
ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগের স্থানীয় এক নেতার সঙ্গে ফোনালাপে শেখ হাসিনাকে বলতে শোনা গিয়েছিল যে তিনি যেকোনো সময় 'চট করে' দেশে ঢুকে পড়বেন। এ জন্য তিনি দিল্লিতে না থেকে বাংলাদেশের কাছাকাছি কোথাও আছেন বলে তাকে জানিয়েছিলেন। এরপর বিভিন্ন সময় ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেখ হাসিনার ফিরে আসার গুজব রটানো হয়। তবে সত্যটা হলো, শেখ হাসিনার দেশে ফেরা হয়নি।
এর পর বিভিন্ন সময় উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের দেশত্যাগ; এমনকি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস মারা গেছেন বলেও গুজব রটানো হয়। যেদিন খালেদা জিয়া উন্নত চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্যের উদ্দেশে যাত্রা করেন সেদিনও গুজব রটানো হয় যে তিনি আর দেশে ফিরতে পারবেন না।
ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে খবর ও 'টক-শো'র নামে কিংবা ইচ্ছামাফিক ভিডিও ও কনটেন্ট বানিয়ে এ ধরনের অপতথ্য ছড়ানো হচ্ছে। গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এটি নতুন মাত্রা পেয়েছে। দেশের বড় একটি অংশের মানুষ এ ধরনের 'খবরে' বিভ্রান্ত হচ্ছেন।
বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, এসব কনটেন্টের বড় একটি অংশই তৈরি করা হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে অপতথ্য ছড়ানোর উদ্দেশ্যে।
অনলাইনে তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান ডিসমিসল্যাবের এক প্রতিবেদনে বিষয়টি বিশদভাবে এসেছে। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, ইউটিউব কর্তৃপক্ষ এসবের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। সরকারের দিক থেকেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার নজির দেখা যায়নি।
আর দশটা সাধারণ ভিডিওর মতোই এসব ভুয়া ভিডিওতেও বিজ্ঞাপন দেখানো হয়। এর মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ 'ডলার' আয় করছে ইউটিউব। নিয়ম অনুযায়ী বিজ্ঞাপনের আয়ের একটি অংশ পাচ্ছেন এসব কনটেন্ট নির্মাতারাও। এতে দুই ধরনের লাভ হচ্ছে ভুয়া কনটেন্ট তৈরিতে জড়িতদের। প্রথমত, তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল হচ্ছে। বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী রীতিমতো সংগঠিতভাবে তাদেরকে দিয়ে এই কাজ করাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, যারা এসব কাজ করছেন তারা আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন।
উদ্বেগের ব্যাপার হলো যারা এসব ভুয়া খবরের ভিডিও দেখেন, ইউটিউবের 'অ্যালগরিদম' তাদের আরও বেশি করে এ ধরনের ভিডিও সামনে এনে দেয়। এর ফলে দর্শকরা অপতথ্যের অর্থাৎ ডিজিইনফরমেশনের এক গোলকধাঁধার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকেন। সত্য-মিথ্যার মিশেলে তৈরি করা ভিডিও সবচেয়ে বেশি ছড়াচ্ছে তুলনামূলক বেশি বয়সীদের মধ্যে; যারা অনেক ক্ষেত্রেই নির্ভরযোগ্য গণমাধ্যম থেকে তথ্য যাচাই করেন না।
ইন্টারনেটে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কনটেন্ট তৈরিকারী এই গোষ্ঠীগুলোকে বলা হচ্ছে 'বটবাহিনী'। মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িতদের ফাঁসির দাবিতে ২০১৩ সালে শাহবাগে আন্দোলন শুরু হলে তাদের প্রতিপক্ষ 'বাঁশের কেল্লা' গ্রুপ তৈরি করে সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয় হয়েছিল। পরে বিভিন্ন সময় নেতাকর্মীদের অনলাইনে সক্রিয়তা বাড়ানোর জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে আওয়ামী লীগের সহযোগী প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই)। অপতথ্য ছড়ায় এমন অনেক ওয়েবসাইট পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে এদের বিরুদ্ধে।
বর্তমানে ইউটিউবে অপতথ্যের ভিডিওগুলোকে মোটা দাগে দুই শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। এর মধ্যে একটি ক্যাটাগরি হলো 'ডিপ-ফেক'; অন্যটিকে বলা যায় 'চিপ-ফেক'। কিছু উদাহরণ দিলেই এই দুই ক্যাটাগরির মধ্যে পার্থক্যটা বোঝা সহজ হবে।
