের রুদ্ররোষে এমনিই নিষিদ্ধ হয়ে যায়। সাধারণভাবে স্বাভাবিকভাবে কেউ আওয়ামী লীগের কথা প্রকাশ্যে বলার স্পর্ধা রাখেনি। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই গণঅভ্যুত্থান শক্তি বিভাজনের সুযোগে তারা কচ্ছপের মতো মুখ বের করার চেষ্টা করে। এতে বিরোধী শক্তির প্রাণহানিও ঘটে। ১৫ বছর ধরে যে দীর্ঘ রক্তপাত তারা করেছে, তার জন্য তাদের নেতানেত্রীদের কোনো অনুশোচনা নেই। বরং মাঝেমধ্যে উদ্ভট উচ্চারণ করে তারা জনগণের এতটাই ক্ষোভের সম্মুখীন হয়েছে যে, ৩২ নম্বরের একটি ইটও অক্ষত থাকেনি। অবশ্য সমাজে না থাকলেও রাষ্ট্রে তাদের যে লোকজন এখনো ঘাপটি মেরে আছে, রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের দেশত্যাগ তার প্রমাণ। সেলিনা হায়াত আইভী আওয়ামী লীগ করেন- সেটি মনে রাখতে হবে। তিনিও নানাভাবে মানুষকে নিগ্রহ করেছেন।
এখন ভালোত্বের সুযোগ নিয়ে কালো আওয়ামী লীগকে সাদা করতে চাইছেন। এ রকম বিশুদ্ধ অথবা অশুদ্ধ আওয়ামী লীগের আত্মপ্রকাশ জনগণ শিগগিরই দেখবে। আইনগতভাবে তারা নিষিদ্ধ হলেও অন্য নামে অন্য দামে তারা আত্মপ্রকাশ করতে চাইবে। ১৯৭৫ সালের পর আওয়ামী লীগ ৩-৪ ভাগ হয়ে নিবন্ধন নিয়েছিল। মালেক আওয়ামী লীগ, মিজান আওয়ামী লীগ ও দেওয়ান ফরিদ গাজী আওয়ামী লীগ-আরো কত কি! এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না।
শাহবাগের উত্তাল জনতা আওয়ামী লীগের আইনানুগ আত্মপ্রকাশের পথ চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছে। সেখানে অবাক লাগে যে বিষয়টি গণঅভ্যুত্থানের পরপরই ঘোষিত হওয়া উচিত ছিল, সেটি কার্যকরকরণের জন্য ফ্যাসিবাদবিরোধী সমগ্র জনগণের শক্তিকে শাহবাগে আরেকটি গণঅভ্যুত্থানের নজির স্থাপন করতে হলো। অন্তর্বর্তী সরকারের অভ্যন্তরে আসলেই যে আওয়ামী কিছু প্রেতাত্মা ক্ষমতায়িত হয়ে আছে, তা বোঝা যায়। অবশেষে যে ভাষায় ও ভাবে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের কথা বলা হয়েছে, তাও আপেক্ষিক। একটি নির্বাহী আদেশে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের কথা বলা কি অসম্ভব ছিল? অন্তর্বর্তী সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও তার নেতাদের বিচারকার্য সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত দলটির যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকবে। জুলাই বিপ্লবের পর আওয়ামী লীগ কি সিদ্ধ ছিল! একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধনী প্রস্তাবও অনুমোদন দিয়েছে সরকার।
এর সারমর্ম হচ্ছে এই যে, পরে ট্রাইব্যুনাল রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচার করতে পারবে। এর অঙ্গ-সংগঠন বা সমর্থক গোষ্ঠীকে শাস্তি দিতে পারবে। ছাত্রদের দাবি মোতাবেক জুলাই ঘোষণাপত্র আগামী ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে চূড়ান্ত প্রকাশ করার সিদ্ধান্তও উপদেষ্টা পরিষদের সভায় গৃহীত হয়েছে। উল্লেখ্য যে, অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই ঘোষণাপত্রের বিষয়ে এর আগেও অনুরূপ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকার স্ব-ইচ্ছায়, স্ব-প্রণোদিত হয়ে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নিতে পারল না। শাহবাগে আরেকটি গণঅভ্যুত্থানের মুখে তাদের সিদ্ধান্ত এলো।
রাজনৈতিক দল ও রাষ্ট্র তথা সরকার এক ও অভিন্ন নয়। এই বাস্তবতা থেকে অন্তর্বর্তী সরকারকে দেশজ, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়াদি বিবেচনা করতে হয়েছে। সেই একই দৃষ্টিভঙ্গিতে Government in Waiting বলে কথিত প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিকে অনেক কিছু বিবেচনা করে কথা বলতে হয়েছে। আমরা একটি সংকটময় সময় অতিক্রম করছি।
দূর দেশের নেতৃত্বের অদল-বদলে উদ্ভূত পরিস্থিতি আমলে নিতে হয়েছে। নিকট দেশের প্রতিবেশী ক্রমেই নানা কায়দায় নানাভাবে বাংলাদেশকে অধীনস্থ করার জন্য যে উৎপীড়ন শুরু করেছে- এসব বাস্তব সত্য বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। এ সিদ্ধান্তের ফলে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আড়ালে-আবডালে যে গুজবের ছড়াছড়ি ছিল, তার অবসান হলো। আওয়ামী লীগের দীর্ঘ ইতিহাস বিশ্লেষণ করে আমরা দেখতে পেয়েছি, ১৯৭১ সালের পর আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে তার অবস্থান শূন্যের কোঠায় নামিয়ে এনেছে।
শুধু ফ্যাসিবাদী কায়দায় অতি উগ্র জাতীয়তাবাদ তথাকথিত স্বাধীনতার চেতনা দ্বারা মানুষকে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে শাসন করেছে। ১৯৭৩ সালে নির্বাচন ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। ১৯৯৬ সালে যখন তারা অনেক বছর পর ক্ষমতাসীন হয়, তা ছিল- বিভাজন, প্রতারণা, মিথ্যাচার ও ষড়যন্ত্রের বিজয়। এখন আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা তলানিতে ঠেকেছে। অনেকেই পুরোনো হিসাব কষে আওয়ামী লীগের অবস্থান দেখতে চান, প্রকৃতপক্ষে গতানুগতিক সে হিসাবের অবসান ঘটেছে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। জনগণ চিরকালের জন্য আওয়ামী লীগের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। একটা রাজনৈতিক দল যদি আদর্শবাদী হয়, তার প্রভাব বজায় থাকে সে ক্ষমতায়িত না হলেও।
কিন্তু শুধু ক্ষমতাশ্রয়ী রাজনৈতিক দল ক্ষমতা বলয়ের বাইরে বেঁচে থাকতে পারে না। ১৯৭৫ সালের পর ২১ বছর লেগেছে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসতে। এবার তাদের ক্ষমতায় ফিরতে ২১-এর দ্বিগুণ সময় ৪২ বছর হয়তো লাগবে। ততদিনে প্রবল প্রতাপান্বিত আগেকার মুসলিম লীগ এখন যেমন, তখন তারা সে রকমই থাকবে। মাইক্রোস্কোপ দিয়ে তাদের আবিষ্কার করতে হবে হয়তো। মোটকথা, যে প্রজন্ম রক্ত দিয়েছে, তারা বেঁচে থাকতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। জনগণের সম্মিলিত শক্তির মুখে কোনো ষড়যন্ত্র সফল হবে না। ‘রক্তে লেখা যারা ইতিহাস গড়ে,
ষড়যন্ত্র টিকে না জনগণের ঝড়ে।’