বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কিংবদন্তী ও জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর দুবছর পূর্তি আজ। এই দুই বছর জুড়েই তার সৃষ্টিকর্মের কপিরাইট লঙ্ঘন নিয়ে লজ্জাকর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল বিভিন্ন চক্র। হুমায়ূন আহমেদের প্রায় সব বই-ই প্রায় বিনামূল্যে অনলাইন থেকে ডাউনলোড করা যাচ্ছে। হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের লেখস্বত্ব ক্ষুণ্ন করে বইগুলো বিনা অনুমতিতে বিভিন্ন ওয়েবসাইটে পুন:প্রকাশ করা হচ্ছে অহরহ। এতে বই ব্যবসায়ীদের মুনাফা অনেকগুণ হলেও রয়্যালিটি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন লেখকের স্বজন ও প্রকাশকরা। প্রকাশক কিংবা বৈধ উত্তরাধিকারীর অনুমতি ছাড়াই অনলাইনে হুমায়ূন আহমেদের বই প্রকাশের মহামারি দেখা দেওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সবাই।
কপিরাইট আইন অনুযায়ী, হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন, তার দুই পুত্র নিশাত, নিনিত, মা আয়েশা ফয়েজ এবং তার প্রথম স্ত্রী গুলতেকিন আহমেদের চার সন্তান নোভা, শীলা, বিপাশা ও নুহাশ তার সৃষ্টিসম্ভারের রয়্যালটির উত্তরাধিকারী হবেন। আর ২০০৫ সালে সংশোধিত কপিরাইট আইনে কপিরাইটের মেয়াদ স্রষ্টার জীবৎকাল ও তার মৃত্যুর পর ষাট বছর। হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে ছিলেন ৬৪ বছর আর লেখকজীবন ৪০ বছরের। ২৪ বছর বয়সে তিনি ‘নন্দিত নরকে’ লেখেন এবং পরের ৪০ বছরে তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৩৫০ ছাড়িয়ে গেছে। বিক্রি হয় বছরে প্রায় আড়াই থেকে তিন লাখ কপি। যা দেশে বিক্রি হওয়া মোট বইয়ের প্রায় ৭৫ শতাংশ।
বাংলাদেশের কপিরাইট আইন অনুযায়ী লেখকের মৃত্যুর দিন থেকে পরবর্তী ৬০ বছর তার বৈধ উত্তরাধিকারী বইয়ের রয়্যালিটি পাওয়া থেকে শুরু করে বই-সংশ্লিষ্ট সব সিদ্ধান্তের অধিকার রাখেন। অথচ মৃত্যুর মাত্র দু’বছর অতিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও জনপ্রিয় এই কথাসাহিত্যিকের ক্ষেত্রে কপিরাইট আইনের বাস্তবায়ন ঘটেনি।
হুমায়ূন আহমেদ মারা যাওয়ার পর থেকেই তার বইয়ের সত্ত্বাধিকার নিয়ে সৃষ্টি হয়েছিল নানান জটিলতা। তার মৃত্যুর পর প্রকাশকরা জানিয়েছিলেন, হুমায়ূন আহমেদের প্রায় সব বইয়ের চুক্তির মৌখিক, লিখিত কোনো দলিল নেই। এছাড়া প্রথমদিকের বেশিরভাগ উপন্যাসের স্বত্বাধিকারী হিসেবে লেখকের সাবেক স্ত্রী গুলতেকিন আহমেদের নাম রয়েছে। ‘কে কথা কয়’ সহ কয়েকটি উপন্যাসের স্বত্ব রয়েছে লেখকের নিজের নামে। শেষদিকের বড় কিছু উপন্যাস যেমন মধ্যাহ্ন ও বাদশাহ নামদারের স্বত্বাধিকারী হিসেবে দেখা যায় দ্বিতীয় স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওনের নাম। ফলে বইয়ের স্বত্ব ও প্রকাশনার উত্তরাধিকার বিষয়ে রয়েছে স্পষ্টতার অভাব।
হুমায়ূন আহমেদের যেহেতু দুই পরিবার, তাই এটা কীভাবে নির্ধারিত হবে— জানতে চাইলে সাবেক কপি রেজিস্টার মনজুরুর রহমান বলেন, এ ক্ষেত্রে আইন অনুযায়ী তার দুই পরিবার ও সন্তানরা সমান ভাগ পাবে। অপ্রকাশিত লেখার ক্ষেত্রেও একই নিয়ম। যদি লেখক নির্দিষ্ট করে কাউকে বা কে কত অংশ পাবেন তা নির্ধারণ করে না দিয়ে থাকেন, তাহলে একই নিয়ম প্রযোজ্য হবে। প্রচলিত আইন ও ইসলামী উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী তার স্ত্রী ও সন্তানসন্ততিরা এ ভাগ পাবেন। তা ছাড়া বই প্রকাশের ক্ষেত্রে সব উত্তরাধিকারীর অনুমতি ছাড়া বই প্রকাশ করলে তা আইনসঙ্গত হবে না। কিন্তু হুমায়ূনের বই প্রকাশের ক্ষেত্রে এ নিয়মের কোন বালাই নেই। কোনরকম অনুমতি না নিয়েই ব্যবসা করে যাচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা।
বইপ্রতি প্রায় ৪০ থেকে ৫০ লাখ টাকা সম্মানী পাওয়া এই লেখকের মৃত্যুর পর একাধিক স্বত্বাধিকারী থাকায় পুরনো বইয়ের নতুন সংস্করণের অনুমতি, উপন্যাস থেকে নাটক-সিনেমা বা অনুবাদের সিদ্ধান্ত এবং রয়্যালটিপ্রাপ্তির গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো থেকে গেছে অমীমাংসিতই। তবে হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের প্রকাশকরা জানান, হুমায়ূন পরিবারের সিদ্ধান্ত এবং আইনানুযায়ী বৈধ উত্তরাধিকারীকে লেখক রয়্যালিটির টাকা দেবেন। হুমায়ূন আহমেদের প্রকাশনার ব্যাপারে তার পরিবার হয়তো নির্ধারণ করে কাউকে মুখপাত্র ঠিক করবে, যার মাধ্যমে প্রকাশকদের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন এবং প্রকাশকরা তাকে রয়্যালিটি দেবেন।
এদিকে, মৃত্যুর কয়েক মাস পর, হুমায়ূন আহমেদের কোন বইয়ের কতটি প্রকাশনা কোন প্রকাশনীর কাছে আছে, তা জানতে চেয়ে ২৪ জন প্রকাশককে চিঠি দেন তার বড় মেয়ে নোভা। পরিস্থিতি সামাল দিতে হুমায়ূন আহমেদের পরিবারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের কপিরাইট আইন অনুযায়ী সৃষ্টি-সম্পদের উত্তরাধিকারী কে কীভাবে হবেন, রয়্যালটি বাবদ প্রাপ্ত অর্থ কীভাবে বণ্টন করা হবে তা নির্ণয়ের জন্য একজন আইনজীবী নিয়োগ করা হয়।
সাবেক কপি রাইটার রেজিস্ট্রার মনজুর রহমান জানান, হুমায়ূন আহমেদের ৬ সন্তান এবং স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন রয়্যালিটির টাকা পাবেন। এ ছাড়া মা আয়েশা ফয়েজ ছেলের রয়্যালিটির বৈধ উত্তরাধিকারী বলেও জানান এই বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, যদি হুমায়ুন আহমেদ লিখিতভাবে কাউকে বইয়ের স্বত্ব আগে দিয়ে থাকেন, তাহলে সেভাবেই চলবে। আর যদি লিখিতভাবে না দিয়ে থাকেন, সে ক্ষেত্রে একটু জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।
রয়্যালিটি পাওয়ার ক্ষেত্রে তিনি বলেন, যদি সময়ের কথা উল্লেখ না থাকে, তবে ৫ বছর পর সে চুক্তির আর কোনো মূল্য থাকবে না। কোনো বইয়ের প্রথম সংস্করণে একজনের নাম আবার দ্বিতীয় সংস্করণে অপরজনের নাম থাকলে দ্বিতীয় সংস্করণে যার নাম রয়েছে সে-ই বইয়ের রয়্যালিটি পাবেন বলেও জানান এই বিশেষজ্ঞ। মনজুর রহমান আরও জানান, হুমায়ূন আহমেদের অপ্রকাশিত বই প্রকাশ করতে গেলেও উত্তরাধিকারীদের সঙ্গে চুক্তি করতে হবে। আর চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে ছবির প্রযোজকই রয়্যালিটি পেয়ে থাকেন বলে তিনি জানান। মনজুর রহমান উল্লেখ করেন, সারা পৃথিবীতেই চলচ্চিত্রের পরিচালকরা কখনোই চলচ্চিত্রের মালিক হন না। সত্যজিৎ রায়ও পথের পাঁচালীর মালিক ছিলেন না, তিনি পরিচালক ছিলেন। যিনি অর্থ দিয়েছেন, প্রযোজনা করেছেন, তিনিই স্বত্বাধিকারী এবং রয়্যালিটির মালিক।
এদিকে পাঠক সমাজে বহুভাবে সমাদৃত হলেও হুমায়ূন আহমেদের বই অনলাইন থেকে প্রায় বিনামূল্যে পড়ার সুবিধা পাওয়ায় হুমায়ূন আহমেদের রচনাসম্ভারের লেখস্বত্ব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন না পাঠকরা। ফলে তাদের কাছ থেকেও নেই কোন উদ্যোগ ও সহযোগিতা। প্রিয় লেখকের প্রতি ভালবাসার কথা জানালেও তার রচনাকর্মের কপিরাইট আইন মানছেন না কেউই। আর এরই ফায়দা লুটছে অসাধু বই ব্যবসায়ীরা। হুমায়ূনের সৃষ্টিকর্মের এমন হরিলুট এবং তা নিয়ে পাঠকসমাজের ঔদাসীন্য হয়তো এটাই প্রমাণ করে, অসাধু ব্যবসায়ীদের হাতে পুনর্বার অপমৃত্যু ঘটছে হুমায়ূন আহমেদের।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন