ক্যানসার রোগীদের মর্মস্পর্শী যন্ত্রণাকে পুঁজি করেও চলছে অনিয়ম। মরফিন ট্যাবলেটের ইচ্ছামতো দাম আদায় করছে এক শ্রেণির ফার্মেসি। চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া বিক্রির অনুমতি না থাকলেও, ফার্মেসি থেকেই তৈরি করে দেয়া হচ্ছে প্রেসক্রিপশনও। একইসঙ্গে মাদকাসক্তদের কাছে চড়া দামে বিক্রি করায় প্রকৃত রোগীরা সহজে পাচ্ছেন না জীবন রক্ষাকারী এ ওষুধ।
মরফিন সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় ক্যানসার রোগীদের জন্য। ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ৯০ ভাগ রোগীই তীব্র মাত্রায় ব্যাথার যন্ত্রণায় ভোগেন। আর যখন কোনো ওষুধই শরীরে কাজ করে না, তখন চিকিৎসকরা রোগীকে ব্যাথা থেকে মুক্তি দিতে মরফিন নামের এই জীবন রক্ষাকারী ওষুধ দিয়ে থাকেন।
রোগীর মৃত্যু অবধারিত জেনেও স্বজনদের চেষ্টা থাকে মরণব্যাধি এই রোগে আক্রান্ত মৃত্যু পথযাত্রী স্বজনের যন্ত্রণা যতটা সম্ভব নিয়ন্ত্রণে রাখার। তবে এই মরণব্যাধি রোগের ওষুধ নিয়েই চলছে ভয়াবহ জুলুম। ক্যানসারের ব্যথা উপশমের এই মরফিন কিনতে হিমশিম খাচ্ছে রোগীদের পরিবার।
ক্যানসার আক্রান্ত ৬৬ বছরের আব্দুস সালাম ভূঁইয়া। চিকিৎসা নিচ্ছেন রাজধানীর জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে। সব সময়ই ভোগেন মাঝারি থেকে তীব্র মাত্রার ব্যথায়। যন্ত্রণা কমাতে নিয়মিত দরকার মরফিন।
দীর্ঘস্থায়ী ব্যাথা, হার্ট অ্যাটাকের রোগী, এইডস রোগী, বড় ধরনের অস্ত্রোপচার- যেমন ওপেন হার্ট সার্জারির মতো রোগীর ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় মরফিন। ট্যাবলেট, সিরাপ ও ইনজেকশন- এই তিনভাবে ব্যবহৃত হয় মরফিন। কিন্তু রাজধানীর পান্থপথ ও শাহবাগের বেশ কয়েকটি ওষুধের দোকানে মরফিনের খোঁজ করা হলে সবাই জানান, কারও কাছেই নেই গুরুত্বপূর্ণ এই ওষুধ।
এক ফার্মেসির কর্মচারী বলেন,
আমরা মরফিন বিক্রি করি না। এগুলো বিক্রি করতে লাইসেন্স লাগে। আমাদের লাইসেন্স নেই। তাই আমরা বিক্রি করতে পারি না।
তবে রাজধানীর গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালসে ছদ্মবেশে মরফিন কিনতে গেলে প্রথমে স্টক আউট বলা হলেও পরে এক কর্মী জানান, ১৪০ টাকার এক পাতা জি-মরফিন কিনতে হলে গুনতে হবে দেড় হাজার টাকা। এমনকি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন থাকার পরও জোর করেন তাদের ফার্মেসির চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন নিতে।
গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালসের এক কর্মী বলেন, ডাক্তারের ভিজিট ১ হাজার টাকা। মরফিন এক পাতা ৫০০ টাকা। মোট দেড় হাজার টাকা।
কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই সময় টিভির ক্যামেরার সামনে এসব কিছুই অস্বীকার করেন তারা। অন্যদিকে বর্তমানে দেশে ২টি মরফিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের অন্যতম ইউনিমেড-ইউনিহেলথ ফার্মাসিউটিক্যালস। সরকারনির্ধারিত মূল্যে মরফিন বিক্রি করলেও তারাও বলছেন, কোনো ক্রেতার প্রেসক্রিপশন না থাকলেও তাদের অনুমোদিত চিকিৎসকের মাধ্যমে ব্যবস্থা করে দেয়া হয় প্রেসক্রিপশনের।
রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি বেশ কটি হাসপাতালে ক্যানসার চিকিৎসা নেয়া বেশ কয়েকজন রোগী ও তাদের স্বজনরা জানান, সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে দেয়া হলেও, বাইরের ফার্মেসিতে দুই থেকে তিনগুণ দামে কিনতে হচ্ছে এই মরফিন।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, একজন ক্যানসার রোগী ছাড়া সাধারণ কোনো ব্যক্তি মরফিন খেলে আসক্তি তৈরি হয়। তাই সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের উল্লেখিত ব্যবস্থাপত্র ছাড়া কোনভাবেই বিক্রির অনুমতি নেই।
জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের বিভাগীয় প্রধান ডা. নাজরিনা খাতুন সময় সংবাদকে বলেন,
প্রেসক্রিপশনে সিল থাকতে হবে। সেইসঙ্গে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) নিবন্ধন থাকতে হবে। যে কেউ একটা প্রেসক্রিপশন নিয়ে গেলেই দেয়া যাবে না। আর প্রেসক্রিপশন ছাড়া তো অবশ্যই দেয়া যাবে না।
অনেকেই মরফিনকে মাদক হিসেবে নেয়ায় বাজারে এই সংকট তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর বলছে, কোনো ধরনের অনিয়ম পেলে তাদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সার্বিক বিষয়টা দেখেই কোনো রোগীর ডাক্তার তাকে প্রেসক্রিপশনটা দিয়ে থাকেন। রোগীর পরিস্থিতি বিবেচনা করেই ওষুধটা লিখেন। কিন্তু ওই রোগী সম্পর্কে তো ফার্মেসিতে বসা ডাক্তার দিতে পারবেন না। সেটা দেয়ার তো কোনো সুযোগই নেই।
একটি দেশ বছরে কতটা মরফিন ব্যবহার করতে পারবে, তার পরিমাণ নির্ধারণ করে আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল নার্কোটিকস কন্ট্রোল বোর্ড। আর দেশে মরফিনের উৎপাদন ও ব্যবহারের ওপর নজরদারি করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর।
এদিকে দেশে ক্যানসারের তীব্র মাত্রার ব্যাথায় ভোগা রোগীদের সংখ্যা ছয় লাখের কোঠা ছাড়ালেও কত রোগীর মরফিনের দরকার, তার সুনির্দিষ্ট সংখ্যা কারও কাছেই নেই।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন