Image description

মুফতি এরফান শাহ্

 

রাজনীতি জাতীয় জীবনে গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। এর মাধ্যমে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালিত হয়। রাজনীতি মানে মানবসেবা ও জনকল্যাণে ভূমিকা রাখা। অসহায়, বঞ্চিত ও নির্যাতিতদের পক্ষে সোচ্চার হওয়া। সামাজিক নিরাপত্তা, জনগণের স্বার্থ সংরক্ষণ ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা।

বিগত পাঁচ দশক যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন, তারা জাতিকে সামাজিক নিরাপত্তা, ন্যায়বিচার, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক মুক্তি, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ও সুশাসন উপহার দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। তাই তো দেশে গণতন্ত্র, সুষ্ঠু নির্বাচন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য বারবার দরকার হয় অন্তর্বর্তী সরকারের। আর এজন্য অনিবার্য হয়ে পড়ে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মতো সর্বব্যাপী আন্দোলন, যাতে জীবন দিতে হয় শত-সহস্র মানুষকে।

দেশে ফ্যাসিবাদী ও স্বৈরশাসন প্রতিরোধের জন্যই রাজনৈতিক সংস্কার আজ টক অব দ্য কান্ট্রি। জনগণ এ কথা বুঝতে সক্ষম হয়েছে যে, নীতিহীন রাজনীতি দিয়ে জাতির কাঙ্ক্ষিত মুক্তি সম্ভব নয়। জাতি গতানুগতিক রাজনৈতিক দলগুলোর নীতি-আদর্শহীন রাজনীতির ব্যর্থতার গ্লানি আর বহন করতে রাজি নয়।

তাই জাতি এখন বিকল্প নেতৃত্ব খুঁজছে। জনগণ কাঙ্ক্ষিত মুক্তির লক্ষ্যে সৃষ্টিকর্তার দেওয়া শাশ্বত বিধান ইসলামের প্রতি ঝুঁকছে। এখন জাতির আশার আলো ইসলামি দলগুলো এবং তাদের ঐক্যবদ্ধভাবে জাতির নেতৃত্ব দিতে হবে। ওলামায়ে কেরামকে শক্ত হাতে রাষ্ট্রের হাল ধরতে হবে। ইসলামি রাজনীতির নির্মল বাতাসে গড়ে উঠবে ক্ষুধামুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত, অপরাধমুক্ত, নিরাপদ ও শান্তিময় বাংলাদেশ।

রাষ্ট্রকাঠামো তিনটি ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগ। সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে রাষ্ট্রের এ তিন অঙ্গের মধ্যে সমন্বয় করে তাদের নিজস্ব গতিতে স্বাধীনভাবে চলতে সহযোগিতা করা। তাহলেই কেবল মানবাধিকার, ন্যায়বিচার আর সুশাসন জাতিকে উপহার দেওয়া সম্ভব। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বিগত ৫৩ বছর আমরা দেখেছি, যারাই ক্ষমতায় এসেছে তারা দলীয় স্বার্থে একে একে ভিত্তির সব পিলার দলীয়করণের মাধ্যমে নিজেদের কব্জায় নিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছে।

এভাবে প্রশাসনে অযাচিত হস্তক্ষেপ, ক্ষমতার অপব্যবহার ও পক্ষপাতদুষ্ট আচরণে প্রশাসন দুর্বল ও অকেজো হয়ে পড়েছে। জননিরাপত্তা, সুশাসন, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার—এ বিষয়গুলোকে জাদুঘরে পাঠানো হয়েছে। সংবিধানে লেখা আছে, ‘আইনের চোখে সবাই সমান।’ অথচ বর্তমান বাস্তবতা হচ্ছে, কোনো অপরাধ যতক্ষণ পর্যন্ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল না হয়, ততক্ষণ প্রশাসনের ঘুম ভাঙে না। একদিকে দলীয় সাইনবোর্ড ব্যবহার করে অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে বড় দলের শক্তি প্রদর্শন করে সাইনবোর্ড লাগিয়ে ফ্যাসিস্টদের মতো চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি আর সাধারণ জনগণকে নির্যাতন আর হয়রানি করা হচ্ছে। উচ্চ মহল থেকে রেড সিগন্যাল না এলে দলীয় সন্ত্রাসী আর দলীয় অপরাধীরা গ্রেপ্তার হয় না।

এ কেমন রাজনীতি? এ কেমন সংস্কৃতি? শুধু গতানুগতিক একটি নির্বাচন দিয়ে জুলাই বিপ্লবের টার্গেট আর প্রত্যাশা পূরণ করা সম্ভব নয়। এ রকম নির্বাচন বিগত ৫৩ বছরে অনেক হয়েছে। জনগণ নির্বাচন নয়, সুশাসন দেখতে চায়। জনগণ দুর্নীতি নয়, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ও দেশ দেখতে চায়। অন্যথায় দেড় হাজার ছাত্র-জনতার জীবনদান আর ৩০ হাজার মানুষের গুরুতর আহত হয়ে চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে যাওয়া বৃথা যাবে। এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এ ধরনের কিছু হলে তা হবে শহীদদের আত্মার সঙ্গে গাদ্দারি! এজন্য জনগণ চায় অপরাধীদের বিচার আর কাঙ্ক্ষিত সংস্কার তারপর ভোটাধিকার। গতানুগতিক নির্বাচন প্রক্রিয়া দেশে ফ্যাসিস্ট তৈরিতে সহযোগিতা করেছে। এজন্য সংবিধান, বিচার ব্যবস্থা, নির্বাচন পদ্ধতি, পুলিশ প্রশাসন, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাসহ রাষ্ট্রকাঠামোর সব ক্ষেত্রেই যথাযথ সংস্কার অপরিহার্য।

জুলাই বিপ্লবের পর এখন দেখা যাচ্ছে, পতিত ফ্যাসিস্টদের অপকর্মগুলো করার দায়িত্ব এখন আরেকটি গোষ্ঠী গ্রহণ করেছে। গত কয়েক মাসেই তাদের নানা অপকর্মে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে দেশের মানুষ। অন্যদিকে বিচারহীনতার সংস্কৃতিই দেশে খুন-ধর্ষণ বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম কারণ। বিচারহীনতার এই সংস্কৃতি দূর করে অপরাধীকে বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যথায় জুলাই বিপ্লব অর্থহীন হয়ে যাবে।

দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে জনগণের উচিত হবে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সচেতন ও সতর্ক হওয়া। স্বীয় অবস্থান থেকে অন্যায়, অনিয়ম, চাঁদাবাজি ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা। পুলিশ বাহিনীকে পুনর্গঠন করে জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি। একইসঙ্গে বিচার বিভাগের সংস্কারের মাধ্যমে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। গডফাদার, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, দুর্নীতিবাজ ও অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে কঠোর হাতে দমন করতে হবে। সংস্কার প্রক্রিয়া তৃণমূল থেকে শুরু করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত স্বীয় দলে সংস্কার, শুদ্ধি অভিযান ও গণতন্ত্র চর্চা করা। অসৎ, অযোগ্য ও দুর্নীতিবাজদের বয়কট করা। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে দক্ষ, নিরপেক্ষ, অভিজ্ঞ, সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তোলা জরুরি। একইসঙ্গে অবাধ ও সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন ও সুশাসনের পথে যত ধরনের অন্তরায় আছে তা দূর করতে হবে।

পরিশেষে বলতে চাই, আমাদের সৌভাগ্য, একজন নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ, বিচক্ষণ, মেধাবী ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব প্রফেসর ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তার হাতকে শক্তিশালী করতে আমাদের সবাইকে তার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যেতে হবে। একতাই বল। সবাই মিলেমিশে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে।

এই দেশ আমাদের সবার। খুনি ও দুর্নীতিবাজদের বিচারে ও রাষ্ট্র সংস্কারে অন্তর্বর্তী সরকারকে পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে। যারা জুলাই বিপ্লবের গণহত্যাকারীদের বিচার আর সংস্কার বাদ দিয়ে আগে নির্বাচন চান, তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে জনগণ সন্দিহান! পক্ষান্তরে তারা পতিত ফ্যাসিস্টকেই সর্মথন করছেন। সংস্কার না হলে পরবর্তী সরকার আবার ফ্যাসিবাদ কায়েম করবে না, তার গ্যারান্টি কে দেবে?

লেখক : গ্রন্থকার ও গবেষক