
বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম দীর্ঘদিন ধরেই নানা সমস্যায় জর্জরিত। কখনও আর্থিক সমস্যা, আবার কখনও আসে মানকেন্দ্রিক সমস্যা। আর বিশেষ পক্ষের হয়ে সংবাদ পরিবেশনের ঢালাও অভিযোগ তো আছেই। সব মিলিয়ে প্রায় জগাখিচুড়ি অবস্থা। এসবের কারণ কী আসলে?
কোনো একটা সমস্যা যখন দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকে, তখন বুঝতে হয় যে, এর গোড়া বা শেকড় অনেক অনেক গভীরে। বাংলাদেশের সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতির নানাবিধ এমন শক্ত গোড়ার সমস্যার মতো দেশের সংবাদমাধ্যমের সংকটও ঢের গভীরে। এতটাই যে, শেকড় উপড়ে ফেলার জন্য টানাটানি শুরু করলে, শেকড় শুধু উঠতেই থাকে। শেষ আর হয় না!
সংবাদমাধ্যম আসলে কী বস্তু? স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সংবাদমাধ্যম বলতে আসলে কী বোঝায়? চলুন, আগে এই বিষয়গুলো একটু বুঝে নেওয়া যাক।
সংবাদমাধ্যম হচ্ছে সমাজ ও রাষ্ট্রে ঘটে যাওয়া নানা খবর প্রচারের একটি মাধ্যম। হ্যাঁ, সংজ্ঞায়নের সরলীকরণ করা হচ্ছে বটে। তবে সরল বিষয়টাই তো আমরা বেশির ভাগই বুঝি না। তাই আগে সরলভাবেই বোঝা যাক। আমাদের চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা ধরনের ঘটনা সংবাদমাধ্যমে উঠে আসে। এর ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণও প্রচারিত হয়। বিভিন্ন ঘটনার সমালোচনাও আসে। এবং এর মাধ্যমেই একটি সমাজ, রাষ্ট্র ও সরকারের একটি চিত্র জনগণের সামনে প্রস্ফুটিত হয়। মানুষ সংবাদমাধ্যমের আয়নায় পুরো দেশটা কেমন চলছে, তা বুঝতে পারে। একইভাবে শাসন বা ক্ষমতার কাঠামোটিও নিজেদের দোষ‑ত্রুটি বুঝতে পারে। এই প্রয়োজনীয়তাটি তৈরি হয় মূলত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার উদ্ভব ও বিকাশের পর। এর আগে ক্ষমতাকাঠামো সংবাদমাধ্যমের প্রয়োজনীয়তা খুব একটা উপলব্ধি করত না। কারণ, ক্ষমতা চালিত হতো একনায়কতান্ত্রিক উপায়ে, রাজবংশের দ্বারা। যখনই ক্ষমতায় গণের প্রতিনিধিত্বমূলক অংশগ্রহণের ধারণাটি আদরণীয় হওয়া শুরু করল, তখনই মূলত ক্ষমতায় গণের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে অধিষ্ঠিত হওয়া ব্যক্তিরা নিজেদের দোষ‑ত্রুটি খুঁজে পেতে তৎপর হয়ে ওঠেন। এই কারণেই স্বাধীন হওয়ার পর আমেরিকার গণতন্ত্রে সংবাদমাধ্যমকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল। অন্যান্য উন্নত দেশের গণতন্ত্রেও সংবাদমাধ্যমের একই ধরনের মর্যাদা ধরে রাখার চেষ্টা দেখা যায়।
সমস্যা তৈরি হয়, নামে মাত্র গণতন্ত্রের দেশে। বাংলাদেশও সেসব দেশের একটি। এসব দেশে সংবাদমাধ্যমকে কুক্ষিগত করার চেষ্টা করে নানা পক্ষ। ক্ষমতা ও ক্ষমতা সংশ্লিষ্টরাও তেমনি একটি গুরুত্বপূর্ণ পক্ষ। এর বাইরে থাকে নানা খাতের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট পক্ষ। আবার কখনও কখনও ক্ষমতা ও বিত্তের অংশ হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা থেকে সাংবাদিকেরাও একেকটি পক্ষ হয়ে ওঠে। বাংলাদেশে এই সবগুলো ঘটনাই ঘটে চলেছে ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায়। ফলে এ দেশের সংবাদমাধ্যমের পরিস্থিতিও অত্যধিক লেজে‑গোবরে।
প্রতীকী ছবিউন্নত দেশগুলোতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সংবাদমাধ্যম বলতে স্বাধীন ও নিরপেক্ষই বোঝায়। অন্তত সংজ্ঞাগতভাবে তো অবশ্যই। ইউরোপীয় ইউনিয়নে মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান দ্য সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন ফর ইউরোপ তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলছে, সাধারণত ‘মুক্ত সংবাদমাধ্যম’ বলতে বোঝানো হয় যে, সংবাদমাধ্যমগুলো সকল ধরনের সংগঠন, সংস্থা ও ব্যক্তির প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে তথ্যের প্রবাহ নিশ্চিত করে। এ ক্ষেত্রে তথ্য লুকানো হয় না এবং কারও পক্ষে তথ্যের একটি নির্দিষ্ট অংশকে উল্লেখযোগ্য করে তোলাও হয় না। বরং সংবাদের খাতিরে যেগুলো জনগণকে জানানো কর্তব্য, সেগুলোই জানানোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়। অর্থাৎ, জনতার নিমিত্তে একটি সম্পাদকীয় নীতি থাকে ওইসব মুক্ত সংবাদমাধ্যমের। বর্তমানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ‘মুক্ত’ ও ‘স্বাধীন’ সংবাদমাধ্যমকে সমার্থকভাবেই উল্লেখ করা হয়ে থাকে।
‘মুক্ত’ ও ‘স্বাধীন’ সংবাদমাধ্যম একটি দেশের সুশাসনের জন্য অতীব প্রয়োজনীয় এবং বাধ্যতামূলক একটি বিষয়। এটি নিশ্চিত করা গেলে জনগণের নিরপেক্ষভাবে তথ্য পাওয়া নিশ্চিত হয়। সেই সঙ্গে ক্ষমতাকে সঠিকভাবে প্রশ্নের মুখোমুখি করা, এর জবাবদিহি এবং ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তির ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে তদন্ত চালানো যায়। এসব জনসমক্ষে প্রকাশ করার কাজটিও করে থাকে ‘মুক্ত’ ও ‘স্বাধীন’ সংবাদমাধ্যম। ফলে এক ধরনের ভারসাম্য রক্ষিত হয় সমাজ ও রাষ্ট্রে। এতে করে জনতার অধিকার প্রকৃত অর্থে রক্ষা করা সম্ভব হয়।
বাংলাদেশের কী অবস্থা?
এতক্ষণ ‘মুক্ত’ ও ‘স্বাধীন’ সংবাদমাধ্যমের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা হলো। এবার দেখা যাক, বাংলাদেশের কী অবস্থা!
অবস্থা জানার ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যম সংশ্লিষ্ট কিছু সংস্থার দেওয়া সাম্প্রতিক আহ্বান সম্পর্কে অবহিত হওয়া যাক।
প্রতীকী ছবিবাংলাদেশে সাংবাদিকদের ওপর হামলা বাড়ছে উল্লেখ করে তা বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করা বৈশ্বিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স (আরএসএফ)। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি আরএসএফ তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ আহ্বান জানিয়েছে। বিবৃতিতে সংগঠনটি বলেছে, চলতি ফেব্রুয়ারির (গত মাস) শুরু থেকে বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ওপর গুরুতর হামলা বেড়েই চলেছে। পুলিশের পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালিয়েছেন। তাঁদের লাঠিপেটা ও হাতুড়িপেটা করা হয়েছে। কোনো কোনো গণমাধ্যমের বার্তাকক্ষকেও আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে। সংগঠনটি আরও বলছে, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর আশা দেখা দিয়েছিল যে, বাংলাদেশের সাংবাদিকদের নিরাপত্তার বিষয়ে অগ্রগতি হবে। কিন্তু সাংবাদিকেরা এখনো অরক্ষিত রয়ে গেছেন। তাঁদের ওপর নিয়মিতই হামলার ঘটনা ঘটছে।
