
বিবিসির কাদির কল্লোল লিখলেন, ‘ভাঙচুরের ঘটনার পর সরকারের ওপর দ্রুত নির্বাচনের চাপ আরও বাড়বে’। তার ধারণা, বিএনপি ও তার মিত্র দলগুলো এসব ঘটনার পর সরকারের ওপর নির্বাচনের জন্য চাপ বাড়াবে। কিন্তু একই দিন দেশের গণমাধ্যম বলছে, পুরো উল্টো কথা। গণমাধ্যম বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীকে উদ্ধৃত করে বলছে, ‘প্রতিবিপ্লব উঁকিঝুঁকি মারছে, সরকারকে ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না’।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলছেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি এখনো আস্থা রয়েছে’। মজার ব্যাপার হলো, কাদির কল্লোলের লিখা প্রকাশ পেলো ৮ জানুয়ারি। বিএনপি নেতৃবৃন্দও এসব কথা বললেন, ৮ জানুয়ারি। ‘মিসম্যাচ’ বলা যায় কাদির কল্লোলের ন্যারেটিভকে।
এই ন্যারেটিভই সৃষ্টি করার চেষ্টা চলছে। সাবেক পুলিশ ও মাফিয়া প্রধান বেনজীর আহমেদের একটি বক্তব্য ঘুরছে সামাজিক মাধ্যমে। যেটা এই ন্যারেটিভকে নগ্ন করে দিয়েছে। অর্থাৎ সমস্ত কিছু করা হচ্ছে বর্তমান সরকারকে ব্যর্থ করার জন্য। পরবর্তীতে অপ্রস্তুত বিএনপিকে ক্ষমতায় এনে পর্যুদস্ত করে পুনর্বার ফ্যাসিজমকে পুনর্বাসন করার আশায়। আরে ভাই, ‘দিল্লি দূর অস্ত’। অন্তত ফাঁস হওয়া কথোপকথন শুনেও তো বুঝতে পারেন, লুকিয়ে কোনো কিছু করা সম্ভব নয়।
বিবিসির আশা ছিল বিএনপিকে উস্কে দিয়ে পথে নামানো। কিন্তু সে আশাতেও গুড়ে বালি। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ৮ জানুয়ারিতেই বলেছেন, ‘ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অপ্রচার চালাচ্ছে আওয়ামী লীগ, জড়িত ভারতীয় গণমাধ্যম’। প্রায় একই সুরে একই দিন, একই অনুষ্ঠানে বলেছেন বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী। তিনি বলেছেন, ‘নির্লজ্জের মতো ভারতের মিডিয়া-সাংবাদিক বয়ান তৈরি করছে’। আমি এর আগে একটি লেখাতে বলেছিলাম, ‘দিল্লি না ঢাকা’ এই প্রশ্নে সারা বাংলাদেশ একদিকে। ঢাকার দিকে। সে শফিকুল আলম হন, রিজভী হন কিংবা হাসনাত-সারজিস।
নিজ দেশ থেকে জনতার প্রতিরোধের মুখে পালিয়ে আসা একটি দলের লোকজন আরেকটি দেশে বসে নিজ দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবে, এটা মেনে নেওয়া আন্তর্জাতিক নীতির বরখেলাপ। একজন দুজনকে আশ্রয় দেওয়া অন্য কথা, কিন্তু শত শত লোককে আশ্রয় দেওয়া এবং ষড়যন্ত্রের সুযোগ করে দেওয়া অসম্ভব রকম কূটনৈতিক সভ্যতা বিবর্জিত একটা ব্যাপার। এখানেই ক্ষান্ত নয় দেশটি, নিজেদের মিডিয়াকে সেই ষড়যন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রপাগান্ডা চালাতে দেওয়া সেই বাজে কূটনীতির আরেকটি দৃষ্টান্ত। সুতরাং প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এবং বিএনপি নেতা রিজভী’র বক্তব্য সেই সভ্যতা বিবর্জিত কূটনীতির বিরুদ্ধেই মূলত।
জনতার প্রতিরোধের মুখে পালিয়ে যাওয়া গাজীপুরের সাবেক মেয়রের যে কথোপকথন ফাঁস হয়েছে, তাতে তিনি বলছেন, মানুষকে রাতের বেলা ঘুমাতে দেবেন না। এই মানুষেরা কারা, বাংলাদেশের নাগরিক তো, নাকি? আপনারা অপকর্ম করেছেন, যার ফলে মানুষের ফুঁসে উঠেছে, অতঃপর পালিয়েছেন। সেই অপকর্মের জন্য ক্ষমা না চেয়ে, অনুশোচনা না করে। এই যে শত শত ছেলে নির্বিচার বুলেটে প্রাণ হারালো, পঙ্গু হলো, তাদের কাছেও তো ক্ষমা চাননি। না ক্ষমা, না অনুশোচনা, না আত্মগ্লানি, কিচ্ছু নেই। উল্টো রয়েছে মানুষের উপর প্রতিশোধ স্পৃহা, মানুষ যেন রাতে শান্তিতে ঘুমাতে না পারে। কী ভয়াবহ সাইকোপ্যাথিক চিন্তা। অবশ্য এ নতুন কিছু নয়। এর আগেও ঘরে চুড়ি পরে না বসে থেকে অন্যদের প্রাণসংহারের আদেশ দেয়া হয়েছিলো তাদের সুপ্রিমোর কাছ থেকেই। সুতরাং যারা দীর্ঘদিনের ঘটনা প্রবাহের দিকে নজর রাখেন তাদের জাহাঙ্গীরের আলাপে অবাক হবার কিছু নেই।
কিন্তু মুশকিল হলো ভারতীয় মিডিয়ার সাথে কিছু বাঙালের মিলে যাওয়া। আনন্দবাজারের সুরে বিবিসি বাংলার টিউন হওয়া। বাংলাদেশের কিছু মিডিয়ারও কৌশলী শব্দচয়নের মাধ্যমে পলাতকদের পক্ষে ন্যারেটিভ সৃষ্টি করার প্রয়াস। সাথে রয়েছে মিডিয়ার কথিত নিরপেক্ষ থাকার ভণ্ডামি। এই নিরপেক্ষতা গত দেড় দশকে কোথায় ছিল। তখন তো মিথ্যাকে সত্য বানাতে গণমাধ্যমের মাফিয়ারা মরিয়া ছিলেন। এখন কেন সত্যকে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতার ভান ধরার ভণ্ডামি! মূলত মিডিয়া ছিল গত দেড় দশকে ফ্যাসিজমের পক্ষে মত উৎপাদনের ক্ষেত্র। এখনো তাই রয়েছে। কিন্তু মানুষের চাপে ধরেছে নিরপেক্ষতার ভান। কারণ বুলডোজার চলার ভয় রয়েছে তাদের ওপরও। একটি মিডিয়া গত শুক্রবার রাতে গাজীপুরের ঘটনায় লিখলো, বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের উপর স্থানীয়দের হামলা-এমন একটা কিছু। অর্থাৎ এই শব্দচয়নে তারা বোঝাতে চাইলো, দোষটা বৈষম্যবিরোধীদেরই, সে কারণেই তাদের ওপর হামলা চালিয়েছে স্থানীয় মানুষ। কৌশলটা চিন্তা করেন। অথচ হওয়ার কথা ছিল উল্টোটা, বলার কথা ছিল বিপরীত বয়ান। অথচ সুকৌশলে পলাতকদের পক্ষে ন্যারেটিভ সৃষ্টির চেষ্টা করা হলো।
স্লিপার সেলের কথা বলে আসছি দীর্ঘদিন থেকেই। দেখবেন সরকার এবং দলগুলোর মধ্যে ফ্যাসিজমের সেই স্লিপার সেল সক্রিয়। সফট পাওয়ার সক্রিয়। তারা সেই পুরানো ন্যারেটিভকেই একটু ভিন্ন ঢংয়ে পরিবেশন করতে চাইছে। ‘আগে ভালো ছিল, কিন্তু এখন খারাপ হয়েছে, সুযোগ দিলে আবার ভালো হবে’- এই তাদের মূল ন্যারেটিভ। অর্থাৎ তাদের মূল লক্ষ্য হলো চব্বিশ জুলাই পূর্ববর্তী অবস্থা ফিরিয়ে আনা। যারা এই ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করছেন তাদের চিহ্নিত করা এই সময়ে সবচেয়ে জরুরি। সাথে স্লিপার সেল এর মূলোৎপাটনও ততোধিক জরুরি। মনে রাখবেন, এদের চিহ্নিত না করা গেলে, আবার আরেকটি জুলাই বিপ্লবের প্রয়োজন হবে। প্রাণ যাবে আরো অগণিত তরুণের-মানুষের।