ইউটিউবে এমন অনেক ভিডিও ছড়ানো হয়েছে যেখানে শেখ হাসিনাকে সাক্ষাৎকার দিতে দেখা যাচ্ছে। ভিডিওগুলোতে তাকে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিতে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর শেখ হাসিনা এ ধরনের কোনো সাক্ষাৎকার দেননি। খণ্ড খণ্ড ভিডিও এবং এর সঙ্গে পুরোনো বক্তব্য জুড়ে দিয়ে এসব ভিডিও তৈরি করা হয়েছে। যেকোনো স্মার্টফোনে সাধারণ অ্যাপ দিয়েই এরকম ভিডিও তৈরি করা যায়। একটু সচেতনভাবে খেয়াল করলেই বোঝা যায় এগুলো ভুয়া। এ ধরনের ভিডিওকে বলা যায় 'চিপ-ফেক'।
অন্যদিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহায়তা নিয়ে তৈরি করা হচ্ছে 'ডিপ-ফেক' ভিডিও। এসব ভিডিওতে মানুষের কণ্ঠস্বর নকল করে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। সেই সঙ্গে যাকে কথা বলতে দেখা যাচ্ছে তার ঠোঁটের নড়াচড়া পর্যন্ত খাপ খেয়ে যাচ্ছে। যারা মানসম্মত দৈনিক সংবাদপত্র পড়েন না তাদের অনেকের পক্ষেও ডিপ-ফেক ভিডিও দেখে সত্য-মিথ্যা যাচাই করা সম্ভব হয় না। তারা এগুলোকে সত্য ঘটনা বা খবর হিসেবে ধরে নেন।
ইউটিউবে ছড়ানো ২৮৮টি ভিডিও পর্যালোচনা করেছে ডিসমিসল্যাব। অধিকাংশ ভিডিওতে মূল সাক্ষাৎকারের অংশগুলো প্রসঙ্গের বাইরে নিয়ে এমন বক্তব্য জুড়ে দেওয়া হয়েছে যা কখনোই ঘটেনি। প্রায় ৯০ শতাংশ ভিডিওতে বিজ্ঞাপন ছিল। এর অর্থ হলো, এসব ভিডিও থেকে কনটেন্ট নির্মাতারা এবং ইউটিউব উভয়ই আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন।
ফেক নিউজের জামানার বহু আগে থেকেই বিশ্বজুড়ে উদ্বেগের কারণ ছিল হলুদ সাংবাদিকতা। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ ও বিংশ শতাব্দীর শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রে সস্তা ধাঁচের এই সাংবাদিকতার উত্থান ঘটে। বিভ্রান্তিকর শিরোনাম, অতিরঞ্জিত গল্প, যৌন কেলেঙ্কারি, রোমহর্ষক অপরাধ নিয়ে কল্পনা মেশানো গল্প লিখে পাঠক ধরাই ছিল তখন মূল উদ্দেশ্য। এমনকি সাংবাদিকতায় বিশ্বের সবচেয়ে বড় পুরস্কারের সঙ্গে যার নাম জড়িয়ে আছে সেই জোসেফ পুলিৎজারের 'নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড' পত্রিকার বিরুদ্ধেও ছিল হলুদ সাংবাদিকতার অভিযোগ। সেই সময়ের নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড এবং নিউইয়র্ক জার্নাল-এর মধ্যে পাঠক ধরার অসুস্থ প্রতিযোগিতার বলি হয়েছিল সাংবাদিকতার বস্তুনিষ্ঠতা।
পুলিৎজারের জামানার একশ বছর পর এখন চলছে ডিজিটাল মিডিয়ায় 'ভিউ ও হিট' বাড়ানোর অসুস্থ প্রতিযোগিতা। আর এতেই বাড়ছে 'ভাইরাল' হওয়া কিংবা করার প্রবণতা। এর সঙ্গে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল হলো বাড়তি পাওনা।
গতকাল রোববার অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. মাহফুজ আলম বলেছেন, বাংলাদেশে যে গুজব–অপতথ্য আছে, সেটা শুধু সেন্ট্রালি বা ভারত থেকে আসে, এ রকম না। তিনি আরও বলেন, 'একটা অপতথ্য বা একটা মিথ্যা নিউজ শুধু একজন ব্যক্তির ক্ষতি করে না; বরং একটা সোসাইটির পুরো ফেব্রিকটা নষ্ট করে দেয় এবং বাংলাদেশে এটা শুরু হয়েছে।' (প্রথম আলো, ৪ মে ২০২৫)
একই অনুষ্ঠানে টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব নিজের আশঙ্কার কথা জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মিসইনফরমেশন-ডিজইনফরমেশন এবং সাইবার অপরাধ হবে আগামী নির্বাচন ঘিরে।
অন্তর্বর্তী সরকারের বয়স নয় মাস পেরুতে চললেও অপতথ্য ছড়ানোর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট আইন না থাকায় কার্যকর সরকারি উদ্যোগ নিতে দেখা যাচ্ছে না। কীভাবে এই প্রবণতা ঠেকানো যায় সে ব্যাপারেও সরকারের ভেতর কোনো আলোচনার কথা শোনা যায় না। এই পরিস্থিতিতে নাগরিকদের অপতথ্য থেকে সুরক্ষিত রাখতে একমাত্র ভরসা ব্যক্তিগত সচেতনতা। কিন্তু ডিজিটাল সচেতনতা বাড়াতে সরকার কতটা উদ্যোগী সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
আবু সাদিক: সাংবাদিক