এ মৌসুমে ডেঙ্গুতে এখন পর্যন্ত এক লাখের বেশি আক্রান্ত ও পাঁচ শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে– সরকারি হিসাবে এমনটি বলা হলেও বাস্তবে আক্রান্ত ও মৃত্যু অনেক বেশি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিয়ে আছে নানা প্রশ্ন। মশা নিধন কার্যক্রমে দুর্নীতি-জালিয়াতিরও অভিযোগ উঠছে
রাজধানীতে চলতি বছরের শুরুতেই মাথাচাড়া দেয় ডেঙ্গু। দিন যত গড়িয়েছে, ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে ভাইরাসটি। তবে গত আট মাসেও বাসিন্দাদের সচেতন কিংবা তাদের পাশে দাঁড়াতে দেখা যায়নি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১০ নম্বর ওয়ার্ড (মতিঝিলের একাংশ) কাউন্সিলর মারুফ আহমেদ মনসুরকে। অন্যদিকে, বেঘোরে মানুষ আক্রান্ত হলেও এলাকাবাসীর কাছে ‘ডুমুরের ফুল’ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৫৩ নম্বর ওয়ার্ড (উত্তরখান) কাউন্সিলর মো. শফিক।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হত্যা মামলায় সম্প্রতি মারুফ জেলে গেছেন। আর স্বর্ণ চোরাচালানের অভিযোগে আড়ালে-আবডালে শফিক। তাদের মতো সারাদেশেই স্থানীয় সরকারের বেশির ভাগ জনপ্রতিনিধি ডেঙ্গুবাহী মশা নিধনে জনগণকে সচেতন করতে মাঠে নামেননি। পাশাপাশি আরও যেসব ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার এ বিষয়ে দায়িত্ব, তাদের কার্যক্রমে গাফিলতি স্পষ্ট। সিটি করপোরেশনের মেয়ররা মাঝেমধ্যে সক্রিয় হয়েছেন। ভ্রাম্যমাণ আদালত লার্ভা শনাক্তের পর জরিমানায় দায় সেরেছে। মশা নিধনে ভুল পদ্ধতির সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় দুর্বলতার কারণে এবার ডেঙ্গুর এত বাড়বাড়ন্ত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও মশক বিশেষজ্ঞ ড. কবিরুল বাশার সমকালকে বলেছেন, এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে এবার বড় দুর্বলতা হলো, জনগণকে সম্পৃক্ত করতে না পারা। রাজধানীতে তাও কিছু পদক্ষেপ হয়েছে; ঢাকার বাইরের অবস্থা যাচ্ছেতাই। ঈদুল আজহা উপলক্ষে বিপুলসংখ্যক মানুষ ঢাকা থেকে গ্রামে গেলেন। এর পরই জেলা-উপজেলা পর্যায়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত বেড়ে গেল। তিনি আরও বলেন, এতদিন এডিস মশাকে ‘মৌসুমি’ হিসেবে দেখা হলেও বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে আর সে সুযোগ নেই। সত্যিকার অর্থে, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন সেবা সংস্থা ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অঙ্গ প্রতিষ্ঠানগুলোর যে ধরনের কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার কথা, তা নেওয়া হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন পরিচ্ছন্নতার কাজে জনগণকে সম্পৃক্ত করা। এ ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা রাখতে পারেন জনপ্রতিনিধিরা। কিন্তু বেশির ভাগ জনপ্রতিনিধির মধ্যে এ বিষয়ে আন্তরিকতার ঘাটতি দেখা গেছে। অন্যদিকে, রাজধানীর নির্মাণাধীন স্থাপনাগুলোকে মশার বংশ বিস্তারের আধার বলা হলেও এখানে কার্যক্রম সঠিকভাবে মনিটর করা হয়নি। রাজউক, গণপূর্ত, গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও ওয়াসার মতো সেবা সংস্থাগুলোর তেমন তৎপরতা চোখে পড়েনি। থানায় থানায় জব্দ গাড়িতে মশা গিজগিজ করলেও বেখবর পুলিশ। ফলে এবার বাহিনীর রেকর্ড সংখ্যক সদস্য আক্রান্ত হয়েছেন; মারা গেছেন চারজন।
জানতে চাইলে ডিএনসিসির উপপ্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা লে. কর্নেল গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘বছরের শুরুতে রিহ্যাবকে সতর্ক করে চিঠি দেওয়া হয়। অথচ সংগঠনটির সদস্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নির্মাণাধীন স্থাপনায় অহরহ লার্ভা মিলছে। তারাও যে সক্রিয় নয়, তা স্পষ্ট।’ এ বিষয়ে ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির বলেন, ‘মে মাসে মেয়র রাজধানীর সব সেবা সংস্থা ও রিহ্যাবের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে নিজ অবস্থান থেকে সবাই মশা নিয়ন্ত্রণের প্রতিশ্রুতি দেন। তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলে তো এখন নির্মাণাধীন ভবনে লার্ভা পাওয়া যেত না।’
নিধিরাম সর্দার স্থানীয় সরকার
মশা নিয়ন্ত্রণে দেশের ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও উপজেলা পরিষদের মতো স্থানীয় সরকারগুলো ঢাল-তলোয়ারবিহীন নিধিরাম সর্দার। মশা নিয়ন্ত্রণে যেসব সরঞ্জাম ও জনবল দরকার, তাদের কাছে এর ছিটেফোঁটাও নেই। ফলে ২০১৯ সালের মতো এবারও সব জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়েছে।
এ বিষয়ে ডা. ফজলে শামসুল কবির বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমরাও চিন্তিত। প্রতিদিন ঢাকায় যেসব রোগী দেখছি, তাদের বড় অংশ আসছেন মফস্বল থেকে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সরবরাহ করা তালিকার রোগীর আক্রান্ত হওয়ার উৎস খুঁজলে দেখা যাবে এক-তৃতীয়াংশই ঢাকার বাইরের। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মতো বাইরেও সক্রিয়ভাবে কাজ না করলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না।’
মশক বিশেষজ্ঞ ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের হাতেই তো প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নেই। তাহলে জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়নে কীভাবে থাকবে? পৌরসভায় দু-একটি ফগার মেশিন থাকলেও রুটিন মতো এগুলো দাগানোর লোক নেই। উপজেলা পর্যায়ে তো কিছুই নেই। তাহলে কীভাবে মশা নিয়ন্ত্রণ হবে?’
এমন প্রেক্ষাপটে গতকাল শনিবার রাজধানীর বাসাবো কালীমন্দির সংলগ্ন এলাকায় মশক নিধনে জনসম্পৃক্ততা কার্যক্রমে অংশ নিয়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস সাংবাদিকদের জানান, ডেঙ্গু প্রতিরোধে নিজস্ব স্থাপনা, বাড়ি, আঙিনা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা এবং ডেঙ্গুর বংশবিস্তার উপযোগী পরিবেশ নষ্ট করা নগরবাসীর নাগরিক দায়িত্ব। ১০ জনের বেশি ডেঙ্গু রোগী পেলে সেসব ওয়ার্ড লাল চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এবং সফলতাও এসেছে। মশার প্রজননের আধার বিনষ্ট করাই লক্ষ্য, এ কাজে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে কার্যক্রম নেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
ভুলের বৃত্তে মশক নিধন পদ্ধতি
দীর্ঘদিন ধরে ভোরে লার্ভিসাইটিং (লার্ভা নিধনকারী ওষুধ স্প্রে) ও সন্ধ্যার আগে এডাল্টিসাইটিংয়ের (উড়ন্ত মশা মারতে ফগিং) মাধ্যমে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম করে এলেও সফলতা পায়নি ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। সর্বশেষ ডিএনসিসি সিঙ্গাপুর থেকে ব্যাকটেরিয়া আমদানি করে। যদিও এর মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। পরে সিঙ্গাপুরের পরিবর্তে চীনের তৈরি ওষুধ সরবরাহের জন্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মার্শাল এগ্রো লিমিটেডকে কালো তালিকাভুক্ত ও মামলা রুজু করে ডিএনসিসি।
কীটতত্ত্ববিদ ড. মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘বিটিআই নামে যা আনা হয়েছে, সেটি জনস্বাস্থ্য নয়, কৃষির জন্য। সিটি করপোরেশন একটি চক্রে আটকে আছে। অদ্ভুত শোনা গেলেও তারা বিভিন্ন সময় হাঁস, ব্যাঙ, গাপ্পি দিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে। আসলে এসবই তামাশা। এ মুহূর্তে উড়ন্ত মশা মারাই লক্ষ্য হওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে বিশেষ ধরনের কীটনাশক ইউএলভি (আলট্রা লো ভলিউম) ব্যবহার করতে হবে।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক (মেডিকেল কীটতত্ত্ববিদ) তাহমিনা আক্তার বলেন, ‘কতিপয় ব্যক্তির অবৈজ্ঞানিক কথাবার্তায় নীতিনির্ধারকরা বিভ্রান্ত হচ্ছেন এবং অবৈজ্ঞানিক পন্থা অবলম্বনের কারণে মশা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।’
কীটতত্ত্ববিদ সাইফুল আলম বলেন, ‘এখানে পরীক্ষিত কোনো মশা নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি চালু নেই। মশা নিধনের ক্ষেত্রে আমরা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগি। আমরা কি ফগিং করব নাকি লার্ভিসাইট করব, নাকি টিকা আনব? কিন্তু আসল কাজ জনগণের সম্পৃক্ততা বাড়ানোর কথা বারবার বলা হলেও কোনো উদ্যোগ নেই।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন