
মারুফ কামাল খান
সারা বাংলাদেশ উত্তাল হয়ে উঠেছিল ১৯৭৭ সালে একটি দাবিতে—‘বাংলাদেশে পিস কোর আসতে দেব না।’ আওয়ামী লীগ থেকে শুরু করে বামপন্থি ও ইসলামিস্ট পর্যন্ত সবাই একাট্টা। চারদিকে মিটিং, মিছিল ও বিক্ষোভ। অভিযোগ, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের তল্পিবাহক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সরকার পিস কোর আনছে, দেশটা আমেরিকার হাতে তুলে দেবে।
পেছনের গল্পটা বলে নিই। ১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভারতের রাষ্ট্রপতি ফখরুদ্দিন আলি আহমেদ মারা যান। তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিতে আসেন যুক্তরাষ্ট্রের সদ্যনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের মা বিসি লিলিয়ান গোর্ডি কার্টার। তিনি তার নাতি অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট কার্টারের ছেলে চিপ কার্টারকে সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। এই সফরকালে লিলিয়ান কার্টার বোম্বাইয়ের কাছে ভিখরোলি এলাকায় যান। ওটি ছিল তার স্মৃতিবিজড়িত অঞ্চল। আমেরিকার স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা পিস কর্পস বা পিস কোরের একজন নার্স হিসেবে দুবছর তিনি ওই এলাকায় কাজ করে গিয়েছিলেন।
প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি এই পিস কোর প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬৬ সালে লিলিয়ান কার্টার ৬৮ বছর বয়সে ভলানটিয়ার হিসেবে যোগ দেন পিস কোরে। তারপর কোরের সদস্য হিসেবে ভারতে এসে দুবছর কাজ করে যান। নার্স হিসেবে লিলিয়ান সেখানকার হাসপাতালে অসাধারণভাবে দরিদ্র ও দুর্গত মানুষের সেবা করেন। মানুষ তাকে গভীর ভালোবাসায় মনে রেখেছিল। ১০ বছর পর তিনি ওই এলাকা সফরে গেলে সাধারণ মানুষ প্রবল আবেগে আচ্ছন্ন হয়ে তাকে বরণ করেন। প্রতিনিধিদলটির ওপর ফুলের পাপড়ি ও আবির ছিটানো হয়। আবেগাক্রান্ত নারীরা লিলিয়ানকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে থাকেন। সৃষ্টি হয় এক আবেগঘন দৃশ্য। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এসে তার সঙ্গে পৌনে এক ঘণ্টার বৈঠক করেন। তিনি প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠেন মার্কিন প্রেসিডেন্টের মায়ের। এরপর প্রেসিডেন্ট কার্টার নিজেও ভারত সফরে এসে ওই এলাকা পরিদর্শনে যান। ওই এলাকায় মায়ের কাজের স্মৃতিবিজড়িত দৌলতপুর নাসিরাবাদ গ্রামে পিস কোর মিশন পরিদর্শন করেন। সেখানে অনুদান হিসেবে টাকা ও টেলিভিশন সেট উপহার দেন। ভারতের তখনকার প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই মার্কিন প্রেসিডেন্টের সম্মানে দৌলতপুর নাসিরাবাদ গ্রামের নাম বদলে ‘কার্টারপুরী’ রাখেন। পরবর্তীকালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্ট কার্টারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বসূত্রে আবদ্ধ হয়েছিলেন। রাষ্ট্রপতি জিয়া জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগ দিতে গেলে প্রেসিডেন্ট কার্টার তাকে বিশেষ বিমানে করে নিউইয়র্ক থেকে হোয়াইট হাউসে নিয়ে গিয়ে অপরিমেয় মর্যাদা ও সম্মান দেন।
১৯৭৭ সালে ফখরুদ্দিন আলি আহমেদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন পূর্তমন্ত্রী অধ্যাপক ড. এমএ রশীদ। তিনি লিলিয়ান কার্টারের সঙ্গে দেখা করে তাকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান। লিলিয়ান কার্টার সে আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন এবং সুবিধাজনক সময়ে বাংলাদেশ সফরের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। ওই সময়টায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম। এপ্রিলে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তারপর লিলিয়ান কার্টার বাংলাদেশ সফরে আসার কথা ঘোষণা করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র থেকে জানানো হয়, পিস কোরের একটি টিমের নেতৃত্ব দিয়ে তিনি আসবেন বাংলাদেশে। জিয়ার সরকার এতে খুশি হয়, কারণ ১৯৭০ সালে মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে পিস কোর পাকিস্তান থেকে তাদের মিশন গুটিয়ে নিয়েছিল। বাংলাদেশে আবার পিস কোরের সেবা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে জিয়া সরকার আগ্রহ প্রকাশ করে। কিন্তু এর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে বিরোধী দলগুলো। তাদের উত্তেজনাপূর্ণ কর্মসূচির কারণে লিলিয়ান কার্টারের বাংলাদেশ সফর বাতিল হয়ে যায়। পিস কোরের ফিরে আসার সম্ভাবনাও স্থগিত হয়ে যায়। এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে রাষ্ট্রপতি জিয়া তার উপরাষ্ট্রপতি জাস্টিস আব্দুস সাত্তারকে পাঠান। লিলিয়ান কার্টার রাজি হন উপরাষ্ট্রপতিকে স্বাগত জানাতে। লিলিয়ান কার্টারের সঙ্গে দেখা করতে ১৯৭৭ সালের ২৯ আগস্ট জাস্টিস সাত্তার যান তাদের গ্রামের বাড়িতে। কার্টারদের বাড়ির পুকুরে আধা ঘণ্টার মতো সময় তারা মাছ ধরার চেষ্টা, আলাপচারিতা ও ফটো সেশনে কাটান।
এখন একটা মজার তথ্য দিই। মস্ত আন্দোলন করে পিস কোরের বাংলাদেশে আসা রোধ করতে আওয়ামী লীগ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। সেই পিস কোরকে বাংলাদেশে প্রথম নিয়ে আসে আওয়ামী লীগ। ১৯৯৮ সালের নভেম্বরে প্রাথমিক শিক্ষায় সহায়তা ও ইংরেজি শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য পিস কোরের ৩৫ স্বেচ্ছাসেবীকে প্রথমবারের মতো আনা হয় বাংলাদেশে।
এবার বলি ‘অপারেশন সি এঞ্জেল’-এর কাহিনি। বাংলাদেশ আর্মির সমর্থনে নব্বইয়ের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান সফল হলে জেনারেল এরশাদ সরকারের পতন ঘটে। এরপর সুষ্ঠু নির্বাচনে বিএনপি বিজয়ী হয় এবং খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হন। তবে তখনো রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি বহাল এবং পূর্ণ ক্ষমতা রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের হাতে। এ সময় ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল উপকূলে শতাব্দীর ভয়াবহতম ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। এতে প্রায় ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষ নিহত হয় এবং প্রায় এক কোটি মানুষ তাদের সর্বস্ব হারায়। ‘ম্যারি এন’ নামের ওই ঘূর্ণিঝড়ের কারণে তখনকার হিসেবে প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়। কর্ণফুলী নদীতীরের কংক্রিটের বাঁধ জলোচ্ছ্বাসে ধ্বংস হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের ১০০ টন ওজনের একটি ক্রেন ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে স্থানচ্যুত হয় এবং আঘাতের কারণে টুকরো টুকরো অংশে বিভক্ত হয়। বন্দরে নোঙর করা বিভিন্ন ছোট-বড় জাহাজ, লঞ্চ ও অন্যান্য জলযান নিখোঁজ ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার মধ্যে নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর অনেক জাহাজও ছিল। প্রায় ১০ লাখ ঘড়-বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কোটি মানুষ বাস্তুহারা হয়ে পড়ে।
