বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির ইতিহাসে উজ্জ্বল ভূমিকা আছে বামধারার ছাত্রসংগঠনগুলোর। ভাষা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, স্বাধীনতার যুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের আগে-পরে দেশের সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনেই নেতৃত্বের পর্যায়ে ছিল তারা। তবে সময়ের ব্যবধানে সেই সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্য ফিকে হয়ে গেছে। বর্তমানে অস্তিত্ব সংকটে পড়ে ধুঁকে ধুঁকে টিকে থাকার চেষ্টা করছে ঐতিহ্যবাহী বাম ছাত্রসংগঠনগুলো।
অতীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ডাকসুসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি-জিএসসহ একাধিক পদে বারবার নেতৃত্ব দিয়েছে বাম সংগঠনের নেতাকর্মীরা। কালের পরিক্রমায় বাম নেতৃত্বের ডাকে হাজারো শিক্ষার্থীর মিলনমেলা এখন মাত্র ১০-১২ জনের মিছিলে পরিণত হয়েছে। সংগঠনগুলোর নিজেদের মধ্যে বিভাজনও প্রকাশ্যে এসেছে। সারাদেশে জেলায় কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ ক্যাম্পাসে কর্মী সংকটও তীব্র হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর এবং ‘দাঁড়ি-কমা ভুলের জন্য দলের মধ্যে বিভাজনের’ কারণে বাম সংগঠনগুলো বিশেষভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। গভীর সংকটে পড়েছে ঐতিহ্যবাহী ছাত্রসংগঠনগুলো।
বিভাজিত সংগঠনগুলো
গত এক দশকে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ভাঙন ধরেছে একাধিক সংগঠনে। তাদের মধ্যে আছে পুরোনো সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফেডারেশন ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট।
২০২১ সালে কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নে বিদ্রোহ ও পরে পৃথক কাউন্সিলের মাধ্যমে দুই ভাগ হয়েছে সংগঠনটি। এখন দুই অংশের দুটি কমিটি বিদ্যমান। ফলে আলাদাভাবে কর্মসূচিতে লোক হয় দশ-বারোজন করে।
একই অবস্থা ছাত্র ফেডারেশনেরও। এই সংগঠনেরও অংশ দুটি। একটি জোনায়েদ সাকির গণসংহতি আন্দোলনপন্থি, অন্যটি বদরুদ্দীন উমরের জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলপন্থি।
একই চিত্র সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টেরও। ২০১৮ সালে ভাগ হওয়ার পর থেকে এই সংগঠনটির একটি মার্কসবাদী আরেকটি অংশ খালেকুজ্জামানপন্থি হিসেবে পরিচিত।
ছাত্র ফ্রন্টের ভাঙা অংশ আরও একবার ভাঙে ২০২১ সালে। এসময় ভাঙা অংশ থেকে ভেঙে আরও একটি সংগঠন হয়। যেটি ‘গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিল’ হিসেবে মধুর ক্যান্টিন থেকে আত্মপ্রকাশ করে।
এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি ছাত্র কাউন্সিল, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (জাসদ)-সহ হাতে গোনা কয়েকটি সংগঠনে অন্তর্দ্বন্দ্ব না থাকলেও টুকটাক কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে ধুঁকে ধুঁকে টিকে আছে। সংগঠনগুলোর কর্মসূচিতে হাতেগোনা উপস্থিতি দেখা যায়।
বিভাজনের শুরু
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রীর সাবেক এক নেতা বলেন, বাম ছাত্ররাজনীতির বহুধা বিভক্তির কারণে সংগঠনগুলো আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে যায়। ছাত্র ইউনিয়ন প্রথমে ভাঙল ১৯৬৪ সালের দিকে। মেনন গ্রুপ ও মতিয়া গ্রুপ হল। মেনন গ্রুপ বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন নামধারণ করলো, আর মতিয়ারটা ছাত্র ইউনিয়ন। মতিয়ার ছাত্র ইউনিয়ন কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র ইউনিয়ন। বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন আবার অনেক ভাগে ভাগ হলো। এরপর আবার এসব মিলিত হয়ে নাম ধারণ করলো বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী। এরপর ছাত্র ফ্রন্ট তিন-চার ভাগে বিভক্ত হলো। জাসদ ছাত্রলীগও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ থেকে আলাদা হয়ে দুই-তিন ভাগে বিভক্ত হলো।
বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী আবার ভেঙে বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী হলো। এই যে কথায় কথায় বিভক্তি এবং দাঁড়ি-কমা ভুলের জন্য ভাঙন সেটাই বাম ছাত্রসংগঠনগুলোকে দুর্বল করেছে।
তিনি বলেন, বাম রাজনীতির একসময় জয়জয়কার ছিল। লাল স্বপ্নে মানুষ বিভোর ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের একটা ধাক্কা স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশেও পড়ে। তখন ওই স্বপ্নটা ফিকে হতে থাকে।
বাম সংগঠনের নিজস্বতা হারিয়ে ফেলাও অন্যতম কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, উদাহরণস্বরূপ, কমিউনিস্ট পার্টিকে আমরা দেখেছি আওয়ামী লীগের বি-টিম হিসেবে কাজ করেছে। যদিও তাদের সাথে জোট করেনি। কিন্তু আমরা বি-টিমের মতো আচরণ কেন করব? আমরা এ-টিমই থাকতাম। যদি আওয়ামী লীগের কর্মসূচির সাথে সম্পূর্ণ একমত হই, তাহলে আলাদা দল করব কেন?
বাম সংগঠনের নেতাদের ভাষাগত সমস্যা ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, সবসময় তারা তাত্ত্বিক আলাপ নিয়ে থাকতো। তারা গণমানুষের ভাষায় কথা বলতে পারেনি। এটা একটা সমস্যা। নতুন গবেষণা বা নতুন কোনো কাজ করা - এটা তাদের মধ্যে ছিল না। বরং তারা মুখস্থ কথা বলতো। যেমন, কথা কথায় শিক্ষা-ব্যবসা একসাথে চলেনা স্লোগান। ষাটের দশকে তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচিকে তারা সময়ের সাথে আপডেট করতে পারেনি।
তিনি যোগ করেন, নতুন কোনো কর্মসূচি দিয়ে শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন দেখাবে সেটাও তারা করতে পারেনি। অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের পাশাপাশি শিবির যেমন ইসলামি ব্যাংক কিংবা ইবনে সিনায় চাকরির স্বপ্ন দেখাচ্ছে, বামরা এরকম কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারেনি। শিবিরের কিশোর কণ্ঠের ব্যাপারে জানে না এরকম কেউ নেই। এ ধরনের অনুষঙ্গের যথেষ্ট অনুপস্থিতি রয়েছে।
বিভাজনের মধ্যেও আশাবাদী থাকতে চান ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাগীব নাঈম। তিনি বলেন, আমাদের মধ্যে বিতর্ক থাকবে। আদর্শিক দ্বন্দ্ব নিয়ে তর্ক চলবে। কিন্তু মানুষের অধিকারের প্রশ্নে সবাই আবার এক জায়গায় আসব। এটাই সৌন্দর্য।
কর্মী সংকটের কারণ
বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন কলেজে বাম রাজনীতির প্রতি শিক্ষার্থীদের ঝোঁক কমলেও এটাকে কর্মী সংকট মনে করেন না রাগীব নাঈম।
তিনি বলেন, বৃহত্তর সমাজে ছাত্র ইউনিয়ন বা বাম রাজনীতির ভাবাদর্শ এখনো মানুষের মধ্যে আছে। আগে বেশি ছিল, এখন কমেছে, তা না। যারা বা যে দল সেকুলারিজমের কথা বলে ক্ষমতায় গেছে, তারা রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে বসে প্রগতিশীল দলগুলোকে দমন করেছে। তার দীর্ঘমেয়াদি একটা প্রভাব কিন্তু আছে। আমরা অনেক জায়গায় সভা করতে পারিনি। আমি মনে করি, কথা বলা বা আমাদের মত ভাবে এরকম মানুষ এখনো কমে যায়নি।
তিনি আরো বলেন, আওয়ামী লীগ বা শাসকগোষ্ঠী অনেক সময় ঠাট্টা করেছে যে, আমাদের মিছিলে ১০ জন উপস্থিত হয়। কিন্তু তাদের মিছিলে যে এক হাজার হয়, সব কি আদর্শের টানে আসে? ছাত্রলীগ, ছাত্রদলসহ সব ক্ষমতাধারী সংগঠন ছাত্রদের জিম্মি করে তাদের মিছিলে মানুষের উপস্থিতি বাড়িয়েছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী, অনুবাদক ও সাংবাদিক শাওন আরাফাত বলেন, স্বাভাবিকভাবে পলিটিক্যাল পার্টি চলে ব্যবসায়ীদের টাকায়। আগে অনেক দেশ রাষ্ট্রীয়ভাবে ফান্ড প্রভাইড করলেও এখন সেটা নেই। আর পুরো বিশ্বে ক্যাপিটালিজম এমনভাবে ঝেঁকে বসেছে যে সমাজতন্ত্রের প্রসারে কেউ ইনভেস্ট করার আগ্রহ প্রকাশ করে না।
কবে থেকে বাম ছাত্ররাজনীতি দুর্বল হয়?
রাগীব নাঈম বলেন, পুঁজিবাদের বিকাশে বা উদারনৈতিক পলিসির কারণে ইনডিভিজুয়ালিস্টিক চিন্তাভাবনা বেড়েছে। পুঁজিবাদী মার্কেট ব্যবস্থা ছাড়াও বাম রাজনীতি দুর্বল হওয়ার অন্যতম আরেকটা কারণ হলো সমাজকে বিরাজনীতিকরণ করার অপচেষ্টা। ৯০ এর পর শাসকরা চেয়েছে শিক্ষিত সমাজ সবসময় রাজনীতির প্রতি বিমুখ থাকুক। যার কারণে, শিক্ষানীতিতেও তারা ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। অনেক লেখা, কবিতা, পদ্য-গদ্য বাদ দেওয়া হয়েছে। জেনারেশনের পর জেনারেশন এসব পড়াশোনা করে সংগঠন করার প্রতি অনাগ্রহ প্রকাশ করছে।
তিনি আরো বলেন, তারপরেও মানুষের ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষা আছে। আকাঙ্ক্ষা নাই হয়ে যায়নি সেটা সর্বশেষ গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পেরেছি।
শাওন আরাফাত বলেন, ক্যাপিটালিজমের উত্থানে নব্বইয়ের দশক থেকে বাম রাজনীতির চর্চা কমেছে। যখন থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙন শুরু হয় তখন থেকেই বাম রাজনীতির পতন শুরু হয়। তখন অনেকে অন্য রাজনীতির সাথে যুক্ত হওয়া শুরু করে। যার কারণে বাম রাজনীতির যে আকর্ষণ সেটা কমে গেছে।
সংকট কাটাতে গণতান্ত্রিক ছাত্রজোট
সংকট কাটিয়ে উঠতে বামপন্থি আটটি সংগঠন নিয়ে ৩০ নভেম্বর ২০২২ সালে আত্মপ্রকাশ করে ‘গণতান্ত্রিক ছাত্রজোট’। সেখানেও নানান মতানৈক্য, আদর্শ থেকে সরে যাওয়ার অভিযোগ এবং ইগো সমস্যার কারণে তারা অধিকাংশ সময়ই এক হতে পারে না। বিভিন্ন ইস্যুতে জোটের কর্মসূচিতেও কর্মী উপস্থিতির সংখ্যা থাকে হাতেগোনা। যাদের অধিকাংশই বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া নন, বরং ঢাকার কোনো স্কুল-কলেজ থেকে তাদের নিয়ে আসা হয় বলেও সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন