Image description
ঘরে-বাইরে নানা চাপে দুদল
আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ও সরকারবিরোধী আন্দোলন সামনে রেখে ঘরে-বাইরে বহুমুখী চাপে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় করণীয় নিয়ে ব্যস্ত দুদলের নীতিনির্ধারকরা। বিশ্লেষকদের মতে, অন্তত এক ডজন চ্যালেঞ্জের মুখে ক্ষমতাসীনরা। অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতে দেখা দিয়েছে বৈদেশিক চাপ। এ ইস্যুতে ইতোমধ্যে প্রভাবশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা করেছে নতুন ভিসানীতি। প্রকাশ্যে গুরুত্ব না দিলেও ভেতরে ভেতরে এ নিয়ে দলের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। আওয়ামী লীগের মতো বিএনপির সামনেও রয়েছে নানা চ্যালেঞ্জ। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠা। এছাড়া জোটগতভাবে ভোটে অংশ নেওয়া, আসন ভাগাভাগি, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা দলটির সামনে চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা দেবে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, নির্বাচন সামনে রেখে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে রয়েছে দুস্তর অবস্থানগত পার্থক্য। আওয়ামী লীগ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। নির্বাচনকালীন একটি নতুন সরকার প্রতিষ্ঠায় চূড়ান্ত আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত বিএনপি। রাজপথে দুদলের অবস্থান মুখোমুখি। দুদলেরই সামনে রয়েছে বহুমুখী চ্যালেঞ্জ। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হলে সময় আর বেশি নেই। স্বল্পতম সময়ের মধ্যে সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে নির্বাচনি বৈতরণী পাড়ি দেওয়া কতটা সহজ হবে তা ভাবাচ্ছে নেতাদের। এরপর সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে কার হাতে উঠবে রাজদণ্ড-এই মুহূর্তে সেই সুতোর ওপর দিয়ে হাঁটছে দুই দল। আওয়ামী লীগের সামনে এক ডজন চ্যালেঞ্জ বিএনপির আন্দোলন মোকাবিলা, দল ও জোটের ঐক্য ধরে রাখা, আন্তর্জাতিক চাপ মোকাবিলা, দ্রব্যমূল্য ও বিদ্যুৎ পরিস্থিতি সহনীয় রেখে উন্নয়নচিত্র তুলে ধরা হাসিবুল হাসান আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ঘরে বাইরে নানা চ্যালেঞ্জে আওয়ামী লীগ। দীর্ঘদিন টানা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা দলটির তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ বিরোধ মেটানো বড় চ্যালেঞ্জ। ইতোমধ্যে নানা কর্মসূচি দিয়ে মাঠে নেমেছে বিএনপি। তাদের আন্দোলন মোকাবিলার পাশাপাশি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাপ রয়েছে ক্ষমতাসীনদের ওপর। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আমেরিকার নতুন ভিসানীতি। নির্বাচনি বছরে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখও তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ভোটের আগে আসন ভাগাভাগিসহ কয়েকটি ইস্যুতে শরিকদের মধ্যে ঐক্য ধরে রাখতে হবে দলটিকে। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে যোগ্য প্রার্থী বাছাই, ইশতেহার তৈরি, অপপ্রচারের জবাব ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরাসহ নানা চ্যালেঞ্জ রয়েছে ক্ষমতাসীনদের। এছাড়া গাজীপুরের ভোটের পর আসন্ন চার সিটির নির্বাচনও ভাবনায় ফেলেছে দলের হাইকমান্ডকে। এসব চ্যালেঞ্জ নিয়ে ভেতরে ভেতরে চিন্তিত হলেও দলটি নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা বলেছেন-তা মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ইতোমধ্যেই কাজ শুরু হয়েছে। নির্বাচনের আগে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। সোমবার গণভবনে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় অনুষ্ঠানে নানামুখী ষড়যন্ত্রের কারণে আগামী নির্বাচনটা চ্যালেঞ্জের হবে বলে জানান দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, নির্বাচনটা একটা চ্যালেঞ্জ, কারণ নানা ধরনের চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র হয়। আওয়ামী লীগকে আরও শক্তিশালী সংগঠন হিসাবে গড়ে তোলার নির্দেশনা দিয়ে দলটির প্রধান বলেন, আমাদের সংগঠনটা যথেষ্ট শক্তিশালী। সংগঠনটা যেন আরও মজবুত থাকে। সেদিকে ব্যবস্থা নিতে হবে। বিএনপির আন্দোলন মোকাবিলা : গত বছরের শেষের দিক থেকে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছে বিএনপি। তাদের সঙ্গে সমমনা দল ও জোট সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু করেছে। আন্দোলনের মাঠে নামার চেষ্টা করছে জামায়াতে ইসলামীও। নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসছে বিরোধী পক্ষ আন্দোলনে ততই গতি বাড়াতে চাইবে। ক্ষমতাসীন দল হিসাবে এখানে আওয়ামী লীগের দুটি মূল চ্যালেঞ্জ রয়েছে। একদিকে রাজপথে থেকেই আন্দোলন মোকাবিলা করতে হবে। আবার আন্দোলনের নামে বা আন্দোলন মোকাবিলা করতে গিয়ে যেন অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয় ক্ষমতাসীন দল হিসাবে সেদিকেও নজর রাখতে হবে। জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারে আছে। আমরা সব সময় চেষ্টা করবো পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে। এখন তাদের (বিএনপি) আন্দোলন রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করা হচ্ছে না। কিন্তু এক দফা আন্দোলন বা আন্দোলনের নামে যদি পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার চেষ্টা হয়, সেটা তো মানা হবে না। তখন রাজনৈতিকভাবেই মোকাবিলা করা হবে। আন্তর্জাতিক চাপ মোকাবিলা : নির্বাচন সামনে রেখে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বিদেশিদের এবারের সক্রিয়তাকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ সরকার এখন পর্যন্ত ভারসাম্যমূলক অবস্থার মধ্যে রয়েছে। কিন্তু এই ভারসাম্যমূলক অবস্থা নির্বাচন পর্যন্ত কতটুকু রাখতে পারবে সেই চ্যালেঞ্জ ক্ষমতাসীনদের সামনে। এরই মধ্যে এসেছে আমেরিকার নতুন ভিসা নীতির ঘোষণা। যদিও আওয়ামী লীগ নেতাদের দাবি-ভিসানীতি ঘোষণা রাজনৈতিক দিক থেকে আওয়ামী লীগের ওপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলেনি। বরং বিএনপির নির্বাচন প্রতিহতের ঘোষণা এবং নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি এখন দুর্বল হয়ে যাবে। এখন বর্তমান সরকারের অধীনেই তাদের ভোটে আসতে হবে। তবে একই সঙ্গে পাশাপাশি ভিসানীতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিবৃতি অনুযায়ী স্যাংশন যাতে না আসে সেই পথও খুঁজছে দলটি। অভ্যন্তরীণ বিরোধ মেটানো : জাতীয় সংসদ নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘাত ততই বাড়ছে। দুই গ্রুপের সংঘর্ষ ছাড়াও প্রকাশ্যে কুপিয়ে জখম ও হত্যা, গুলি করে হত্যার মতো নৃশংস ঘটনাও ঘটছে অহরহ। জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ক্ষমতাসীন দলেরই অন্তত ১০ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছেন কয়েকশ। নির্বাচনে প্রতিপক্ষ, স্থানীয় রাজনীতিতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা, নিজস্ব বলয় তৈরিসহ নানা কারণে বিরোধে জড়িয়ে পড়ছেন নেতারা। কেন্দ্রীয় নেতাদের তৃণমূলে সফর বৃদ্ধি, ঢাকায় ডেকে মীমাংসা করাসহ নানা উদ্যোগ থাকলেও এগুলো বন্ধ হচ্ছে না। দলের অব্যাহত অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ নিয়ে চিন্তিত ক্ষমতাসীনরা। ভোটের আগে তৃণমূলের এসব বিরোধ মেটানো বড় চ্যালেঞ্জ আওয়ামী লীগের। জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, এ ধরনের ঘটনা বন্ধে আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি। খুব শিগগিরই এই ধরনের বিষয়গুলোতে দোষীদের বিরুদ্ধে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা এগুলো নির্মূল করতে চেষ্টা করছি এবং করব। ইনশাআল্লাহ এটা করতে পারব। চার সিটির চ্যালেঞ্জ : গাজীপুর সিটি নির্বাচন তৃণমূলে অনৈক্যের বড় সতর্ক বার্তা দিয়েছে আওয়ামী লীগকে। আজমত উল্লার হারের পেছনে অভ্যন্তরীণ বিভেদকেই প্রধান কারণ হিসাবে মনে করা হচ্ছে। সামনে আরও চারটি সিটি নির্বাচন। এসব নির্বাচন ঘিরেও কোন্দল স্পষ্ট হয়েছে। বরিশাল ও রাজশাহীতে অভ্যন্তরীণ কোন্দল প্রকট। প্রকাশ্যেই অনেকে নৌকার বিরোধিতা করছেন। ভোটের খুব বেশি সময় বাকি না থাকলেও নৌকার পক্ষে এখনো সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নামানো সম্ভব হয়নি। দেশের গুরুত্বপূর্ণ সিটিতে নৌকার প্রার্থীর পরাজয় নিয়ে দলের ভেতরে-বাইরে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা ও হিসাব-নিকাশ। জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম যুগান্তরকে বলেন, গাজীপুর সিটি নির্বাচনকে আমরা শিক্ষা হিসাবে নিতে চাই। সামনের সিটি করপোরেশনসহ অন্যান্য নির্বাচনে আমাদের ভুল-ত্রুটিগুলো শুধরে, কোনো দুর্বলতা থাকলে সেগুলো দূর করতে চাই। তৃণমূল নেতাকর্মীদের আরও বেশি ঐক্যবদ্ধ করে আরও বেশি ভোটের ব্যবধানে জয়ী হতে চাই। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি : জাতীয় নির্বাচনের আগে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা ক্ষমতাসীন দলের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। যুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির কারণে এ অবস্থা বলে দাবি করা হচ্ছে। তবে এর সঙ্গে স্থানীয় সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারাকেও দাবি করছেন অনেকে। এ নিয়ে অস্বস্তি রয়েছে আওয়ামী লীগের মধ্যে। কারণ ভোটের আগে জনগণের মধ্যে এক ধরনের অসন্তোষ দানা বেঁধে ওঠতে পারে। কাজেই দ্রব্যমূল্য যেন নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং দ্রব্যমূল্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে, সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। এছাড়া নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের জন্য আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো দুর্নীতি এবং অর্থ পাচার রোধ। বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা : বিদ্যুৎ উৎপাদন কয়েকগুণ বাড়ানো এবং ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যতম বড় সাফল্য। ইতোমধ্যে শতভাগ বিদ্যুতায়নের অভাবনীয় মাইলফলকও অর্জিত হয়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে গত শীতের আগে বিদ্যুৎ সংকট দেখা দিয়েছিল এবং ব্যাপকভাবে লোডশেডিং হচ্ছিল। শীতের মৌসুমে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়। কিন্তু সম্প্রতি আবার বেড়েছে লোডশেডিং। তীব্র গরমে অস্থির জনজীবন। যাতে তীব্র সমালোচনা মুখে পড়ছে আওয়ামী লীগ। লোডশেডিং নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে এই অর্জন ম্লান হওয়ার পাশাপাশি নির্বাচনেও এর প্রভাব পড়ার শঙ্কা রয়েছে। শরিকদের সঙ্গে দূরত্ব কমানো : নবম ও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ের পরে গঠিত সরকারে শরিক দলের একাধিক নেতা মন্ত্রী হয়েছেন। তবে একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিজয়ের পরে শরিকবিহীন সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। এরপর থেকেই তাদের সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে থাকে। শরিক নেতাদের নানা সময় সরকারের প্রকাশ্য সমালোচনাও করতে দেখা গেছে। আওয়ামী লীগ ‘একলা পথ’ চলছেন বলেও শরিকদের কারও কারও অভিযোগ ছিল। শরীফ নুরুল আম্বিয়ার নেতৃত্বে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ ভেঙে সৃষ্ট ‘বাংলাদেশ জাসদ’ ইতোমধ্যে জোট ছেড়েছে। তাদের অভিযোগ ছিল যে নীতি ও আদর্শ নিয়ে ১৪ দলীয় জোট গঠিত হয়েছিল বাস্তবে তা আর নেই। ফলে আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ১৪ দলীয় জোটকে আবারও চাঙ্গা করার চ্যালেঞ্জ আওয়ামী লীগের সামনে। প্রার্থী বাছাই ও ইশতেহার তৈরি : সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দলীয় যোগ্য প্রার্থী বাছাইয়ের চ্যালেঞ্জ রয়েছে আওয়ামী লীগের সামনে। এবার নির্বাচন অতীতের চেয়ে কঠিন হবে। ফলে ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হয়ে আসতে পারে এমন প্রার্থীদেরই বেছে নিতে হবে দলটিকে। এছাড়া দলের নেতাকর্মীরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে নৌকার পক্ষে কাজ করবেন এমন প্রার্থীদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন বিভিন্ন সংস্থার জরিপসহ নানা মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ হচ্ছে। দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে এসব বিষয় মনিটরিং করছেন। এদিকে ভোটের আগে তৃণমূল পর্যন্ত সংগঠনকে গোছানোর কাজও চালিয়ে যেতে হবে আওয়ামী লীগকে। পাশাপাশি নির্বাচনি ইশতেহার তৈরিও শেষ করতে হবে। এছাড়া নির্বাচনকে সামনে রেখে ঘরে ঘরে গিয়ে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরে প্রচারণা শুরুর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে দল ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের। পাশাপাশি বিএনপি-জামায়াতের নানা ‘নেতিবাচক কর্মকাণ্ড’ মানুষের কাছে তুলে ধরতেও নানা উদ্যোগ নিয়েছে তারা। এ বিষয়ে একাধিক সভায় দলের নেতা এবং সংসদ-সদস্যদের নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। বিএনপির সামনে ১০ চ্যালেঞ্জ নিরপেক্ষ সরকার, মামলা-হামলা মোকাবিলা করে সফলভাবে কর্মসূচি পালন, জামায়াতকে রেখে ঐক্য ধরে রাখা ও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা হাবিবুর রহমান খান আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বহুমুখী চ্যালেঞ্জে মাঠের বিরোধী দল বিএনপি। দুটি পর্বে এ চ্যালেঞ্জগুলো ভাগ করে তা মোকাবিলায় কাজ করছেন দলটির হাইকমান্ড। প্রথম পর্বে রয়েছে অর্ধডজন বিষয়। যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায়। সে লক্ষ্যে চূড়ান্ত আন্দোলনের পরিকল্পনা তৈরি করেছে দলটি। শিগগিরই সরকার পতনের একদফায় রাজপথে নামার প্রস্তুতি চলছে। আন্দোলনের চূড়ান্ড লক্ষ্যে পৌঁছাতে দল ও জোটের ঐক্য ধরে রাখা বিএনপির কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া মামলা-হামলা মোকাবিলা করে সফলভাবে কর্মসূচি বাস্তবায়ন, ‘চেইন অব কমান্ড’ নিশ্চিত করা, সহিংসতা এড়িয়ে আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া, জামায়াতের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত সম্পর্ক কী হবে-সেসব দিকেও বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন হাইকমান্ড। সরকারবিরোধী আন্দোলনে এবার সফলতার বিকল্প ভাবছে না বিএনপি। দাবি আদায় হলে দ্বিতীয় পর্বে দলটির সামনে আরও কিছু কঠিন বিষয় আসবে। সেগুলোর মধ্যে আছে-যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলো নিয়ে জোটগতভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ, আসন ভাগাভাগি, যোগ্যদের মনোনয়ন দেওয়া এবং নির্বাচনে জয়ী হলে সবাইকে নিয়ে ঐকমত্যের সরকার গঠন। তবে কোনো কারণে আন্দোলন ব্যর্থ হলে দলটি নতুন করে কঠিন পরিস্থিতিতে পড়বে। সেক্ষেত্রে নির্বাচন প্রতিহত করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। এরপরও সরকার যেনতেন নির্বাচন করে উতরে গেলে মামলা-হামলায় জর্জরিত বিএনপিকে টিকিয়ে রাখাই হবে তখন তাদের অন্যতম চ্যালেঞ্জ। বিএনপি নেতারা মনে করেন, সব দল মিলে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন হলে তখনও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মোকাবিলা করতে হবে তাদের। বিশেষ করে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে। ইভিএম না থাকায় ভোটে সূক্ষ্ম কারচুপি হওয়ার আশঙ্কা নেই। কিন্তু ব্যালটে নির্বাচন হওয়ায় ভোটকেন্দ্রে সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। এ সরকার দীর্ঘদিন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। প্রশাসনসহ সর্বত্র তাদের অনুসারীরা সক্রিয়। প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তার সহায়তায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ভোটকেন্দ্র দখলে নেওয়ার চেষ্টা চালাতে পারে। তাই নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হলেও ভোটকেন্দ্র যাতে দখলে নিতে না পারে, সেই প্রস্তুতিও রাখতে হবে। এক্ষেত্রে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরপেক্ষ ভূমিকা নিশ্চিত করার পাশাপাশি নেতাকর্মীদের কেন্দ্রে উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, শুধু বিএনপি নয় জাতির সামনে এখন একমাত্র চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এ অবৈধ সরকারের পতন। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও ভোটাধিকার নিশ্চিতে এর কোনো বিকল্প নেই। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আমরা সেই চ্যালেঞ্জ বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছি। তিনি বলেন, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ভোট নিশ্চিত করা গেলে নির্বাচন সংক্রান্ত অনেক বিষয়ই সহজ হয়ে যাবে। আসন ভাগাভাগি, মনোনয়ন কিংবা অন্যান্য বিষয় নিয়ে জটিলতা হবে না। বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায় করেই তারা ভোটে অংশ নেবে। দলটির নেতারা মনে করেন, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে গেলে ভোটের ফলাফল কী হবে, তা সবাই জানে। তাই এ সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেওয়া না নেওয়া একই কথা। আন্দোলনের মাধ্যমে নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায়েই গুরুত্ব দিচ্ছেন তারা। দল ও সমমনাদের একমঞ্চে এনে ঐক্যবদ্ধভাবে রাজপথে কর্মসূচি পালন করা অন্যতম চ্যালেঞ্জ মনে করছে দলটি। কারণ, আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে সরকারের পক্ষ থেকে নানা ধরনের অপচেষ্টা চালানো হতে পারে। বিএনপির কয়েক নেতা যুগান্তরকে বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে ছোট দলগুলো নানা হিসাব মেলাতে ব্যস্ত থাকে। আদর্শের চেয়ে তাৎক্ষণিক চাওয়া-পাওয়াই তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। সেক্ষেত্রে আন্দোলনে থাকা দলগুলোর মধ্যে ভাঙন সৃষ্টিতে নানা উদ্যোগ নিতে পারে সরকার। কোনো দল যুগপৎ আন্দোলন থেকে বেরিয়ে গেলে সেটা নেতিবাচক বার্তা দেবে। তাই আন্দোলনে সফলতা আদায়ে সমমনা দলগুলোর মধ্যে ঐক্য ধরে রাখা কঠিন। সমমনা দলগুলোর পাশাপাশি বিএনপির মধ্যে ঐক্য ও চেইন অব কমান্ড নিশ্চিত করাও হাইকমান্ডের দায়িত্ব। কারণ, দলের শীর্ষ নেতৃত্বের অনুপস্থিতিতে সবকিছু হচ্ছে। দলের সিনিয়র নেতাদের এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। দলটির নেতারা মনে করেন, চূড়ান্ত আন্দোলন নস্যাতে সরকার নানা কৌশলের আশ্রয় নিতে পারে। অতীতের চেয়ে সাংগঠনিকভাবে দল বেশ শক্তিশালী। নেতাকর্মীদের মনোবল ভাঙতে সক্রিয় নেতাদের টার্গেট করে দেওয়া হতে পারে নতুন মামলা। আবার পুরোনো মামলাগুলোও সচল করা হতে পারে। অনেক নেতাকে টার্গেট করে তাদের মামলা দ্রুত শেষ করে দেওয়া হতে পারে সাজা। তাই মামলা ও সাজা মোকাবিলা করে রাজপথে টিকে থাকাও কঠিন চ্যালেঞ্জ হবে। জানতে চাইলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী যুগান্তরকে বলেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতে প্রয়োজন একটি নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার। দেশে এমন একটি সরকার প্রতিষ্ঠাই আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমরা কাজ করছি। এছাড়া দলীয় কিছু চ্যালেঞ্জ তো সব সময় থাকে। সেগুলোকে আমরা ততটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি না। দলীয়ভাবেই তা সমাধান করা হয়ে থাকে। তিনি বলেন, দেশে প্রকৃত গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা হলে অন্য সমস্যাগুলো এমননিতেই সমাধান হয়ে যাবে। প্রতিষ্ঠানগুলো গণতান্ত্রিক ধারায় পরিচালিত হবে। তাই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাই আমাদের মূল লক্ষ্য। বিএনপির একাধিক নেতা যুগান্তরকে বলেন, আন্দোলনে সফল হলে কিছু বিষয় সামনে আসবে। এর মধ্যে রয়েছে জোটগতভাবে নির্বাচনে অংশ নেওয়া, মনোনয়ন চূড়ান্ত করা। যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলোর মাঠপর্যায়ে জনভিত্তি নেই। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে সবার জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। তাই তাদের বাদ দিয়ে মনোনয়ন চূড়ান্ত করা কঠিন হবে। আবার তাদের মনোনয়ন দেওয়া হলে দলের গুরুত্বপূর্ণ অনেক নেতা বাদ যাবেন। এতে দেখা দেবে ক্ষোভ ও হতাশা। সবাইকে ম্যানেজ করে মনোনয়ন চূড়ান্তে বেশ বেগ পেতে হবে হাইকমান্ডকে। সমমনা দলগুলো একসঙ্গে ভোট করলে জামায়াতকে নিয়ে কী করবে, তাও সামনে আসবে। জানতে চাইলে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল যুগান্তরকে বলেন, এ মুহূর্তে এ সরকারকে ক্ষমতা থেকে বিদায় করাই বিএনপির সামনে সবচেয়ে বড় কাজ। কারণ, এ সরকার সাধারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়াকে গুরুত্বই দিচ্ছে না। তারা একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতা করে ক্ষমতায় টিকে আছে। আগামী দিনেও তারা যে কোনোভাবে ক্ষমতায় যেতে মরিয়া। তারা সহজে দাবি মেনে নেবে, এটা ভাবার কারণ নেই। তাই এদের কাছ থেকে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায় করাই হচ্ছে বিএনপির মূল লক্ষ্য। তিনি বলেন, আন্দোলনে থাকা দলগুলো নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করা হবে বলে হাইকমান্ড ঘোষণা দিয়েছে। তবে সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে নির্বাচন করার ব্যাপারে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। যেহেতু আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে এ সরকারের পতন। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন হলে নির্বাচন নিয়ে আমাদের শরিকদের মধ্যে বোঝাপড়ায় সময় লাগবে না। কাজেই এ নিয়ে কোনো সংকটও হবে না।