ছাত্রদলের কমিটি, ক্ষোভ আর রাজনৈতিক বেসাতি
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নতুন কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে এ মাসের মাঝামাঝি যা কিছু ঘটে গেল, তাকে আমরা কি বলব? এটা কি রাজনীতি নাকি অন্য কিছু? ছাত্রদলের কমিটি ২০১ সদস্যের। এবার কিন্তু পুরোটা এখনো ঘোষণা করা হয়নি। ২০১ জনের মধ্যে ১৫৩ জনের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। আর এই আংশিক কমিটি নিয়েই বেধেছে বিরোধ। মারামারি, অফিসে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া, কেন্দ্রীয় নেতাদের ধাওয়া দেওয়া এমনকি দলের শীর্ষ নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ের সামনে বোমা পর্যন্ত ফাটানো হয়েছে। এই অপকর্মগুলো সরকার কিংবা বিএনপিবিরোধী কোনো সংগঠন থেকে করা হয়নি। করেছে খোদ ছাত্রদলেরই নেতা-কর্মীরা। যারা তাদের প্রত্যাশিত পদ পায়নি, তারা করেছে। নতুন ঘোষিত আংশিক কমিটিতে যাদের নাম ছিল এমন অনেককেও দেখা গেছে বিক্ষুব্ধদের সঙ্গে গলা মেলাতে, হাত মেলাতে। তাদের ক্ষোভ, তাদের যোগ্যতার যথাযথ মূল্যায়ন করা হয়নি।
আচ্ছা, এই মূল্যায়ন করার দায়িত্বটি কার? তারও আগে আলোচনা করা যেতে পারে ছাত্রদলের কমিটি গঠনের প্রক্রিয়াটি নিয়ে। একটা সময় ছিল, ছাত্রদলকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হতো। দেশজুড়ে ছিল এর শক্ত সাংগঠনিক ভিত্তি। তাত্ত্বিকভাবে বলতে গেলে বিএনপির রাজনৈতিক আদর্শের অনুসারী ছাত্রদের দ্বারাই গড়ে উঠবে ছাত্রদল। যুবকদের সংগঠন হলো যুবদল। অনেকটা ছাত্রলীগ আর যুবলীগের আদলেই যেন এই শ্রেণি বিভাজন। কিন্তু নির্মম বাস্তবতা হচ্ছে যুবকদের পরিবর্তে যুবলীগ আর যুবদল যেমন প্রৌঢ়দের দখলে চলে গেছে, তেমনি ছাত্র সংগঠনগুলোও আর নেই ছাত্রদের নিয়ন্ত্রণে।
এই দেশে ছাত্র ও যুব সংগঠনগুলোর বেশ গৌরবময় ঐতিহ্য আছে। সেই ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা সংগ্রাম পর্যন্ত সব আন্দোলনে এরাই ছিল অগ্রণী ভূমিকায়। তত্ত্বগতভাবেই এটা হয়। ছাত্র বা তরুণদের মধ্যে বৈষয়িক চিন্তা-ভাবনা তুলনামূলক কিছু কম থাকে। তাই তাদের পক্ষে ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে ওঠে জাতীয় স্বার্থের কথা চিন্তা করা সহজ হয়। সহজ হয় মহৎ কিছুর জন্য আত্মত্যাগ করাও। ভেবে দেখুন, সেই ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা আন্দোলন পর্যন্ত সময়কালের কথা। জীবন যে কয়জনের গেছে, তরুণদেরই গেছে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব শুরুতে আপসের পথ ধরেছে, পরে জোয়ার দেখে তরুণদের অনুসরণ করেছে এবং শেষ পর্যায়ে এসে সুফলটা নিজেদের পকেটে ঢুকিয়েছে।
কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে ছাত্র আর তরুণদের সেই ঐতিহ্যম-িত ঐতিহাসিক ভূমিকাটা যেন আর দেখা যাচ্ছে না। দেখা যে যাচ্ছে না, এ নিয়ে তেমন একটা অবাক হওয়ারও কিছু নেই। কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন রাখলেই যে তার দৃষ্টিশক্তি কিছুমাত্র বাড়ে না, তেমনি প্রৌঢ়দের ছাত্র অথবা যুব সংগঠনের নেতা বানিয়ে দিলে হারানো সেই ঐতিহ্যকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। এই কিছুদিন আগেও সরকারি দলের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ-যুবলীগের তা-ব নিয়ে বেশ একটা সমালোচনা দেখা গেছে। টেন্ডারবাজিসহ নানা ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকা-ে তারা এতটাই জড়িয়ে পড়েছে যে, তার প্রতিক্রিয়ায় মারামারি, খুনখারাবি, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ এসব অহরহই ঘটেছে। দখল আর ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে নিজেরা নিজেরা মারামারি করেছে।
আচ্ছা, ছাত্রলীগ-যুবলীগেরটা না হয় মানায়, তারা ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে আছে, তাই হালুয়া-রুটির ভাগটাও ওখানেই বেশি পাওয়া যাবে। কিন্তু ছাত্রদলের সমস্যাটা কি? আসলে আমি নিতান্ত মূর্খের মতোই একটা প্রশ্ন করেছি। আসলে ছাত্রলীগ আর ছাত্রদলের মধ্যে গুণগত কোনো পার্থক্য নেই, পার্থক্য যা আছে সেটা মাত্রাগত। চরিত্র, আকাক্সক্ষা, আচরণÑসবই এক। এখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে, তাই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা বেশি অর্জন করার সুযোগ পাবে, আবার বিএনপি যদি ক্ষমতায় থাকে তাহলে সেই সুযোগটা যাবে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের কাছে। বিএনপি এখন ক্ষমতায় নেই, তাই বলে যে ছাত্রদলের আয় ইনকাম একেবারে থেকে গেছে, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। এই যেমন নিজেদের মধ্যে মারামারি হয় পদ দখল নিয়ে, তেমনি পদ পেলে নিজেদের কাছ থেকে প্রাপ্তিও একেবারে কম হয় না।
আসলে, এ বিষয়টা আমি আগে অত বুঝতাম না। একেবারে মাঠ পর্যায়ের রিপোর্টিংয়ে জড়িত এমন এক সহকর্মী কয়েকদিন আগে বিষয়টি জানালেন। যুবদলের এক নেতার নাম করে বললেন, দেখেন উনি গত আট বছর ধরেই আর সরকারে নেই, এর মধ্যে সংসদ সদস্যও ছিলেন না। কিন্তু তার আয় কি কিছুমাত্র কমেছে? কিছুদিন পর পর তিনি বিদেশে যান, যে দেশেই যান সেখানে যুবদলের একটা কমিটি গঠন করে আসেন। ওই কমিটির প্রত্যেকের কাছ থেকে বড় অঙ্কের অর্থ পান উৎকোচ অথবা উপঢৌকন হিসেব। অর্থের লোভটা এখন এতই বেড়ে গেছে যে, দেখবেন বাইরের প্রতিটি দেশেরই যুবদলের একাধিক কমিটি রয়েছে। কমিটি গঠন করে দিলেই যদি নগদনারায়ণ পাওয়া যায়, একাধিক কমিটি করতে সমস্যা কোথায়? এই প্রবণতা মূল দল এবং দলের সব সহযোগী সংগঠনেই রয়েছে। তাহলে ছাত্রদলের কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ পদ পাওয়া কাক্সিক্ষত হবে না কেন?
কিছুদিন আগে উপজেলা নির্বাচন হয়ে গেল। সংসদ নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ভুল ততদিনে বিএনপি ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছে। তাই বেশ ঘটা করেই তখন তারা উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিল। কোনো কোনো এলাকায় বিএনপির একাধিক প্রার্থী দাঁড়িয়ে গেল। আর এই সুযোগে ওই সময়েই দেখা গেছে কোন এলাকায় কে বিএনপির মূল প্রার্থী তা নিয়ে এক ধরনের বাণিজ্য। কেন্দ্রীয় এক নেতা কিছুক্ষণ পরপর বিএনপির প্যাডে প্রেস রিলিজ পাঠাতেন টেলিভিশনগুলোতে। প্রেস রিলিজগুলো ফ্যাক্স করার সঙ্গে সঙ্গে যে নেতাকে আসল প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হতো, তার পক্ষ থেকে তদবির যেতে থাকত সেই খবরটি টিভির স্ক্রলে প্রচারের জন্য। এক উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ওই এক নেতা কত কোটি টাকা কামিয়েছেন বলা মুশকিল।
কাজেই সরকারে না থাকলেই যে আয়-ইনকাম থাকে না, এমন ধারণা এখন বড়ই সেকেলে। আর আয়ের সম্ভাবনা থাকলে তা নিয়ে মারামারি হবে, এটাই তো স্বাভাবিক। ছাত্রদলে কয়েকদিন আগে যা হয়ে গেল, সেটা আসলে এরই ধারাবাহিকতা। নেতৃত্বে যারা যেতে পারল, যেতে না পেরে যারা ক্ষুব্ধ হলো, তারা সবাই যদি প্রকৃতই ছাত্র হতো, তাহলে হয়ত এত বিক্ষোভ, ভাংচুর, অফিস দখল-পাল্টা দখল হতো না। কমিটি গঠনের একাধিক মিডিয়াতে এ নিয়ে বিস্তর লেখালেখি দেখলাম। দেখা গেল অছাত্র, বিবাহিত, একাধিক সন্তানের জনক, হত্যা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামি, মাদক ব্যবসায়ী, সশস্ত্র ক্যাডারÑসবই আছে এখানে। অভাব কেবল প্রকৃত এবং নিয়মিত ছাত্রের।
