
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অথবা ঢাকার কোথাও, শিবিরের আয়োজিত (না কি শিবিরের অন্য কোন ছুপা সংগঠনের আয়োজিত? যাউকগা, একই কথা) একটা ইফতার মাহফিলে টার্কিশ এক লোক এসে ইফতারের জন্য লাইনে দাঁড়ানো ছেলেপুলের হাতে পাঁচশ টাকার নোট দিচ্ছে, এটা নিয়ে ছাপড়িদলের ফইন্নিরা নাচতে শুরু করেছে। এইটা আমার কাছে এতোই ইনসিগনিফিকেন্ট যে ইভেন্টটা আসলে কি তা মন দিয়ে পড়িনাই, খুঁজে বের করিনাই, তাই জানিও না। বরং ছাপড়িদের নর্তনকুর্দন দেখাটাই মজা। কেউ বলতেছে ফিতরা দিতেছে। কেউ বলতেছে টাকা দিয়ে সমর্থন কিনতেছে। কেউ বলতেছে বিদেশী ফান্ড। ইত্যাদি ইত্যাদি। ওরে, তোরা বদন তুলে আরো নাচো তো দেখি। আর কি কি কারণ আছে তুমাদের ঝুলিতে?
ইসলামের একটা আনন্দময় দিক আছে। সমৃদ্ধতার অনুভূতি আছে। সেফুদা যাদেরকে গরিব ডাকে, সেই ফইন্নিরা এসব কোনদিন বুঝেনাই। বুঝবেও না। এরা ধর্ম সংক্রান্ত টাকার হস্তান্তর হওয়া মানেই মনে করে জাকাত সদকা, ফেতরা। ঈদের সময় অবশ্য কিছু পাঁচ টাকা দশ টাকা সালামি পায় এরা, কিন্তু ঐ সংস্কৃতিও এখন আগের মতো আর নাই।
নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলি। সউদি আরবে পড়তাম। রমজান মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে কোথাও গেলে যখন শুনতো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, অনেকেই টাকা দিতো। প্রথমে বুঝতাম না। প্রথমদিকে আমি নিজেই চিন্তা করেছিলাম, বাংলাদেশের মিসকিন মনে করে দিচ্ছে না কি? নিতাম না। তাদের মুখটা অন্ধকার হয়ে যেতো। তারপর জানলাম এইটা তাদের উপহারের সংস্কৃতি। বাংলাদেশী আমাকে যেমন দিতো। সাথে থাকা ফ্রেঞ্চ ক্লাসমেটকেও দিতো, অথবা সেনেগালিজ ক্লাসমেটকেও।
একবার রিয়াদের ন্যাশনাল পাবলিক লাইব্রেরিতে গেছি একটা দুর্লভ বই পড়তে। যে বইটা অন্য কোথাও নাই। আনা যাবে না, বসে বসে নোট নিচ্ছি। ঐ সেকশনের লাইব্রেরিয়ান ভদ্রলোক এসে দুই তিন মিনিট কথা টথা বললেন। তারপর একটা পঞ্চাশ রিয়ালের নোট আমার বুকপকেটে দিয়ে চলে গেলেন। প্রথমে বেকুব হয়ে গেলাম। তারপর খুশি হয়ে গেলাম। হ ছাপড়িদলের ভাইবোনেরা, ফেতরা নিছিলাম আর কি।
একদিন ফ্যাকাল্টির লাউঞ্জে দাঁড়িয়ে এক প্রফেসর টাকা দিচ্ছিলেন। লাইনে দাঁড়ানো আমাদের চেহারা দেখে তারপর টাকা গুনে দিচ্ছিলেন। আমার সাথে থাকা সউদি বন্ধু প্রতিবাদ করে বললো, আমাকে দিছেন একশ রিয়াল আর ওকে দিছেন দুইশো। স্যার হেসে দিয়ে বললেন, তুমারটাও ওকে দিয়ে দাও। ওর বাবা মা এখানে নাই, তোমার তো আছে। প্রতিদিন ইফতারের সময় আমরা বাইরে যেতাম বিভিন্ন এলাকায়। দেখতাম শিশু কিশোরদেরকে টাকা দিতেছে মুরুব্বীরা।
যাইহোক, ফইন্নিদেরকে এসব বুঝায়া লাভ নাই। যারা ফইন্নি না, তারা একটা জিনিস চিন্তা করতে পারেন। তুরস্ক সহ মধ্যপ্রাচ্য এমন কি আফ্রিকার এবং সাউথ এশিয়ার অনেক দেশের মুসলিমদের একটা সাধারণ ধারণা হলো হাসিনা ছিলো ইসলামের শত্রু। তারা সবাই মোটামুটিভাবে হাসিনার পতনকে ভালো একটা ঘটনা হিসেবে নিছে। আমার ধারণা সুতরাং টার্কিশ এই বুড়া হাসিনা-পরবর্তী বাংলাদেশে এসে মহব্বতের ঠেলায় আপনাদেরকে টাকা দিতে শুরু করেছে। সে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিতে চায়। মনের খুশি, রমজানের খুশি আপনাদের সাথে শেয়ার করতে চায়। কিন্তু কালচারাল সেনসিটিভিটি এবং লোকাল কনটেক্সট সম্পর্কে উনার কোন ধারণাই নাই। উনি জানেন না বাংলাদেশের ফইন্নিরা এই কাজটাকে কিভাবে নিবে।
সুতরাং প্লিজ আপনারা পারলে উনারে নিয়ে ঠান্ডা মাথায় বসে দুইটা জিনিস বুঝান।
এক নাম্বার বিষয় হলো বাংলাদেশের মানুষ দিতে চায় না, নিতে চায়। দেয়ার যে অনুভূতি, ঐটা তাদের ধাতে নাই। বরং যেমনে পারবে আর যা পারবে নিবে। এবং নেয়ার পর চৌধুরী সাহেব এইটা কেন দিলো, তার গোপন উদ্দেশ্য কি কি আছে তা নিয়ে গবেষণা করবে।
দ্বিতীয় বিষয় হলো বাংলাদেশের মানুষ ইসলামকে অত্যন্ত দুঃখিত, গম্ভীর, কট্টর এবং সদকা ফিতরা টাইপের একটা সিস্টেম মনে করে। ইসলাম হবে মসজিদের ইমাম সাহেবের নিরানন্দ ও কষ্টের জীবন। এইমাত্র একটা ভিডিও দেখলাম সেহেরির খাবার আসতে দেরি হচ্ছে দেখে ইমাম সাহেব মাইকে হুমকি দিচ্ছেন আজান দিয়ে দিবেন তখন কিন্তু সবার খাবার বন্ধ হয়ে যাবে। বেচারা। সুতরাং হাতে পাঁচশ টাকা পাইলে বাচ্চার মনে যে ফুর্তি আসে, তারপর সে ঐ টাকা দিয়ে যেসব অনৈসলামিক কর্মকান্ড সম্পন্ন করবে, এসব নাজায়েয কাজ এই দেশের লোকায়ত ইসলাম না। টাকা দিতে চাইলে দিবে। টেম্পুস্ট্যান্ডে তো না দিতে চাইলেও দিতে হবে। আর দিতে চাইলে গার্মেন্টস শ্রমিক, রিকশাওয়ালা ওদেরকে দিবে। বস্তিতে গিয়ে দিবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাংলাদেশে) কেন দিবে?
সুতরাং স্থানীয় সংস্কৃতি বিবেচনায় ছাপড়িদলের এইসব নর্তনকুর্দনমর্দন যুক্তিসঙ্গত।