ফারুকী হত্যাকান্ডের জট খোলেনি
হাইকোর্ট মাজার জামে মসজিদের খতিব ও বেসরকারি টেলিভিশনের উপস্থাপক মাওলানা নূরুল ইসলাম ফারুকীর হত্যাকান্ডের রহস্য উদঘাটন এবং খুনিদের গতকাল পর্যন্ত গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। গতকাল শুক্রবার বাদ জুমা জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে মরহুমের প্রধান জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। এর পর লাশ দাফনের উদ্দেশ্যে গতকালই নিহতের গ্রামের বাড়ি পঞ্চগড়ের উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হয়। এদিকে প্রথম দিনের মতো গতকালও ফারুকীর হত্যার প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ হয়েছে। আজকের মধ্যে (শনিবার) তার খুনিরা ধরা না পড়লে আগামীকাল রোববার সারাদেশে হরতালের ডাক দিয়েছে ইসলামী ছাত্রসেনা। গতকাল বাদ জুমা বায়তুল মোকাররমের সামনে থেকে হরতালের সমর্থনে মিছিল বের করে এ ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। এসময় তারা হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবি জানান। মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে মাওলানা নূরুল ইসলাম ফারুকী ও মগবাজারে তিন খুনের ঘটনায় মানুষ আতঙ্কিত বলে উল্লেখ করেছেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত। এদিকে ঘটনার দু’দিন পেরিয়ে গেলেও ফারুকীর খুনিরা ধরা না পড়ায় নিহতের ভক্তবৃন্দের মধ্যে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে।
খুনের আগে ফারুকীর বাসায় ভক্ত পরিচয়ে এক নারীর কয়েক ঘণ্টার অবস্থান নিয়ে দেখা দিয়েছে চরম সন্দেহ। সেই নারী খুনিদের সহযোগী বলে আশঙ্কা করেছেন নিহতের পরিবার ও তদন্ত কর্মকর্তারা। থানা পুলিশের পাশাপাশি ডিবি ও র্যাব চাঞ্চল্যকর এ মামলাটির ছায়া তদন্ত শুরু করছে। ইতিমধ্যে মাওলানা ফারুকীর মোবাইল ফোনের কললিস্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়েছে। কয়েকটি কারণ সামনে রেখে এ হত্যার মোটিভ উদঘাটনের চেষ্টা করছেন তদন্ত কর্মকর্তারা।
গতকাল জুমার নামাজ শেষে জাতীয় ঈদগাহ প্রাঙ্গণে মরহুম মাওলানা ফারুকীর প্রধান জানাজার নামাজ সম্পন্ন হয়। জানাজার নামাজ পড়ান জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব আল্লামা প্রফেসর মাওলানা মো. সালাহউদ্দিন। এতে প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন, হজ এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব) এর চেয়ারম্যান ইব্রাহীম বাহার, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, আহলে সুন্নাত ওয়াল জমা’আতের নেতাকর্মীসহ ভক্ত ও অনুসারীরা অংশ নেয়। মরহুমের বড় ছেলে আহম্মেদ রেজা ফারুকী, মেজ ছেলে ফয়সাল ফারুকীসহ স্বজনেরা উপস্থিত ছিলেন। জানাজা শেষে ঈদগাহ ময়দানের গেট থেকে মরহুমের ভক্তরা একটি বিশাল মিছিল বের করে। মিছিলটি শাহবাগে গিয়ে শেষ হয়। সেখানে ফারুকীর হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবি জানান বক্তারা। জানাজা নামাজ শেষে মরহুমের লাশবাহী গাড়ি নিয়ে তার নিজ জেলা পঞ্চগড়ের উদ্দেশে রওনা দেন স্বজনরা।
ফারুকীর দ্বিতীয় স্ত্রীর বড় ভাই জিয়াউল হক জানান, চট্টগ্রামে ফারুকীর ভক্তকুল বেশি থাকার কারণে লাশ চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিভিন্ন জটিলতার কারণে নিয়ে যাওয়া হয়নি। আজ (শনিবার) বেলা ১১টায় মরহুমের গ্রামের বাড়ি পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার তাওতারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে শেষ জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর পঞ্চগড়ের নাওছড়ি গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে মায়ের কবরের পাশে তাকে চির নিদ্রায় শায়িত করা হবে।
এদিকে ফারুকীর খুনিদের প্রসঙ্গে ঘটনার দিনের কথা উল্লেখ করে ফারুকীর দ্বিতীয় স্ত্রী লুবনা ফারুকী গণমাধ্যমকে বলেন, তার স্বামী খুন হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে বাসায় এসেছিলেন আসমা নামের এক মহিলা। ওই মহিলা বাসা থেকে চলে যাওয়ার ১৫ মিনিট পরই এ হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটে। ওই মহিলা অনেকদিন ধরেই দেখা করার কথা বলে গত বুধবার মোবাইল ফোনে বাসার ঠিকানা নেন। বিকেল ৪টার দিকে ময়লা বোরকা পরিহিত মধ্য বয়সী নারীটি বাসায় আসে। মহিলার আচরণ ছিল রহস্যেঘেরা। বাসায় প্রবেশের পর তিনি বিভিন্ন কক্ষে এমনকি আচমকা রান্নাঘরেও প্রবেশ করেন। ছেলে ফয়সাল তাকে ফার্মগেট পর্যন্ত পৌঁছে দেন। মহিলা তাদের বাসা থেকে চলে যাওয়ার পর এ হত্যাকা- ঘটে। লুবনার দাবি, তার স্বামীর কললিস্ট পরীক্ষা এবং ওই মহিলাকে গ্রেফতার করতে পারলে আসল খুনিকে ধরা সম্ভব হবে। পরিবারের সদস্যরাও ওই নারীর রহস্যময় আচরণের সঙ্গে এই হত্যাকা-ের যোগসূত্রতা খুঁজছেন। তাদের ধারণা, হত্যাকারীরা খোঁজ-খবর নিতেই ওই নারীকে পাঠিয়েছিলেন।
গত বুধবার রাতে ফারুকীর নৃশংস খুনের কয়েক ঘণ্টা পর তার মেজ ছেলে ফয়সাল ফারুকী বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আট-নয়জনকে আসামি করে শেরে বাংলানগর থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। শেরেবাংলা নগর থানার পাশাপাশি মামলাটি ছায়া তদন্ত করছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও র্যাব। তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করা যায়নি। তবে অনেককেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। হত্যাকা-ের উদ্দেশ্য উদঘাটনের চেষ্টা চলছে। এদিকে ফারুকীর খুনের প্রতিবাদে গতকালও ঢাকাসহ একাধিক জেলায় বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে। গতকাল বাদ জুমা ‘ঈমান আক্বিদা রক্ষা কমিটি’র ব্যানারে পঞ্চগড় শহরে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। মিছিলটি শেরেবাংলা পার্ক থেকে শুরু হয়ে শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ঘুরে আবার সেখানে গিয়ে শেষ হয়। সমাবেশে বক্তারা মাওলানা ফারুকীর হত্যাকান্ডে জড়িত ব্যক্তিদের খুঁজে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান। একই সঙ্গে তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তার দাবি জানানো হয়েছে।
জানাজা মিছিল পথসভা কর্মসূচি
বিপুলসংখ্যক মুসল্লী ও ভক্তগণের উপস্থিতিতে বিশিষ্ট আলেম মিডিয়া ব্যক্তিত্ব মরহুম আল্লামা নূরুল ইসলাম ফারুকীর জানাজা নামাজ গতকাল রাজধানীর জাতীয় ঈদগাঁহ ময়দানে অনুষ্ঠিত হয়েছে। বেলা ৩টায় অনুষ্ঠিত জানাজা নামাজে ইমামতি করেন বায়তুল মুকাররম জাতীয় মসজিদের খতিব প্রফেসর মাওলানা সালাহউদ্দীন। জানাজা নামাজে প্রধান বিচারপতি, বিভিন্ন মুসলিম দেশের কূটনীতিক, বিভিন্ন দরবার ও খানকার পীর মাশায়েখ প্রখ্যাত সুন্নী ওলামায়ে-কেরাম এবং বিভিন্ন ইসলামী দল ও সংগঠনের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ এবং সকল পর্যায়ের পদস্থ ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। আজ শনিবার সকাল ১০টায় পঞ্চগড়ে গ্রামের বাড়ীতে মরহুমের জানাজা শেষে দাফন হবে। মরহুমের জানাজা নামাজে শরীক হতে বেলা ১১টার পর থেকেই জানাজা নামাজে অংশগ্রহণকারীগণের অনেকে ঈদগাঁহ ময়দানে এবং হাইকোর্ট মাজার মসজিদ বায়তুল মোকাররম জামে মসজিদসহ আশপাশের মসজিদসমূহে এসে জড়ো হয়ে জুমার নামাজ আদায় করেন। জুমার নামাজ শেষে তারা মিছিল নিয়ে অথবা বিচ্ছিন্নভাবে ঈদগাঁহ ময়দানে এসে জড়ো হতে থাকেন। বেলা ৩টা ৫ মিনিটে জানাজা নামাজ শুরু হওয়া পর্যন্ত ভক্ত ও মুসল্লীগণের আগমন অব্যাহত ছিল। জুমার নামাজের পর থেকে জানাজা নামাজের পূর্ব পর্যন্ত অনেকেই মরহুম ফারুকী সম্পর্কে বক্তব্য রাখেন। বক্তাগণের মধ্যে কেউ কেউ বলেন, মিলাদ কিয়ামের বিরোধীরাই মরহুম নূরুল ইসলাম ফারুকীকে সহ্য করতে পারেনি। তারা মরহুম ফারুকীর হত্যকারীদের ফাঁসি এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে মিলাদ কিয়াম ও দরুদের বিরোধীতা নিষিদ্ধ করার দাবী করেন। জানাজা নামাজ শেষে জানাজায় অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশই ঈদগাঁহ ময়দানের প্রধান গেইট থেকে একটি মিছিল নিয়ে শাহবাগ চত্বরে গিয়ে বিশাল পথসভা করে।
জানাযার পূর্ব সংহতিমূলক বক্তব্য রাখেন- সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি, পীরে তরিকত সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমাদ আল হাসানী, আল্লামা মাসউদ হোসাইন আলকাদেরী, মুহাম্মদ আব্দুল মতিন, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গভর্নর আল্লামা শাইখ খন্দকার গোলাম মাওলা, নুরুল হক চিশতী, উপাধ্যক্ষ আবুল কাশেম মুহাম্মদ ফজলুল হক, অধ্যক্ষ আ.জ.ম হেলাল উদ্দিন, আল্লামা খাজা আরিফুর রহমান তাহেরী, পীরে তরিকত আল্লামা আব্দুর রহমান আল কাদেরী, পীরে তরিকত আল্লামা সাইয়্যেদ মু’তাসিম বিল্লাহ রাব্বানী, আল্লামা ওয়ালি উল্লাহ আশেকী, মুহাম্মদ আব্দুল হাকিম, শহীদ আল্লামা ফারুকী’র ছোট ভাই আব্দুর রউফ, মেঝ ছেলে আহমাদ রেজা রাজু, সেঝ ছেলে ও হত্যা মামলার বাদী ফয়সাল, এডভোকেট দেলওয়ার পাটোয়ারী আশরাফী, আল্লামা অধ্যক্ষ হাফেজ রফিকুল ইসলাম, ফিরোজ আলম, গোলাম মাহমুদ ভূঁইয়া মানিক, আবু নাছের মুহাম্মদ মুসা, এডিএম আরুছুর রহমান, মুহাম্মদ মাসউদ হোসাইন প্রমুখ। উপস্থিত ছিলেন সোনাকান্দা এর বদরপুরের পীর সাহেবসহ অন্যান্য পীর সাহেবগণ।
বক্তারা বলেন, তারেক মোনাওয়ার, কামাল উদ্দিন জাফরী, আরকান উল্লাহ হারুনী, মুফতি ইবরাহিমসহ জামায়াতপন্থী মিডিয়া সন্ত্রাসীদেরকে গ্রেফতারসহ ফাঁসি নিশ্চিত না করা পর্যন্ত দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। ফারুকী হত্যাকে ডাকাতি মামলা বলে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা মানেই হচ্ছে চক্রান্তকারী জামায়াতীদের হেফাজত করা। এদেশের ধর্ম প্রাণ মানুষ বুকের রক্ত দিয়ে হলেও এই হত্যাকান্ডের বদলা নিবে ইনশাআল্লাহ। মরহুম আল্লামা নুরুল ইসলাম ফারুকীকে হত্যার প্রতিবাদে আজ সারাদেশে পূর্বঘোষিত বিক্ষোভ-সমাবেশ ও মিছিল অনুষ্ঠিত হবে। ঢাকায় ইসলামী ছাত্রসেনা সংবাদ সম্মেলন করে আগামীকালের হরতালের বিষয়ে ঘোষণা দেবে এবং জাতীয় প্রেসক্লাবে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত সংবাদ সম্মেলন করবে এবং আঞ্জুমানে রহমানিয়া মঙ্গঁনিয়া মাইজভান্ডারীয়া প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করবে।