প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে অছাত্রদের কমিটির শীর্ষ পর্যায়ে কে নিয়ে এলো? তারা কি কোনো নির্বাচনের মাধ্যমে, ছাত্রদলের সাধারণ কর্মীদের ভোটের মাধ্যমে পেয়েছেন এই নেতৃত্ব? যদি সংগঠনের গঠনতন্ত্রের দিকে তাকানো যায়, তাহলে কিন্তু যে কেউই ভাববেন, সেভাবেই তো নেতা নির্বাচিত হওয়ার কথা। কিন্তু আসলে তা হয়নি। তারা নির্বাচিত হয়নি, নির্ধারিত হয়েছে। কেউ না কেউ এদের নির্ধারণ করে দিয়েছেন। কে নেতৃত্বের কোন পদ পাবে, সেটা উপর থেকে নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। পদবণ্টনে বিক্ষুব্ধ নেতারা নয়াপল্টনস্থ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে দুই নেতার কুশপুত্তলিকা দাহ করেছে। এতে ধারণা করা গেছে, এই দুজনেরই হয়ত ভূমিকা ছিল কমিটি গঠনে। এই দুই নেতার কেউই এখন আর ছাত্র নন, একসময় এরা ছাত্রদলের নেতা ছিলেন। এদের একজন আবার সংসদ সদস্যও ছিলেন বিগত সংসদের। বোমা বিস্ফোরিত হয়েছে বেগম খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ের সামনে। অর্থাৎ কমিটি গঠনে শীর্ষ নেত্রীর ভূমিকা যে রয়েছে সেটাও এখানে পরিষ্কার। আনুষ্ঠানিকভাবে কমিটি যিনি ঘোষণা করেছেন তিনিও জানিয়েছেন, এটি বেগম খালেদা জিয়ারই কমিটি।
আচ্ছা, বেগম খালেদা জিয়ার কমিটি হয় কি করে? তিনি তো আর ছাত্র নন। নৈতিকতাকে বাদ দিয়ে যদি আইনের কথা ধরি, তবুও তো কোনো ছাত্র সংগঠনের কমিটি গঠনের দায়িত্ব রাজনৈতিক দলের নেতারা নিতে পারেন না। আইন অনুযায়ী রাজনৈতিক দলের কোনো অঙ্গ সংগঠন থাকতে পারবে না, থাকতে পারবে সহযোগী সংগঠন। সহযোগী সংগঠন মানে পৃথক একটি সংগঠন, যাদের কাজকর্ম মূল দলের সঙ্গে সহযোগিতামূলক হবে। তাহলে?
আচ্ছা, অন্য সব বিতর্ক বাদ থাক, শেষ আলোচনাটা বরং নির্বাচন পদ্ধতি নিয়েই করি। বেগম খালেদা জিয়া ছাত্রদলের এই কমিটি নির্বাচনে ঠিক কোন পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন, সেটা মোটেই স্পষ্ট নয়। কোনো পদে ঘোষিত কোনো প্রার্থী ছিলেন কি না, সেটাও জানার কোনো উপায় নেই। তাহলে নির্বাচনের ভিত্তিটা কি? এই সংগঠনটা কি কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি? এই নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে যদি প্রশ্ন না তোলা যায়, তাহলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এতগুলো আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া নিয়ে এত আপত্তি কেন? অন্যায়, তা যে পরিসরেই হোক না কেন, অন্যায়ই তো।
আর যদি নির্বাচন পদ্ধতির কথা বলি, তাহলে এই নির্বাচনটিকে কি অবাধ এবং গঠনতন্ত্রসম্মত বলা যাবে? আপনি জাতীয় পর্যায়ে অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের কথা বলবেন, এ নিয়ে আন্দোলন করবেন, আর নিজের দলের মধ্যে, সহযোগী সংগঠনের মধ্যে নির্বাচনের ক্ষেত্রে কোনো নিয়মই মানবেন না, এটা তো হয় না। কেবল বিএনপির প্রতিই যে এই প্রশ্ন, তা কিন্তু নয়। সরকারি দল আওয়ামী লীগের মধ্যেও চলছে এই একই প্রবণতা। এই ধারার বাইরে না আসতে পারা পর্যন্ত এদের কারও মুখেই অবাধ গণতন্ত্রের কথা কতটটুকু বিশ্বাসযোগ্য হবে, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাবে।
ক্যাপশন
নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে হামলা ও ভাঙচুর চালান ছাত্রদলের পদবঞ্চিতরা। এর আগে কার্যালয়ের সামনে দুটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটে। এ সময় আহত এক কর্মীকে রাস্তায় কাতরাতে দেখা যায়
এই সময়ের সৌজন্যে