খালেদা জিয়ার হাতে তখনো নির্বাহী ক্ষমতা আসেনি, তিনি নামকাওয়াস্তে প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু তাকেই শেখ হাসিনা আক্রমণের টার্গেট হিসেবে বেছে নেন। তিনি প্রচার করতে থাকেন, খালেদা জিয়া একটা কুফা মহিলা। তিনি নির্বাচিত হওয়ায় দেশে আল্লাহ্র গজব পড়েছে। তিনি খালেদা জিয়ার নাম দেন ‘তুফানি বেগম’। হাসিনা অভিযোগ করেন, ১০ লাখের বেশি লোক মারা গেছে, তাদের অনেকের লাশ দাফন না করে সরকার গোপনে পুড়িয়ে ফেলছে। এ সময় উপায়ান্তর না দেখে খালেদা জিয়া মার্কিন প্রশাসনের কাছে সহায়তার আবেদন করেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ডাকে সাড়া দেয় এবং এতে নৌ ও মেরিন সেনারা বিপুলভাবে অংশ নেওয়ায় এই সহায়তা কার্যক্রমে মূলত মার্কিন তৎপরতাই ছিল বেশি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশের আদেশ পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে দুর্যোগ ত্রাণসহায়তা কার্যক্রমের সবচেয়ে বড় এ ত্রাণ তৎপরতার নাম দেওয়া হয় ‘অপারেশন সি এঞ্জেল’।
মে মাসের ১০ তারিখ থেকে মার্কিন মেরিন, নৌ, সেনাবাহিনী ও ইঞ্জিনিয়ারদের সমন্বয়ে সাত হাজার সদস্যের টাস্কফোর্স বাংলাদেশে অবতরণ করতে শুরু করে। এর নেতৃত্ব দেওয়া হয় জাপানের ওকিনাওয়ায় অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটির থ্রি মেরিন এক্সপেডিশনারি ব্রিগেডের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল হেনরি সি স্ট্যাকপোলকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৌ-সেনাদের অ্যাম্ফিবিয়াস টাস্কফোর্স (এটিএফ) তখন ইরাকযুদ্ধে অংশ নেওয়ার পর বঙ্গোপসাগর হয়ে দেশে ফিরে যাচ্ছিল। তাৎক্ষণিকভাবে তাদেরও বাংলাদেশের সহায়তার জন্য বঙ্গোপসাগর থেকে ফিরিয়ে বাংলাদেশের চট্টগ্রামে পাঠানো হয়। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার যোগাযোগব্যবস্থা তখন বিধ্বস্ত। এ অবস্থায় স্বাভাবিক ত্রাণ তৎপরতা চালানো ছিল অসম্ভব। জেনারেল স্ট্যাকপোল দায়িত্ব নিয়ে চট্টগ্রামে এসে মেরিন হেলিকপ্টার ও দ্রুতগামী এলসিএসি (ল্যান্ডিং ক্র্যাফট এয়ার কুশন) উভচর যানযোগে প্রায় যোগাযোগবিচ্ছিন্ন সন্দ্বীপ, ভোলা, হাতিয়া, বাঁশখালী প্রভৃতি প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যাপক ত্রাণ ও উদ্ধারসামগ্রী পাঠাতে শুরু করেন। এ তৎপরতায় মার্কিন নেতৃত্বে অন্যান্য বিদেশি সহায়তাকারী জাপান, যুক্তরাজ্য এবং কেয়ার, অক্সফামসহ বিভিন্ন এনজিওকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয় তাদের কার্যক্রমের সঙ্গে। এবার শুরু হয় হাসিনার নয়া প্রোপাগান্ডা। তিনি বলতে শুরু করেন, খালেদা জিয়া মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কাছে দেশ বিক্রি করে দিয়েছেন। কারো সঙ্গে আলাপ ছাড়াই যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল সেনাবহর তিনি নিয়ে এসেছেন। তারা আর ফিরে যাবে না। তারা সেন্ট মার্টিন ও কক্সবাজার দখল করে স্থায়ী ঘাঁটি গেড়ে বসবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দিয়ে খালেদা জিয়া গোপন চুক্তি করেছেন আমেরিকার সঙ্গে।
১৯৯১ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় অনেক ঘটনাবহুলতার সৃষ্টি করেছিল। কর্তব্যে অবহেলার দায়ে সেসময়কার নৌবাহিনী প্রধান ও বিমানবাহিনী প্রধানকেও বরখাস্ত করা হয়েছিল। এতে হাসিনা প্রবল উৎসাহে তার গুজব ও অপপ্রচারকে পল্লবিত করে ছড়িয়ে দেন। কিন্তু অপারেশন সি এঞ্জেলের সাফল্যে প্রায় দুই লাখ মানুষের জীবন রক্ষা পায়। ত্রাণ, পুনর্বাসন ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের মাধ্যমে দুর্যোগ-পরবর্তী বিরূপ প্রতিক্রিয়া মোকাবিলা করা সম্ভব হয়। অপারেশন সি এঞ্জেলের সার্বিক তদারকি করেছিলেন সেসময়কার মার্কিন রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি মাইলাম। এই অভিযান নিয়ে এক স্মৃতিকথায় তিনি উল্লেখ করেন, ‘আজ পেছনে ফিরে তাকালে মনে হয়, বিপর্যয় যখন আসে, তখন মানুষই পারে তাকে বিজয়ে পরিণত করতে।’ অত্যন্ত সফলভাবে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে অপারেশন সি এঞ্জেল শেষ হয় এবং মার্কিন বাহিনী দেশে ফিরে যায়। এরপর ২০০৭ সালে সিডরের পরেও বাংলাদেশের আহ্বানে সাড়া দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র অপারেশন সি এঞ্জেল-২ পরিচালনা করে। তারাও ত্রাণ ও পুনর্বাসন কাজ সেরে দেশে ফিরে যায়।
রাখাইন মানবিক করিডোর দেওয়া নিয়ে দেশে এখন যে তোলপাড় চলছে, তাতেই পুরোনো দিনের ওই ঘটনাগুলো মনে পড়ে গেল। এই মানবিক করিডোর প্রস্তাব নিয়ে আমি আজই কোনো উপসংহার টানতে চাই না। তবে এর বিরুদ্ধে চলমান প্রচারণাটা আমার কাছে পুরোনো প্যাটার্নের বলেই মনে হয়। জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক এক অস্থির সময়ে রাখাইন মানবিক করিডোরের প্রসঙ্গটি বেশ স্পর্শকাতর। এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলসহ সব স্টেকহোল্ডারকে যুক্ত করে তথ্যভিত্তিক ও যুক্তিসংগত আলোচনা করে ঠান্ডা মাথায় জাতীয় স্বার্থের অনুকূলে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। এক্ষেত্রে ‘দশে মিলে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ’-ই হওয়া উচিত মোক্ষম কৌশল। সবাই মিলে ভুল সিদ্ধান্ত নিলে এবং তাতে হারলেও কোনো লজ্জা নেই সেই হারে। তবে এ বিষয়টা নিয়ে অনেকে যেভাবে রাজনীতি করছেন এবং খুব হালকা চটুল ভঙ্গিতে মানুষের আবেগ নিয়ে সস্তা খেলায় মেতেছেন, তাতে তাদের দেশপ্রেম ও সততা নিয়েই আমার মাথায় অনেক প্রশ্নের জন্ম হচ্ছে। আমি বিষয়টা যত ভালোভাবে বুঝতে চাইছি, তত বেশি বিভ্রান্ত হচ্ছি তাদের প্রচারণায়।
হাসিনার রেজিম ভারতকে ট্রানজিটের নামে করিডোর দিয়ে রেখেছে। এর আওতায় বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারত তার উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোয় বিনা চেকিংয়ে যেকোনো মালামাল পরিবহন করার অধিকার পেয়েছে। এই অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের জনগণের মনে ‘করিডোর’ শব্দটির প্রতি প্রবল স্পর্শকাতরতা তৈরি করেছে। তবে কোনো একটি দেশকে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে করিডোর দেওয়া এবং জাতিসংঘের ব্যবস্থাপনায় একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলের দুর্গত মানুষদের জন্য ত্রাণ সরবরাহের পথ খুলে দেওয়ার মধ্যে কতটা মিল ও গরমিল আছে, তা আমাদের আরো ভালোভাবে খতিয়ে দেখা দরকার।
মানবিক করিডোর দিয়ে আমরা গাজায় পরিণত হতে চাই না। প্রবল আবেগাক্রান্ত এমন বাক্য উচ্চারণের আগে আমাদের ভেবে দেখা দরকার—ইসরাইলি বর্বর হামলায় ধ্বংসোন্মুখ গাজার বিপন্ন মানুষের কাছে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছানোর জন্য মানবিক প্যাসেজ দেওয়ার কারণে কি গাজা আক্রান্ত হয়েছে, নাকি গাজা আক্রান্ত হওয়ার কারণে সেখানে যে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে, তা কিছুটা লাঘব করার জন্যই এই মানবিক করিডোরের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে? আমাদের ভেবে দেখতে হবে, প্রায় ১৫ লাখ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুর বোঝা আজ বাংলাদেশের কাঁধে। আমাদের ইচ্ছার বাইরে এবং আমাদের সংশ্লিষ্টতা ছাড়াই মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ উগ্র, সন্ত্রাসী ও সাম্প্রদায়িক কার্যকলাপ এই শরণার্থীর বোঝা আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে। নির্মোহ ও নিরাসক্ত থেকেও আমাদের এ দায় কাঁধে নিতে হয়েছে। এখন আমাদের একার পক্ষে এ সংকট নিরসন সম্ভব নয়। এ ইস্যুর আন্তর্জাতিকীকরণ ছাড়া কোনো সুরাহা নেই। আমরা হাত গুটিয়ে বসে থাকলে সেটা হবে না। জাতিসংঘ আমাদের যুদ্ধবিধ্বস্ত রাখাইনে বিপন্ন মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছাতে পথ খুলে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। এই প্রস্তাব আমাদের সংকটকে আন্তর্জাতিকীকরণের ক্ষেত্রে কোনো ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে কি না, তা সবাই মিলে ভালোভাবে যাচাই করে দেখা দরকার।
প্রতিটা পদক্ষেপেরই ঝুঁকি থাকে। সেই ঝুঁকি কতটা কীভাবে মোকাবিলার যোগ্য তাও খতিয়ে দেখতে হবে। একটি অঞ্চল যখন যুদ্ধে আক্রান্ত হয়, তখন কোনো একটি দেশ চাইলেই তার প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া থেকে মুক্ত থাকতে পারে না। তখন নিরপেক্ষতার নামে একঘরে হয়ে থাকা, নাকি সুবিধাজনক পক্ষ নেওয়াটা জাতীয় স্বার্থে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সে ব্যাপারেও খুব ভেবে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। আরাকান বা রাখাইন অঞ্চলে এখন সংকট আরো ঘনীভূত হয়েছে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তা তাতমাডো ওই অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। বিদ্রোহী আরাকান আর্মি সেখানে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। কাজেই বাস্তবতার আলোকেই বাংলাদেশের কূটনৈতিক যোগাযোগ আর একমাত্রিক রাখার উপায় নেই। সেই বিবেচনায় মানবিক প্যাসেজ কতটা সহায়ক হবে, সেটাও ভেবে দেখতে হবে। আরাকান সংকটে বাইরের দুই বড় অ্যাক্টর হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। অতি বাস্তববাদী চীন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মিয়ানমায়ের জান্তা সরকারের পাশাপাশি আরাকান আর্মির সঙ্গেও সংযোগ রাখা শুরু করেছে। আমাদের ওই দুই পরাশক্তির অবস্থান ও ভূমিকা বিবেচনায় রেখেই সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক