লিকলিকে শরীর। দুপায়ে ভর করে ঠিকমতো দাঁড়াতেও পারছিলেন না মাদকাসক্ত যুবক মিনহাজ (ছদ্মনাম)। এ অবস্থায় এসেছেন বগুড়ার মোহাম্মদ আলী হাসপাতাল এলাকার একটি ব্লাড ব্যাংকে। উদ্দেশ্য রক্ত দেওয়া।
দেখা গেলো, দোকানমালিকের সঙ্গে তিনি তর্কে জড়িয়েছেন। কারণ, ১০০ টাকার চুক্তিতে তার শরীর থেকে এক ব্যাগ রক্ত নেওয়া হলেও তাকে দেওয়া হয়েছে মাত্র ৫০ টাকা। আরও ৫০ টাকা দাবিতে মিনহাজের এ হট্টগোল।
এসময় বেশকিছু লোক জড়ো হন। তাদের উদ্দেশে মিনহাজ বলছিলেন, এর আগেও এভাবে আমার সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। এটা এখন আর মানবো না। চুক্তি অনুযায়ী ১০০ টাকাই দিতে হবে।
জাগো নিউজের অনুসন্ধানে জানা গেছে, শহরের বেশিরভাগ ব্লাড ব্যাংকেরই একই অবস্থা। অবাধে গজিয়ে ওঠা এসব ব্লাড ব্যাংকে ডোনার হিসেবে নিয়মিত রক্ত বিক্রি করছেন মাদকাসক্ত যুবক এবং যৌনকর্মীরা। এদের রক্তে যৌনরোগ ছাড়াও বি-ভাইরাস, এইডসের জীবাণু থাকতে পারে বলে আশঙ্কা চিকিৎসকদের।
বগুড়া মোহাম্মদ আলী হাসপাতাল ও বিভিন্ন ক্লিনিকের আশপাশে গড়ে উঠেছে শতাধিক ব্লাড ব্যাংক। সেখানে নিয়মিত রক্ত বেচাকেনা হচ্ছে। তবে এগুলোর প্রায় সবগুলোই অনুমোদনহীন।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বগুড়া উত্তরাঞ্চলের প্রাণকেন্দ্র এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় শুধু বগুড়ায় নয়, পার্শ্ববর্তী জেলা গাইবান্ধা, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ ও জয়পুরহাট থেকে রোগীরা চিকিৎসা নিতে আসেন। এ শহরে সরকারি মোহাম্মদ আলী হাসপাতাল এবং শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ ছাড়াও প্রায় দুইশ ক্লিনিক রয়েছে। বিভিন্ন ক্লিনিক ও দুই হাসপাতালে প্রতিমাসে রক্তের প্রয়োজন হয় দুই থেকে আড়াই হাজার ব্যাগ। এসব রক্তের প্রয়োজন মেটায় সন্ধানী, রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগ এবং বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা ব্লাড ব্যাংক।
শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ ও মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা সন্ধানীর একটি শাখা রয়েছে। মুমূর্ষু রোগীর জীবন বাঁচাতে মাসে গড়ে ৪০০-৪৫০ ব্যাগ রক্ত সরবরাহ করে ‘সন্ধানী’। বাকি রক্ত সরবরাহ করে বিভিন্ন ব্লাড ব্যাংক। সন্ধানী রক্ত সংগ্রহ করে স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচির মাধ্যমে। তাদের রক্তের সবচেয়ে বড় ডোনার (দাতা) শিক্ষার্থীরা। কিছু তালিকাভুক্ত ডোনারও রয়েছেন। তারা প্রতি তিনমাস পরপর রক্ত দেন।
তবে শুধু সন্ধানীর সরবরাহ করা রক্তে প্রয়োজন মেটে না বলেই ক্লিনিকগুলো রক্ত সংগ্রহ করে অন্যান্য ব্লাড ব্যাংক থেকে। এসব ব্লাড ব্যাংক প্রতিব্যাগ রক্ত একশ থেকে দেড়শ টাকায় ডোনারদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে। এরপর বিভিন্ন টেস্ট ফিসহ রোগীর কাছে সেই রক্ত বিক্রি করে এক থেকে দেড় হাজারে। তবে আশঙ্কার বিষয় হলো ডোনাররা। এসব ডোনারের বেশিরভাগ হয় মাদকাসক্ত নতুবা যৌনকর্মী।
মাদকের টাকা জোগাতে তারা নিয়মিত রক্ত বিক্রি করেন। আবার খদ্দের না জুটলে কোনো কোনো যৌনকর্মী রক্ত বিক্রি করে পেট চালান। এদের কাছ থেকে সংগৃহীত রক্তে যৌনরোগের ছাড়াও বি-ভাইরাসসহ এইডসের জীবাণু থাকার আশঙ্কা রয়েছে।
কথা হয় যৌনকর্মী বিলকিসের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘কী করমু, স্যার?। বাঁচন তো লাগবি। হামাকেরে নিজ্জের অক্ত ব্যাচা ছাড়া চলবি না। হামাকেরে অক্ত গাওত লিয়্যা হামরা তো বাঁচা আছি। তালে অন্য লোক সেই অক্ত দিয়্যা বাঁচপিনা ক্যা? হামি প্রতিমাসেই একবার করে অক্ত দিই। টাকা বেশি প্যালা মাসে ২-৩ বার করেও দিবার পারমু।’
বগুড়ার মোহাম্মদ আলী হাসপাতালের রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগের সাবেক কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের সংগৃহীত রক্ত পরীক্ষা করা হয়। তবে ক্লিনিকে পরীক্ষা হচ্ছে কি না তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। এজন্য ঝুঁকি তো কিছুটা থেকেই যায়।’
তবে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের একটি সূত্রের দাবি, ক্লিনিকের রক্তে বি-ভাইরাসসহ এইডসের জীবাণু পরীক্ষা করার মতো প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নেই। এছাড়া শহরে এমন অনেক ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে সেখানে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিও নেই। যেগুলোতে আছে সেগুলো প্রায়ই ভুল রিপোর্ট দেয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বগুড়া সিভিল সার্জন অফিসের একটি সূত্র জানায়, অবৈধভাবে রক্ত বেচাকেনা রোধে অতীতে একাধিকবার ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হয়েছিল। এরপর দীর্ঘ সময় পার হলেও এ বিষয়ে আর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
বগুড়া ব্লাড ব্যাংকের স্বত্বাধিকারী আব্দুল জলিল। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠানের অনুমোদনের জন্য সিভিল সার্জন অফিসে আবেদন করেছি। তবে অনেকদিন ধরে সেটার খোঁজ নেই। এ কারণে অনুমতি ছাড়াই প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছি।’
শহরের কানুছগাড়ি এলাকার উত্তরা ক্লিনিকের কর্মকর্তা হালিম খান বলেন, ‘নিজ দায়িত্বে ক্লিনিকেই রক্ত পরীক্ষা করি। এটার জন্য সরকারি অনুমতির প্রয়োজন আছে কি না জানি না। তবে আমরা অভিজ্ঞ ল্যাবটেকনিশিয়ান দিয়ে কাজ করাই।’
এ বিষয়ে বগুড়া সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফিরোজা পারভীন বলেন, অবৈধ ব্লাড ব্যাংকের খবর শুনেছি। এ বিষয়ে সিভিল সার্জনের মতামত চাওয়া হয়েছে। এসব বন্ধে যে কোনো সময় অভিযান চালানো হবে।
সার্বিক বিষয়ে বগুড়া সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ শফিউল আজম বলেন, সরকারি হাসপাতালে সরকারি ব্যবস্থাপনায় যে রক্ত দেওয়া-নেওয়া হয় শুধু সেটারই অনুমোদন রয়েছে। এছাড়া বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত কোনো ব্লাড ব্যাংকের অনুমোদন নেই।
অনুমোদনহীনভাবে গড়ে ওঠা এসব ঝুঁকিপূর্ণ ব্লাড ব্যাংকের বিরুদ্ধে করণীয় কী, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এর বিরুদ্ধে হয় ভ্রাম্যমাণ আদালত কিংবা পুলিশ অ্যাকশন নিতে পারে। এছাড়া করার কিছু নেই। তবে মাদকাসক্ত ব্যক্তির কাছ থেকে রক্ত বেচাকেনা ‘খুবই ঝুঁকিপূর্ণ’ কাজ বলে স্বীকার করেন তিনি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন