Image description

ইমরান মালিক

 

ভারতের সামরিক সক্ষমতার দৌড় কতটুকু, তা চলতি মাসের ৬-৭ তারিখেই স্পষ্ট হয়ে গেছে। নিজের আকাশসীমার মধ্য থেকেই ভারতীয় বিমানবাহিনী পাকিস্তানের অভ্যন্তরে অনেকগুলো জায়গায় নজিরবিহীন বিমান হামলা চালিয়েছে। এতে জীবন হারিয়েছে ৩১ জন নিরপরাধ মানুষ। এ ছাড়া আরো ৫৭ জন নারী-পুরুষ ও শিশু আহত হয়েছে। এদের সবাই বেসামরিক নিরস্ত্র মানুষ। তথাকথিত সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর সঙ্গে এদের সামান্যতম সম্পর্ক নেই। অথচ সন্ত্রাসীদের আস্তানা আখ্যা দিয়ে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে অবস্থিত এ জায়গাগুলো হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে তারা। এর মাধ্যমে ভারত-পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক বর্ডার, ভৌগোলিক অখণ্ডতা এবং সার্বভৌমত্বের ওপর হামলা করে বসেছে। ভারতের এই আক্রমণ প্রতিরোধে পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী যেই ক্ষিপ্রতা ও দক্ষতার নজির স্থাপন করেছে, তা ভারতকে রীতিমতো চমকে দিয়েছে। পাকিস্তানি বাহিনীর দক্ষতার ফলে প্রাথমিক হামলার ধকল সামলে নিতে মোটেও বেগ পেতে হয়নি।

আক্রমণ চালানোর সময়

ভারত বুঝতে পারেনি যে পাকিস্তানের এতটা প্রতিরোধের মুখে পড়বে। প্রতিরোধের তীব্রতায় ভারতীয় বাহিনী অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। এর মধ্য দিয়ে পাকিস্তান বিমানবাহিনী আবার তার পেশাগত দক্ষতার স্বাক্ষর রাখল। সে বুঝিয়ে দিল যে ভারতীয় বিমানবাহিনীর ওপর তার কর্তৃত্ব আগের মতোই অক্ষুণ্ণ আছে।

মুহূর্তের মধ্যেই পাঁচটি ভারতীয় ফাইটার বিমান ও অন্তত একটি ইউএভি ভূপাতিত করে ফেলে পাকিস্তান। এসব বিমানের মধ্যে রয়েছে তিনটি অত্যাধুনিক রাফাল বিমান, একটি এসইউ-৩০ এমকে১ ও একটি মিগ-২৯। এই বিপর্যয় সামাল দিতে ভারত এখন ইসরাইলের তৈরি কামিকাজি ড্রোনের ব্যবহার শুরু করছে। এসব ড্রোন পাকিস্তানে এসে আবার নিরস্ত্র মানুষের ওপর হামলা চালাচ্ছে।

একদিকে পাকিস্তান আর্মি ভারতের একটি ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার, একটি ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার এবং অসংখ্য ছোট ছোট সেনাফাঁড়ি ধ্বংস করে দিয়েছে। অন্যদিকে পাকিস্তান নৌবাহিনীও সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। নিজেকে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের পরাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার এসব ভারতীয় কসরত বরাবরই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।

আসলে ভারতের এসব হামলার মধ্য দিয়ে নেতারা যে কৌশলগত লক্ষ্য অর্জন করতে চায়, তার সঙ্গে ভারতের প্রকৃত ক্ষমতার বিস্তর ফারাক রয়েছে। এ বিষয়টি সম্ভবত এখনো বুঝে উঠতে পারেননি। এ কারণেই মোদি ও তার সরকার বারবার ভুল ভূরাজনীতি ও ভূকৌশলের আশ্রয় নিচ্ছেন। সর্বশেষ পেহেলগামের ফলস ফ্লাগ অপারেশনের বেলাতেও একই কথা খাটে।

এই হামলার মাধ্যমে নরেন্দ্র মোদি ও আরএসএস সমর্থিত বিজেপি সরকার যে কৌশলগত লক্ষ্য অর্জন করতে চেয়েছিল, তার ধারে-কাছেও যাওয়া সম্ভব হয়নি। সর্বশেষ এই হামলাটি ভূকৌশলগতভাবে বিশ্লেষণ করলে কয়েকটি বিষয় ফুটে ওঠে-

এক. ক্ষমতা প্রদর্শন করার পাশাপাশি ভারতকে দক্ষিণ এশিয়ার নিরঙ্কুশ আধিপত্যবাদী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা।

দুই. পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান অথবা শাস্তিমূলক সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের জন্য একটি যুদ্ধের অজুহাত তৈরি করা।

তিন. পেহেলগাম হামলাকে রাষ্ট্রীয় মদতে লাইন অব কন্ট্রোল অতিক্রম করে চালানো আরো একটি সন্ত্রাসী কার্যক্রম হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা।

চার. পাকিস্তানকে কূটনৈতিকভাবে একঘরে করে ফেলা।

পাঁচ. সিন্ধুর পানিবণ্টন চুক্তি মুলতবি রাখার একটা অজুহাত সৃষ্টি করে সিন্ধু, ঝিলাম ও চন্দ্রভাগা নদীর পানিকে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা।

ছয়. অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কিছু সুবিধা অর্জন করা এবং বিহারের নির্বাচনে জয়লাভ করা।

মোদি অনেক দিন ধরেই বলে আসছেন ভবিষ্যতের যুদ্ধ হবে পানিকে কেন্দ্র করে। সিন্ধু পানিচুক্তি স্থগিত করার মাধ্যমে এ ক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপটি তিনিই নিলেন। সামরিক লক্ষ্য অর্জনের স্বার্থে নদীর পানিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার ফলে পাকিস্তানের ভাটি অঞ্চল সংকটজনক অবস্থায় পড়ে যেতে পারে।

মোদির এই কৌশলের কারণে ভূকৌশলগত যুদ্ধে একটি নতুন উপাদান যুক্ত হলো। এখন থেকে নদী ও জলসম্পদ অধিকাংশ ভূকৌশলগত পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। প্রধানমন্ত্রী মোদি বহুদিন ধরেই সিন্ধু পানিচুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার পাঁয়তারা করছেন। পেহেলগামের এই ‘ফলস ফ্ল্যাগ’ অভিযানে তার প্রধান কৌশলগত লক্ষ্য সিন্ধু পানিচুক্তির কার্যকারিতা নষ্ট করে দেওয়া।

এদিকে কাবুল নদীর ওপরে অনেকগুলো বাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রে সহায়তা করার জন্য আফগানিস্তানকে প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে ভারত। এর ফলে পাকিস্তান কৌশলগতভাবে খুবই অসুবিধাজনক অবস্থানে পড়ে যেতে পারে। ভারত ও আফগানিস্তানের ভেতর থেকে প্রবাহিত হয়ে পাকিস্তানে আসা নদীগুলোর কারণে চতুর্মুখী সংকটে পড়ে গেছে। শুধু ভারতের সামরিক অভিযান ও আফগানিস্তানের সন্ত্রাসী কার্যক্রম দিয়ে পাকিস্তানকে মোটেও কাবু করা যাবে না। তবে এর চেয়ে বড় ঝুঁকির ব্যাপার হবে যদি পাকিস্তান তার দেশের দুদিক থেকেই পানিসংকটের মধ্যে পড়ে যায়। এখন প্রশ্ন হলো, সিন্ধু পানিচুক্তি লঙ্ঘন করার অর্থ কি এখন থেকে রাভি, সুতলেজ আর বায়া নদীর ক্ষেত্রেও একই নীতি প্রযোজ্য হবে?

একটা বিষয় স্বীকার করে নিতে হবে, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারত উজানে এবং পাকিস্তান ভাটির দিকে অবস্থান করছে। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, চীন ও ভারতের দিক থেকে হিসাব করলে ভারতের নিজের অবস্থান আবার ভাটির দিকে। তাই ভারত এখন আন্তর্জাতিকভাবে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে, একদিন সে একই উদাহরণ তার বিরুদ্ধে আরো অনেক বেশি ভয়ংকরভাবে ব্যবহৃত হতে পারে।

ভারতের তরফ থেকে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের নিলাম-ঝিলাম জলবিদ্যুৎ প্রকল্পকে টার্গেট করা রীতিমতো যুদ্ধাপরাধের শামিল। এ ঘটনা ভবিষ্যতের পানিযুদ্ধের ক্ষেত্রে একটা উদাহরণ হয়ে থাকবে। এ ধরনের একটা বাজে দৃষ্টান্তের প্রভাব পড়তে পারে আমাজন, নীল নদ ও ব্রহ্মপুত্রের মতো বিশ্বের বৃহত্তম নদীগুলোর ওপর। ভারতের এমন কিছু ঘটানো উচিত হবে না, যা তার নিজের ওপর বর্তালে সামাল দিতে পারবে না।

তবে এটাও মনে রাখতে হবে, লাখ লাখ কিউবিক পানি আটকে রাখা ও ভিন্নদিকে প্রবাহিত করতে গিয়ে ভারত ও আফগানিস্তান নিজেরাও বিপদে পড়ে যেতে পারে। মোট কথা, সামরিক সক্ষমতা দিয়ে ভারত এ অঞ্চলে তার আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হচ্ছে না। এখন নদীগুলোকে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেও যদি কার্যকর কোনো সুবিধা আদায় করতে না পারে, তাহলে বুঝতে হবে এতটুকুই তার ক্ষমতার দৌড়!

লেখক : পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার, পাকিস্তানের নেশন পত্রিকা থেকে ভাষান্তর এইচ এম নাজমুল হুদা