ওদিকে আরএসএফ‑এর বিবৃতি দেওয়ার দিন তিনেকের মধ্যেই সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে) এক প্রতিবেদনে একই ধরনের উদ্বেগ জানিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্প্রতি দায়িত্ব পালনের জন্য সংবাদিকদের মারধর, হয়রানি ও ফৌজদারি তদন্তের মুখে পড়তে হয়েছে। বাংলাদেশে গণআন্দোলনের মুখে ক্রমে কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠা সরকারের পতনের ছয় মাস পরেও সাংবাদিকেরা তাঁদের কাজের জন্য হুমকি পাচ্ছেন এবং হামলার শিকার হচ্ছেন। একই সঙ্গে খসড়া পর্যায়ে থাকা দুটি অধ্যাদেশ আইনে পরিণত হলে তা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
মূলত এখানে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৫ এবং ব্যক্তিগত উপাত্ত সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৫–এর প্রকাশিত খসড়া নিয়েই উদ্বেগ জানিয়েছে সিপিজে।
এ নিয়ে সিপিজের এশিয়া প্রোগ্রামের সমন্বয়ক বেহ লিহ ই বলেন, সাংবাদিক এবং তাঁদের স্বাধীনভাবে সংবাদ প্রকাশের অধিকারের যে প্রতিশ্রুতি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার দিয়েছে, তা অবশ্যই পূরণ করতে হবে। প্রস্তাবিত যেসব আইন গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করতে পারে, সেগুলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সংশোধন করতে হবে। গণমাধ্যমের ওপর হামলার পেছনের অপরাধীদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। বেহ লিহ আরও উল্লেখ করেন যে, ‘শক্তিশালী সাংবাদিকতা ছাড়া গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারে না।’
আন্তর্জাতিক সংস্থার এসব প্রতিবেদন স্বাভাবিকভাবেই এ দেশে সাংবাদিকদের জন্য অত্যন্ত প্রতিকূল পরিস্থিতিরই জানান দেয়। দেশীয় সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনও একই কথা বলে। মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) থেকে পাঠানো সাম্প্রতিক ‘মানবাধিকার পরিস্থিতি মনিটরিং প্রতিবেদন ফেব্রুয়ারি, ২০২৫’‑এ বলা হয়েছে, দেশে সাংবাদিকদের প্রতি সহিংসতা আগের তুলনায় বেড়েছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে সাংবাদিকদের প্রতি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ২১টি, জানুয়ারিতে এমন ঘটনা ঘটেছিল ১৩টি। ফেব্রুয়ারি মাসে সাংবাদিকদের প্রতি সহিংসতার ঘটনায় নির্যাতন, হামলা, আহত, হুমকি ও হয়রানির শিকার হয়েছে ৩৮ জন সাংবাদিক। এই সময়ে মামলা বা গ্রেপ্তার হয়েছে একজন।
প্রতীকী ছবিঅর্থাৎ, এসব থেকে স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের সাংবাদিকেরা অত্যন্ত হুমকির মধ্যে নিজেদের দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। যদিও এ দেশে ব্যক্তি ও সংবাদমাধ্যমের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার সাংবিধানিকভাবে নিশ্চিত করা আছে। সংবাদমাধ্যমের আছে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিও। তারপরও ওপরের ঘটনাগুলো ঘটছেই। আর এমন প্রতিকূল পরিস্থিতিতেই এ দেশের সাংবাদিকতার আরও কিছু বাজে বৈশিষ্ট্য প্রকট হয়ে উঠছে। এই সমস্যা আগেও ছিল। নতুন হয়েছে এমনটা নয়। তবে বর্তমানে যেন এর কুপ্রভাবে জ্বালা বোধ হচ্ছে বেশি। কারণ, বর্তমান অস্থির পরিস্থিতিতে যে সংবাদমাধ্যমগুলোর সঠিক ভূমিকাই প্রয়োজন ছিল বেশি!
‘চালাই দ্যান’ বনাম ‘নামাই দ্যান’
এ দেশের সংবাদমাধ্যমগুলোতে দুটি কাজ সবচেয়ে বেশি হয়। এর মধ্যে একটি হলো–‘চালাই দ্যান’। এ‑সংক্রান্ত মিমস ও ট্রোলিং আমরা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে প্রচুর দেখেছি। এর মূল মাজেজাই হলো, যেকোনো কিছু পেলেই অনেক সংবাদমাধ্যম তা চালিয়ে দেয়। এ ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমের চিরাচরিত নীতি‑নৈতিকতার কিছুই মানা হয় না। এবং এই বৈশিষ্ট্য এ দেশের সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক হারে লক্ষ্যণীয়। মূলত ভিউ বাণিজ্যের প্রতি অতিরিক্ত আকর্ষণের কারণেই এমনটা হয়ে থাকে। আবার যেহেতু এ দেশের বেশির ভাগ সংবাদমাধ্যমের আনুষ্ঠানিক সম্পাদকীয় নীতি বলতে কিছু নেই, ফলে প্রকাশের অনুপযোগী অনেক কিছুই প্রকাশ হয়ে যায়। যেসব সংবাদমাধ্যমে এমনটা হয়ে থাকে, সেসব সংবাদমাধ্যমে একবার খোঁজ নিলেই দেখা যাবে যে, সেসব প্রতিষ্ঠানে প্রাতিষ্ঠানিক সম্পাদকীয় নীতি বলতে লিখিত কোনো দলিলের অস্তিত্ব নেই। অথচ একটি মানসম্মত সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্তই এটি।
এভাবে যেনতেন প্রকারে সংবাদমাধ্যম চালুর মূল কারণই হলো, এদের মালিক বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। তারা যতটা না সাংবাদিকতা করতে সংবাদমাধ্যম চালু করে, তার চেয়ে বেশি নিজেদের নানামাত্রিক স্বার্থ রক্ষা করতে চায়। এর মানে এই নয় যে, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো সংবাদমাধ্যম চালু করতে পারবে না। অবশ্যই পারবে। সারা বিশ্বেই তেমনটা হয়। তবে সেক্ষেত্রে মহৎ উদ্দেশ্যকে সামনে রাখা হয় এবং সেটি রক্ষার বন্দোবস্তও থাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে। আর আমাদের দেশে এই কথিত ‘মহৎ উদ্দেশ্য’ কেবলই একটি মুখোশ মাত্র। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মুখোশের আড়ালে অন্য খেলা চলে। ফলে ওইসব সংবাদমাধ্যম বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়। কিন্তু প্রতিষ্ঠান খুলে একটা ‘আলোড়ন’ তো প্রত্যাশা করেই উদ্যোক্তারা। আর্থিক চাকচিক্য লাভের চাপও থাকে। তাই দায়িত্বপ্রাপ্ত কতিপয় সাংবাদিকেরা এই ডিজিটালের যুগে শুরু করে দেন ‘ভিউ বাণিজ্য’। এ করতে গিয়ে যা খুশি, তাই নিউজ কনটেন্ট হিসেবে চালিয়ে দেওয়া হয়। আবার এভাবে সংবাদ প্রকাশের আসল উদ্দেশ্যই যখন নষ্ট হয়ে যায়, তখন আর সংবাদ হয়ে ওঠার নীতি‑নৈতিকতারও কেউ ধার ধারে না। সংবাদ তখন প্রস্তুত হয়, মানুষের ‘খাওয়ার’ ধরনের ভিত্তিতে। একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, এভাবে এ দেশে কিছু সংবাদমাধ্যম লাভের মুখও কিন্তু দেখেছে ও দেখছে। সেক্ষেত্রে গণরুচির ওপরও প্রবল সন্দেহ জাগে এবং প্রশ্ন উঠে যায়। দিনশেষে একটি দেশের জনতা যেমন, সে দেশের জাতীয় বৈশিষ্ট্যও তেমনি হয়!
প্রতীকী ছবিএই প্রক্রিয়াতেই ‘চালাই দ্যান’ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম। ভাইরাসটিকে আরও ভয়ঙ্কর করে তুলেছে প্রচণ্ড অপেশাদার নিউজ ইন্ডাস্ট্রি। যদিও একে ইন্ডাস্ট্রি বলা হলো, তবে ইন্ডাস্ট্রি হওয়ার মতো কোনো পূর্বশর্ত এ দেশের সংবাদমাধ্যমগুলো পূরণ করে বলে মনে হয় না। সাংবাদিকদের চাকরির নিরাপত্তা এ দেশে কচু পাতার উপরে টলটল করা পানির মতো। বেতনের কথা তুললে তো বৈষম্য আরও দৃশ্যমান হয়। ছাপা পত্রিকায় তাও অকার্যকর হলেও একটা ওয়েজবোর্ড আছে, যা আবার ৮০ শতাংশের বেশি প্রতিষ্ঠানই মানে না। আর ইলেকট্রনিক ও ডিজিটাল মাধ্যমে সেটিরও বালাই নেই। ফলে সব চলে কর্তাদের ইচ্ছেমাফিক। কোনো সরকারেরই এদিকে তেমন কোনো মনযোগ ছিল না কোনোকালে।
বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলো তাই চলে অনেকটা ‘বাপে খেদানো, মায়ে তাড়ানো’ অবস্থায়। অর্থনৈতিক সংকটের ফাঁক দিয়ে আরও প্রবল হয়ে ওঠে যোগ্যতা‑সংক্রান্ত সংকট। কারণ, আর্থিক নিরাপত্তা না থাকলে ক’জন আর শুধু প্যাশন থেকে সাংবাদিকতায় আসবেন বা থেকে যাবেন? এই ফাঁকে এ দেশে অনেকই সাংবাদিক বনে যায়, যাদের প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সঠিক সাংবাদিকতা করার মতো প্রশিক্ষণই নেই, থাকে না করার ইচ্ছাও। সাংবাদিকতা বস্তুটি আদতে কী, তা না জেনেই অনেকে সাংবাদিক হয়ে যান। তারা ফেসবুকের প্রোফাইলে নিজের নামের আগে ‘সাংবাদিক’ শব্দটি বসিয়ে বেশ আমোদও লাভ করেন। এবং এভাবে শুরু হয় ধান্দার খেলা। সেই ধান্দা আর্থিকভাবে হয়, রাজনৈতিকভাবে হয়। নির্লজ্জভাবে কারও পক্ষ নিতে বা দালাল হতে তখন আর এই কথিত সাংবাদিকদের বাধে না। ফলে ক্ষমতার মুখাপেক্ষী হয়ে শুরু হয় ‘নামাই দ্যান’!
ফাইল ছবি‘নামাই দ্যান’ অবশ্য দুই প্রকারের। একটি চলে সরাসরি ক্ষমতাকাঠামো দ্বারা। আরেকটি চলে এ দেশের সংবাদমাধ্যমের ভেতরের কাঠামোর ‘ধান্দা’ সংশ্লিষ্ট স্বার্থান্বেষী ও কিছু ক্ষেত্রে অযোগ্য সাংবাদিকদের মাধ্যমে। প্রথম ক্ষেত্রে, দেশে থাকা ক্ষমতাকাঠামোকে ব্যবহার করে সংবাদ নামিয়ে দিতে বলা হয়, তা সত্য হলেও। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, ওই ক্ষমতাকাঠামোর এজেন্ট হিসেবে কাজ করা সাংবাদিকেরা আগ বাড়িয়ে বা আদেশপ্রাপ্ত হয়ে একই কাজ করেন। আবার অনেক সময় স্বার্থসংশ্লিষ্ট কারণে (ব্যবসায়িক, আর্থিক বা অন্যান্য) এমনটা করা হয়। এ ক্ষেত্রে কখনো কখনো মালিকপক্ষের আদেশও মানতে বাধ্য হতে হয়। কিছু ক্ষেত্রে এসব ফ্যাক্টরের সঙ্গে যুক্ত হয় যোগ্যতা‑সংক্রান্ত জটিলতা। ফলে ‘চালাই দ্যান’ ঘরানার অনেক অযোগ্য নিউজ কনটেন্টের ক্ষেত্রে ‘নামাই দ্যান’ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।
উদাহরণ হিসেবে একটি সাম্প্রতিক ঘটনার উল্লেখ করা যাক। সদ্যই একটি সংবাদমাধ্যম দেশের শিক্ষা খাত নিয়ে দুর্নীতির একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। তাতে একজন ব্যক্তিকে মূলত ‘দোষী’ হিসেবে দেখানো হয়। কিন্তু যেসব মন্ত্রী পর্যায়ের ব্যক্তিদের মন্তব্য তাতে যুক্ত করা হয়েছিল, সেসব পরিবেশনার ধরন নিয়ে খোদ সংশ্লিষ্ট গণ্যমান্য ব্যক্তিরাই আপত্তি জানান। এরপর ওই সংবাদমাধ্যমটি একটি বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, ভুল থাকায় সংবাদটি প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে! আরও জানানো হয় যে, ওই দুই গণ্যমান্য মন্ত্রী পর্যায়ের ব্যক্তিদের একজনের মন্তব্য ভুলভাবে পরিবেশিত হয়েছে। আরেকজনের বিষয়ে যেখানে লেখা হয়েছিল মন্তব্য করতে অস্বীকারের কথা, তাঁর কাছে মন্তব্য চাওয়াই নাকি হয়নি! আর সবশেষে সংবাদমাধ্যমটি বলেছে, ওই প্রতিবেদনের প্রকাশ এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে যা যা ঘটেছে, সব নাকি ‘নিতান্তই ভুল বোঝাবুঝি’!
প্রতীকী ছবিএবার বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই, ‘চালাই দ্যান’ এবং ‘নামাই দ্যান’‑এর যুগলবন্দী কতটা ভয়ানক হতে পারে। সমস্যা হলো, আনুমানিক বাংলাদেশের কম‑বেশি ৭০ শতাংশের বেশি সংবাদমাধ্যম এভাবেই চলছে। শুধু এখন না, আরও আগে থেকেই। হ্যাঁ, বলতেই পারেন এই শতাংশের হিসাব কোত্থেকে পেলাম? কোনো জরিপ তো নেই। অভিজ্ঞতা ও অনুমানের মিশেল এখানে ঘটাতে হয়েছে বাধ্য হয়েই। কারণ, মানসংশ্লিষ্ট এসব বিষয় নিয়ে জরিপ করার প্রয়োজনীয়তাই যে এ দেশের সরকার বা অন্য কোনো সংস্থা কখনো অনুভব করেনি।
অথচ দেশের ৬৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ পাঠক গণমাধ্যমকে স্বাধীন দেখতে চান। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাম্প্রতিক এক জরিপে এ তথ্য জানা গেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের জন্য দেশজুড়ে এ জরিপ চালিয়েছে বিবিএস। তাতে দেখা গেছে, গণমাধ্যমকে নিরপেক্ষ বা পক্ষপাতহীন দেখতে আগ্রহী ৫৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ। এ ছাড়া ৩২ দশমিক ৬৮ শতাংশ সরকারি প্রভাবমুক্ত, ৩৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, ১৭ দশমিক ২৬ শতাংশ বস্তুনিষ্ঠ, ৩০ দশমিক ৫৭ শতাংশ সাধারণ নাগরিকদের চাহিদা পূরণে সক্ষম, ১৬ দশমিক ১৬ শতাংশ হলুদ সাংবাদিকতামুক্ত, ৯ দশমিক ৩১ শতাংশ ব্যবসায়িক প্রভাবমুক্ত এবং ৯ দশমিক ৫৮ শতাংশ আর্থিক প্রভাবমুক্ত গণমাধ্যম দেখতে চান বলে মত দিয়েছেন।
প্রতীকী ছবিএবার সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলের এসব নিয়ে ভাবার সময়। যতদিন নিজেদের পুরোপুরি পক্ষমুক্ত ও নির্মোহ হিসেবে গড়ে তোলা না যাবে, ততদিন কিন্তু বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের ‘চালাই দ্যান’ ও ‘নামাই দ্যান’ থেকে মুক্তি নেই। আর সেই মুক্তি না মিললে এ দেশের সাংবাদিকতার ভবিষ্যতও কেবল অন্ধকার থেকে আরও নিকষ কালোর দিকে ধাবিত হবে। সংশ্লিষ্টজনেরা এখন সংকট বুঝতে পারলেই হয়।
না বুঝলে আর কী! চলবে সেই দুষ্টচক্রই। একবার ‘চালাই দ্যান’, আরেকবার ‘নামাই দ্যান’!
লেখক: উপবার্তা সম্পাদক, ডিজিটাল বিভাগ, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন
[এই মতামত লেখকের নিজস্ব। এর সঙ্গে ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের প্রাতিষ্ঠানিক সম্পাদকীয় নীতিমালার কোনো সম্পর্ক নেই।]