
‘অন্তর্বর্তী’ শব্দটিই প্রমাণ করে যে এ সরকার কোনো বিধিবদ্ধ সরকার নয়। কোনো দেশ বা রাষ্ট্রে যখনই কোনো রাজনৈতিক বা সাংবিধানিক সংকট আসে, তখন এ ধরনের সরকার দিয়ে সংকটের সময় অতিক্রান্ত করেন সে দেশের শীর্ষজনরা। সাধারণত এসব সরকারের বিশেষ দায়-দায়িত্ব অথবা কর্তব্য নির্ধারিত থাকে। এক সরকার থেকে অন্য সরকার পর্যন্ত পৌঁছানোর বিশেষ মিশন তাদের থাকে। এ ধরনের সরকারের সুবিধা এই যে, এরা অনেকটা জাতীয় সরকারের মতো কাজ করতে পারে। সব মত ও পথের প্রতিনিধিত্ব এখানে থাকে। আবার উল্টো দিক থেকে চিন্তা করতে গেলে এরা নির্দিষ্ট দল, মত ও গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব না করায় বিশেষ বা আপৎকালীন সমর্থন শক্তভাবে লাভ করে না। যেহেতু সবার সম্মতির ভিত্তিতে সরকার গঠিত হয়, সাধারণভাবে সবার সম্মতিতেই তাকে চলতে হয়। তবে সবাইকে খুশি করে চলার কঠিন ও কৌশলী পথটি তাকে বেছে নিতে হয়। অন্তর্বর্তী সরকারে সম্মিলিত নেতৃত্ব (Collective Leadership) বৈশিষ্ট্য বিরাজমান থাকে। তবে কোনো বিশেষ গুণ বা বিশেষ জনপ্রিয়তা বা বিশেষভাবে সম্মানিত কোনো ব্যক্তি যদি এর প্রধান হন, তাহলে তার নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব অন্তর্বর্তী সরকারে প্রাধান্য লাভ করে।
এ ধরনের তত্ত্বকথা দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের বিষয়টি আলোচনা করা যায়। অনেক বিষয়-আশয় মীমাংসিত অথবা অমীমাংসিত হওয়ার পর এখন অন্তর্বর্তী সরকার যে সংকটের আবর্তে নিপতিত হয়েছে, তা দুই ধরনের। মোটাদাগে একে অভ্যন্তরীণ সংকট ও বহিস্থ সংকট-এ দুই ধরনের ব্যাখ্যা করা যায়।
ক. বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কর্তৃক রাজনৈতিক দল ঘোষণার প্রয়াস। অভ্যুত্থান-পরবর্তী পর্যায়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল সিভিল সোসাইটির একাংশ এবং ছাত্র আন্দোলনের কোনো কোনো নেতৃত্ব নানাভাবে নানা ধরনের রাজনৈতিক দল গঠনের বিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা চালায়। ছাত্রনেতা ও তাদের শুভানুধ্যায়ীরা অল্প সময়ের মধ্যেই এই প্রয়াসকে একটি প্রাথমিক সংগঠনে একীভূত করার প্রয়াসে সক্ষম হন। প্রথম থেকেই ছাত্রসমাজে রাজনৈতিক বক্তব্য প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে সুখকর মনে হয়নি। ছাত্র নেতৃত্ব দল গঠনে যতটা এগিয়েছে, ততটাই রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে বিরোধিতার মাত্রা বেড়েছে। কয়েকটি ক্ষেত্রে বিবৃতিযুদ্ধও পরিলক্ষিত হয়। এ বিষয়টি অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি করেছে। সরকারি দায়িত্বে নিয়োজিত ছাত্র উপদেষ্টারা বারবার এ কথা বলে রাজনৈতিক মহলকে আশ্বস্ত করতে চাইছেন যে, প্রস্তাবিত রাজনৈতিক দলটি কিংস পার্টি বা সরকারের মদতপুষ্ট কোনো দল হবে না। তারা যদি রাজনৈতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেন, তাহলে পদত্যাগ করেই করবেন।
জনগণের একটি বড় অংশ ছাত্রদের এই দল গঠনকে আশা-ভরসা হিসেবেই দেখছে। বড় বড় রাজনৈতিক দলের ভূমিকায় হতাশ এবং নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তে বিশ্বাসী বিপুলসংখ্যক সচেতন ও শিক্ষিত ব্যক্তি ছাত্রদের দলটির প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করছেন। তারা মনে করেন, আদর্শ, উদ্দেশ্য ও প্রদর্শিত স্বচ্ছ ছাত্র নেতৃত্বের মাধ্যমে রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি স্বকীয় ও স্বচ্ছ রাজনৈতিক ধারা সৃষ্টি হতে পারে। এরা আগামী নির্বাচনে ছাত্র নেতৃত্বের জয়ী হওয়ার ব্যাপারেও একটু বেশি আশাবাদী। এর বিপরীত মতটিও বেশ জনপ্রিয়। নাগরিক সাধারণের অন্য অংশ মনে করে যে, দল গঠনের মাধ্যমে ছাত্র নেতৃত্ব এত দিনের নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতা হারাবে। নির্বাচনে বিজয়ীর ব্যাপারেও তারা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে। ‘সরকার নামানো আর সরকার চালানো এক কথা নয়’-এ ধরনের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বের মনোভাব বোঝা যায়। বুদ্ধিজীবীদের একাংশ এই মত দিচ্ছে, ছাত্রদের রাজনীতি করার অধিকার আছে বটে, তবে এখন নয়। তাদের সংগঠিত থাকা উচিত। ঐক্যবদ্ধ থাকা উচিত ও ভবিষ্যৎ সরকারের পর্যবেক্ষণকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা উচিত। কেউ কেউ ছাত্রনেতাদের মর্যাদা ও নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। ভবিষ্যতে যাতে কোনো বৈরী সরকার তাদের প্রতি বিরূপ আচরণ না করতে পারে, তা নিশ্চিত হওয়া দরকার। এ বিষয়টি নিয়ে প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। এটি একটি স্থায়ী সংকট হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকারকে বিব্রত করবে।
খ. দ্বিতীয় যে বিষয়টি প্রফেসর ইউনূস সরকারকে বিতর্কিত করছে, তা হচ্ছে রাষ্ট্র সংস্কারের প্রসঙ্গ। অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য ব্যাপক ভূমিকা রাখতে চায়। তার কারণ, রাজনৈতিক দলগুলো অতীতে সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে রক্ষা করেনি। বস্তুত রাজনৈতিক সরকারের পক্ষে রাষ্ট্র সংস্কারের বিবিধ বিষয়ে সংবেদনশীলতা রয়েছে। সেই যে ১৯৭৪ সালে স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট প্রণীত হয়েছিল, আজও তা বহাল আছে। রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রতিশ্রুতি দেয়, পরে তা ভুলে যায়। ১৯৯০-পরবর্তী গণআন্দোলনের পর তিন জোটের একটি সম্মত সংস্কার প্রস্তাবনা গৃহীত হয়েছিল। তা কখনোই আলোর মুখ দেখেনি। আর সংস্কারের যে প্রস্তাবাবলি বিভিন্ন কমিশনে উপস্থাপিত হয়েছে, তা পর্বতসমান। নির্দিষ্ট সংখ্যা বলা সম্ভব নয়, তবে নিশ্চিতভাবেই জানুন এগুলো হাজার হাজার। এখানে বিবি তালাকের ফতোয়া থেকে রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত কোনো কিছুই বাদ যায়নি। সংবিধান সংস্কার হবে, নাকি নতুন করে লেখা হবে-তা-ও এক বিরাট বিতর্কের বিষয়। সংবিধানে ক্ষমতার ভারসাম্য বিধান, বিচার বিভাগের স্বতন্ত্রীকরণ, প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ এবং সংসদের উচ্চকক্ষের মতো মোটা দাগের বিষয় দৃশ্যত ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু পদ্ধতি ও প্রক্রিয়াগত বিষয়ে বিরোধ প্রবল। ছয়টি কমিশন তাদের সুপারিশমালা যা প্রকাশ করেছে, তা নিয়েই রীতিমতো হইচই। চারটি প্রদেশের কথা শুনে অনেকেরই মেজাজ খারাপ, আবার কেউ কেউ রাজধানী ঢাকার বোঝা কমানোর জন্য বিষয়টি সমর্থন করছেন।
গ. আরো যেসব বিষয়ে সংস্কার প্রস্তাবনা এসেছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে-নির্বাচন পদ্ধতি, সিভিল সার্ভিস, পুলিশ সংস্কার এবং পিএসসি, ইসি ও দুদকের মতো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনার বিষয়ে। এসব গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক মতৈক্যে পৌঁছা বিরাট জটিল ও কুটিল বিষয়। অন্তর্বর্তী সরকারের সদিচ্ছা থাকলেও শুধু মতবিরোধের কারণে ভালো ভালো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া এক ধরনের অসম্ভব হয়ে পড়বে। তা ছাড়া বাংলাদেশে মতাদর্শের যে সংঘাত চির প্রবহমান রয়েছে (ইসলাম, জাতীয়তাবাদ, বামধারা ইত্যাদি) তার একটি সমন্বয় ও ঐকমত্য অর্জন খুবই দুরূহ বিষয়। সরকারের অন্তর্গত আমলাতন্ত্রের সংস্কারে যে প্রস্তাবনা এসেছে, তা নিয়ে আমলাতন্ত্র বি-সদৃশভাবে বিভক্ত হয়েছে।
ঘ. পতিত স্বৈরাচারের বাহন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক বা নির্বাচনী অংশগ্রহণ প্রশ্নে প্রফেসর ইউনূসের সরকার নমনীয় ও আইনগত অবস্থান নিলেও এখন অবস্থাবিশেষে নতুন কথা বলছে। তখন আসিফ নজরুল আইনের ভাষায় কথা বলে বিব্রত হয়েছিলেন। এখন আওয়ামী নেত্রীর বক্তব্যের ক্ষোভে নতুন করে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার। প্রস্তাবনাটি গ্রহণ করলে জন-মন-ক্ষোভ হ্রাস পাবে, তবে কাছে ও দূরের শত্রু-মিত্রদের কাছে জবাবদিহির মাত্রা বাড়বে।
ঙ. অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে বিপদের বিষয় হচ্ছে আওয়ামী লীগ। সেদিন পতিত স্বৈরাচার যে ভাষায় বক্তব্য দিলেন, তা বারুদে আগুন দেওয়ার মতো জনমনে ক্ষোভ ও ক্রোধের সৃষ্টি করেছে। তারপর ৩২ নম্বরসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা ঘটেছে। গাজীপুরে একটি ঘটনায় আওয়ামী চক্রের দুঃসাহসের পরিচয় মেলে। গত শুক্রবার রাতে একদল বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা সাবেক মন্ত্রী মোজাম্মেল হকের বাড়িতে হামলা চালায়। এ সময় মসজিদের মাইকে মন্ত্রীর বাড়িতে ডাকাত পড়েছে বলে ঘোষণা দিয়ে লোকজনকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানানো হয়। মাইকিং শুনে আশপাশের লোকজন বাড়িটি ঘিরে ফেলে এবং ভেতরে অবস্থানকারী প্রতিবাদী ছাত্র-জনতাকে মারধর ও অপমান-অপদস্থ করে। এ সময় পুলিশ আক্রান্ত ছাত্র-জনতাকে উদ্ধারে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জোরালো প্রতিবাদের মুখে অবশেষে অপারেশন ডেভিল হান্ট ঘোষিত হয়। এদিকে আওয়ামী গুন্ডাদের হাতে একজন ছাত্রকর্মী গুলিবিদ্ধ হন। এটি প্রফেসর ইউনূসের সরকার জনগণের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ বলে বিবৃতি দিয়েছে। অবশেষে সরকার শেখ হাসিনার সহায়-সম্পত্তিসহ কোথাও হামলা না করার আহ্বান জানিয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের বহিস্থ সংকট দিল্লিকেন্দ্রিক। ভারত ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের ঘটনায় নিন্দা জ্ঞাপন করেছে। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘শেখ মুজিবুর রহমান যিনি দখলদার বাহিনী ও নির্যাতনে বাংলাদেশের মানুষের বীরোচিত প্রতিরোধের মূর্ত প্রতীক ছিলেন। তার ঐতিহাসিক বাসভবনটি যেভাবে ৫ ফেব্রুয়ারি ধ্বংস করা হয়েছে, তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। বিবৃতিতে আরো বলা হয়, সেই স্বাধীনতা সংগ্রাম বাংলার পরিচিতি ও গর্বকে লালন করেছিল। আর যারাই সে লড়াইকে মর্যাদা দেন, তারাই জানেন বাংলাদেশের জাতীয় চেতনার ক্ষেত্রে এ বাসভবনটির গুরুত্ব কতটা ছিল। এ হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা তীব্র নিন্দনীয়। এ বিষয়টি কেন্দ্র করে ঢাকা ও দিল্লিতে নিজ নিজ হাইকমিশনারকে তলব করার ঘটনা ঘটে। বিবৃতিটি মনোযোগ দিয়ে পড়লে দিল্লির হৃদয়ের ভাষা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
এসব অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও পাশের দেশের ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা করার রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সংকটে আবর্তিত অন্তর্বর্তী সরকার। এ ছাড়া বৈদেশিক অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের ব্যক্তিগত ইমেজ, নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এবং নতুন পরিবেশ-সহায়ক হয়েছে সত্য কিন্তু অভ্যন্তরীণভাবে দ্রব্যমূল্যের দাম যথার্থভাবেই নিয়ন্ত্রিত হয়নি। খাদ্য এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য এখনো লাগামহীন রয়েছে। শিল্প-কারখানাগুলোয় অস্থিরতা বজায় রয়েছে। সেখানেও আওয়ামী এবং প্রতিবেশীর হাত রয়েছে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করে। ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব অচিরেই সংকট সৃষ্টি করবে। প্রাথমিক সময়ের মতো না হলেও নিত্যদিন আইন ও শৃঙ্খলা বাহিনীকে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া প্রার্থীদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে। সামনে রয়েছে রমজান মাস। আসছে গরমকাল। রমজান মাসে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও গরমকালে বিদ্যুতের ব্যাপক চাহিদা পূরণ করতে না পারলে জন-অসন্তোষ বৃদ্ধি পাবে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো সন্তোষজনক নয়। বিভিন্ন জায়গায় চুরি-ডাকাতি ও ছিনতাই বেড়েই চলেছে। সবদিক বিবেচনা করলে অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক সংকট, অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও বৈদেশিক ষড়যন্ত্রের নানামুখী বিপদ-আপদ মোকাবিলা করছে। এসব সংকটের মোকাবিলায় অন্তর্বর্তী সরকার যথার্থ কার্যব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা করছে। রাজনৈতিক দলগুলো সংকটের গুরুত্ব অনুধাবন করবে এবং যথার্থ সহযোগিতার হাত বাড়াবেÑএটাই জনগণের প্রত্যাশা।